Monday, November 11th, 2013
রামপাল প্রকল্পের ‘সংশোধিত’ ইআইএ ,পিডিবির বিভ্রান্তিকর মতামত এবং তার জবাব
সম্প্রতি পিডিবি’র ওয়েবসাইটে রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিবেশ সমীক্ষা বা ইআইএ রিপোর্টের সংশোধিত একটি ভার্সন প্রকাশ করা হয়েছে।সুন্দরবনের পাশে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের মূল পরিকল্পনা অক্ষুন্ন রেখেই সমালোচনার কারণে কিছু কিছু বিষয় ঘুরিয়ে লিখে এবং নতুন কিছু ফাপা আশ্বাস যুক্ত করে তৈরী হয়েছে এই সংশোধিত ইআইএ রিপোর্ট।ইতিপূর্বে জাতীয় কমিটি সহ বিভিন্ন ব্যাক্তি ও সংগঠন সরকারি ইআইএ রিপোর্টের যেসব সমালোচনা করেছেন, সংশোধিত ইআইএ রিপোর্টের একটি অংশে পিডিবি’র পক্ষ থেকে তার জবাবও দেয়া হয়েছে। সংশোধিত ইআইএ রিপোর্ট এবং তার সাথে সংযুক্ত পিডিবি’র মতামত প্রসঙ্গে আমাদের বক্তব্য নিম্নরুপ:
লোক দেখানো ইআইএ প্রসঙ্গে:
স্থান চূড়ান্তকরণ, জমি অধিগ্রহণ, বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি স্বাক্ষর ইত্যাদি সম্পন্ন করার পর লোক দেখানো ইআইএ সম্পন্ন করা এবং জনগণের কাছে মতামত চাওয়ার যে প্রহসনের কথা আমরা তুলেছি, সে বিষয়ে পিডিবি’র বক্তব্য হলো:
“Pre-Fesibility study -র ভিত্তিতে, IEE প্রণয়ন পূর্বক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের স্থান প্রাথমিকভাবে নির্বাচন করা হয়। কোন প্রকল্পের স্থান চূড়ান্ত করার পূর্বে তার IEE করা জরুরী । নিয়ম অনুযায়ী IEE প্রণয়নের পর DoE -তে উপস্থাপন করা হলে DoE তা অনুমোদন পূর্বক প্রকল্পটির অনুমোদনের পর Site Clearance প্রদান করে থাকে। প্রচলিত সকল নিয়ম অনুসরণ পূর্বক খুলনা/রামপাল কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের IEE প্রতিবেদন DoE তে জমা দেয়া হলে পরীক্ষান্তে তার অনুমোদন প্রদান করে। অতপর DoE ২৩-০৫-২০১১ তারিখে রামপালে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য Site Clearance প্রদান করে। এরপরই ভূমি অধিগ্রহণের কার্যক্রম শুরু হয়। বাংলাদেশে বিদ্যমান পরিবেশ আইন মেনে উপরোক্ত কার্যসমূহ সম্পন্ন করা হয়।“
আমাদের জবাব:
প্রথমত, কোন প্রকল্পের স্থান চূড়ান্ত করার পূর্বে তার পূর্ণাঙ্গ পরিবেশ সমীক্ষা বা ইআইএ জরুরী, আইইই নয়। আইইই হলো ইনিশিয়াল এনভায়রনমেন্টাল এক্সামিনেশান যাকে আংশিক পরিবেশ সমীক্ষা বলা হয়, পূর্ণাঙ্গ পরিবেশ সমীক্ষা আদৌ লাগবে কি না তা যাচাই করার জন্য অনেক সময় আইইই করা হয়। কিন্তু আইইই কখনই পূর্ণাঙ্গ পরিবেশগত সমীক্ষা বা ইআইএ’র বিকল্প নয়।
দ্বিতীয়ত, ২৩-০৫-২০১১ তারিখে সাইট ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার পর জমি অধিগ্রহণ করার দাবীটি সঠিক নয়। প্রকৃত পক্ষে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে ২০১০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১১ সালের জানুয়ারির মধ্যে। সংশোধিত ইআইএ রিপোর্টের সাথে সংযুক্ত ‘দখল হস্তান্তর প্রত্যয়নপত্র’ থেকেও সাইট ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার আগেই জমি অধিগ্রহণ করার স্বীকারোক্তি পাওয়া যাচ্ছে:
“প্রত্যয়ন করা যাচ্ছে যে, নিম্ন তফসিল ভুক্ত স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি ১৯৮২ সনের ২ নং অধ্যাদেশের আওতায় ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধিশাখা ৫ এর বিগত ২৭-১২-২০১০ খ্রি: তারিখের ভূ:ম:/শা-৫/অধি/বাগের- ০৮/২০১০/২৬৩ নং স্মারকের আদেশ মোতাবেক ১/২০১০-১১ নং এল এ কেসে কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্প এর উদ্দেশ্যে অধিগ্রহণ করা হয়েছে।“
তাছাড়া সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে জানুয়ারি ২০০৯ থেকে ডিসেম্বর ২০১০ সাল পর্যন্ত এই দুই বছরে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সাফল্যের ৪৫ নং বয়ানটিতেও ২০১০ সালে ভূমি অধিগ্রহণের স্বীকারোক্তি আছে: “বাগেরহাট জেলার রামপাল উপজেলাধীন ০৯ নং কৈগরদাসকাঠি এবং ১০ নং সাপমারিকাটাখালী মৌজায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের জন্য ১৮৩৪.০০ একর জমি অধিগ্রহণ কার্যক্রম সম্পন্ন।”
সূত্র: http://www.minland.gov.bd/achievement
তৃতীয়ত, সাইট ক্লিয়ারেন্স বা অবস্থানগত ছাড়পত্রও দেয়া হয়েছিলো কতগুলো শর্তের ভিত্তিতে। পিডিবি সেই শর্তগুলোও ভঙ্গ করেছে। যেমন:
পরিবেশ মন্ত্রণালয় যখন ২৩ মে ২০১১ তারিখে “ভারত ও বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীদ্বয় কর্তৃক আলোচ্য প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হবে বিধায় উক্ত প্রকল্পের রাস্তাঘাট নির্মাণ এবং প্রস্তাবিত প্রকল্পের সাইট উন্নয়ণের” কারণ দেখিয়ে “অবস্থানগত ছাড়পত্র”প্রদান করে তখন কতগুলো শর্ত আরোপ করে। শর্তগুলোর মধ্যে দুইটি শর্তছিল এরকম:
শর্ত (চ): ইআইএ অনুমোদন না হওয়া পর্যন্ত বিদ্যমান জলাভূমি ভরাট করা যাবে না।
শর্ত(ছ): প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় বিদ্যমান জলাভূমি ভরাটের প্রয়োজন হলে সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের পরিবেশ সংরক্ষণ(সংশোধন) আইন, ২০১০ অনুযায়ী জলাভূমি ভরাটের জন্য বিধি মোতাবেক পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র গ্রহণ করতে হবে।
সবশেষে বলা হয়েছিলো: “যে কোন শর্ত ভঙ্গ করলে এ ছাড়পত্র বাতিল বলে গণ্য হবে।”
বাস্তবে এই শর্তগুলো ভঙ্গ করা হয়েছিলো কারণ ইআইএ অনুমোদন হয়েছে ২০১৩ সালের আগষ্ট মাসে আর বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য অধিগ্রহণ করা জলাভূমি ভরাট শুরু হয়েছে তারও অন্তত ছয় মাস আগে থেকে! কিন্তু আমরা দেখেছি ছাড়পত্র বাতিল হয় নি, নিয়মানুসারে কারো বিরুদ্ধে আইনগত ব্যাবস্থাও নেয়া হয় নি।
২৬৪০ মেগাওয়াটের বদলে ১৩২০ মেগাওয়াটের ইআইএ প্রসঙ্গে:
প্রস্তাবিত স্থানে মোট ২৬৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা থাকলেও এবং সে অনুযায়ী একবারে ১৮৩৪ একর জমি অধিগ্রহন করা হলেও, স্রেফ ১৩২০ মেগাওয়াটের জন্য ইআইএ করার অভিযোগ সম্পর্কে পিডিবি বলেছে:
“বর্তমান IEE ও EIA 1320 MW ক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এর ক্ষমতা আরো বৃদ্ধি করা হলে পরবর্তীতে study -র সময়কালের Baseline Condition এর ভিত্তিতে দ্বিতীয় পর্যায়ে অপর ইউনিট স্থাপনের পূর্বে নতুনভাবে সেই পুনরায় IEE ও EIA প্রণয়ন করা হবে। সে প্রতিবেদন অনুযায়ী নতুন ইউনিট সংযোজন বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।“
আমাদের জবাব: ১৩২০ মেগাওয়াটের একটি কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ৭০০ থেকে ৮০০ একর জায়াগা লাগে। এ ক্ষেত্রে ১৮৩৪ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে মূলত ২৬৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা মাথায় রেখেই। একবার ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ হয়ে গেলে এরপর দ্বিতীয় পর্যায়ে আরো ১৩২০ মেগাওয়াট যুক্ত না করতে চাওয়ার কারণ থাকবে না। যেহেতু ২৬৪০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দূষণ ১৩২০ মেগাওয়াটের দূষণের তুলনায় অনেক বেশি, সেকারণে একবারে ২৬৪০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্র এর জন্য ইআইএ না করে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ শুরু করা উচিত হবেনা বলেই আমরা মনে করি।
সুন্দরবন থেকে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিরাপদ দূরত্ব প্রসঙ্গে:
সারা দুনিয়া এমনকি খোদ ভারতের অভিজ্ঞতা ও নীতিমালা অনুযায়ী সুন্দরবনের মাত্র ১৪ কিমি দূরে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন মোটেই নিরাপদ নয়। কিন্তু পিডিবি পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক নির্ধারিত ১০ কিমি সীমার এনভাইরনমেন্টালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া(ইসিএ) ‘র দিকে ইঙ্গিত করে বলেছে:
“সংরক্ষিত বনভূমি এবং জনবসতি থেকে কতদূরে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ বা পরিচালিত হবে তা সুনির্দিষ্ট ভাবে DOE কর্তৃক প্রকাশিত নির্দেশিকাতে উল্লেখ করা আছে। এ ক্ষেত্রে ও তা অনুসরন করা হয়েছে।“
আমাদের জবাব:
পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক নির্ধারিত ১০ কিমি সীমার ইসিএ সাধারণ ভাবে বিভিন্ন শিল্পের জন্য প্রযোজ্য হলেও সুনির্দিষ্ট ভাবে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য সুনির্দিষ্ট কোন নীতিমালা বাংলাদেশের পরিবেশ অধিদপ্তরের নেই। সারা বিশ্ব এবং পাশ্ববর্তী ভারতে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিবেশ দূষণের যে অভিজ্ঞতা তা থেকে স্পষ্ট যে ১০ কিমি সীমা সাধারণভাবে প্রযোজ্য হলেও বড় আকারের কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দূষণের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে না। আর এ কারণেই পাশ্বর্তী দেশ ভারতের ওয়াইল্ড লাইফ প্রটেকশান এক্ট ১৯৭২ অনৃসারে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ১৫ কিমি মধ্যে এবং তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন সংক্রান্ত ইআইএ গাইড লাইন অনুসারে সংরক্ষিত বনাঞ্চল, শহর, বন্দরের ২৫ কিমি এর মধ্যে কোন কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা যায় না।
বিষাক্ত সালফার ও নাইট্রোডেজন গ্যাসের অনিরাপদ মাত্রা ও সুন্দরবনকে আবাসিক ও গ্রাম্য এলাকা দেখানো প্রসঙ্গে:
ইআইএ রিপোর্টে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নির্গত বিষাক্ত সালফার ও নাইট্রোজেন গ্যাসের মাত্রা নিরাপদ সীমার মধ্যে দেখানোর জন্য সুন্দরবনকে জালিয়াতি করে আবাসিক ও গ্রাম্য এলাকা দেখানো প্রসঙ্গে পিডিবি’র বক্তব্য :
“কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নির্গত বায়ুর মানমাত্রা বাংলাদেশের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় কর্তৃক ১৬ই জুলাই ২০০৫ তারিখে ECR 1997 ১৯৯৭ এর সংশোধন করে। উক্ত সংশোধন অনুসারে বর্তমানে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চারপাশের বায়ুতে SOx এর সর্বোচ্চ মাত্রা ৩৬৫ মাইক্রোগ্রাম/ঘন মিটার (২৪ ঘণ্টার জন্য), ৮০ মাইক্রোগ্রাম/ঘন মিটার (সারা বছরের গড়) এর বেশি হবে না। তদুপরি NOx এর ক্ষেত্রেও বায়ুতে সর্বোচ্চ মাত্রা ১০০ মাইক্রোগ্রাম/ঘন মিটার (সারা বছরের গড়) এর বেশি হবে না। প্রদত্ত পরিবেশ সমীক্ষাটিতে বস্তুনিষ্ঠ ভাবেই বায়ুপ্রবাহের সাথে সাথে SOx ও NOx এর সর্বোচ্চ মাত্রা চিমনি থেকে বিভিন্ন স্থানে নিরূপণ করা হয়েছে। যেটা কিনা ECR Amenment 2005 উপরোন্তু ECR 1997 এর মাত্রাকেও মেনে চলে। ECR 1997অনুসারে SOx ও NOx এর সর্বোচ্চ মাত্রা প্রকল্প এলাকায় Rural and Residential Zone এর মাত্রাকে মেনে চলে এবং সুন্দরবন এলাকায় SOx ও NOx এর সর্বোচ্চ মাত্রা Sensitive Zone এর মাত্রাকে মেনে চলে।”
আমাদের জবাব:
প্রথমত, লক্ষণীয় বিষয় হলো, সংশোধিত ইআইএ রিপোর্ট এবং পিডিবি’র মতামত- উভয় অংশেই অবশেষে সুন্দরবনকে সেনসেটিভ বা স্পর্শকাতর এলাকা বলে স্বীকৃত দেয়া হয়েছে যদিও ইআইএ’র আগের ভার্সনে সুন্দরবনকে তারা আবাসিক ও গ্রাম্য এলাকা বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছিলো!
দ্বিতীয়ত, এবার তারা সালফার ও নাইট্রোজেন গ্যাসের মাত্রা নিরাপদ সীমার মধ্যে দেখানোর জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৭ এর ২০০৫ সালের এর সংশোধনীর দোহাই দিচ্ছেন যা মোটেই গ্রহণ যোগ্য নয়। ১৯৯৭ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে দুনিয়াতে এমন কিছু ঘটে নাই, প্রযুক্তির এমন কোন অগ্রগতি ঘটে নাই কিংবা গাছপালা জীবজন্তুর এমন কোন সহনশীলতা বাড়ে নাই যে এইসব বিষাক্ত গ্যাসের সহনশীলতার মাত্রা ১৯৯৭ সালের ৩০ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার থেকে ২০০৫ সালে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়া যেতে পারে।
তৃতীয়ত, ECR 1997অনুসারে সুন্দরবন এলাকায় SOx ও NOx এর সর্বোচ্চ মাত্রা Sensitive Zone এর মাত্রাকে মেনে চলার যে দাবী পিডিবি করছে সেটাও সঠিক নয়। এখানে তারা আবার একটি চালাকি করেছে। এর আগের ইআইএ রিপোর্টে আমরা দেখেছিলাম, নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নির্গত সালফার ও নাইট্রোজেন গ্যাসের ২৪ ঘন্টার ঘনত্ব সুন্দরবন এলাকায় যথাক্রমে ৫৩.৪ মাইক্রোগ্রাম ও ৫১.২ মাইক্রোগ্রাম দাড়ায় যা পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৭ অনুসারে সুন্দরবনের মতো স্পর্শকাতর এলাকার মানদন্ডের চেয়ে (৩০ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার) অনেক বেশি। এই সালফার ও নাইট্রোজেন গ্যাসের মাত্রা তারপরেও নিরাপদ সীমার মধ্যে দেখানোর জন্য আগের রিপোর্টে সুন্দরবনকে আবাসিক ও গ্রাম্য এলাকা হিসেবে দেখানো হয়েছিলো কারণ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৭ অনুযায়ী আবাসিক ও গ্রাম্য এলাকার জন্য সালফার ও নাইট্রোজেন গ্যাসের মাত্রা ৮০ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার।
কিন্তু যেহেতু তাদের এই চালাকি ধরা পড়ে যায় এবং তারা অবশেষে সুন্দরবনকে স্পর্শকাতর এলাকার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয় তাই স্বাভাবিক ভাবেই সুন্দরবন এলাকায় ২৪ ঘন্টা হিসেবে সালফার ও নাইট্রোজেনের যে ঘনত্ব তা ১৯৯৭ সালের আইন অনুযায়ী নিরাপদ সীমার মধ্যে পড়ে না। কিন্তু নিরাপদ সীমার মধ্যে না দেখাতে পারলে তো সুন্দরবনের ১৪ কিমি দূরে প্রস্তাবিত প্রকল্প সরাসরি অগ্রহণ যোগ্য স্বীকার করতে হয় যার এক্তিয়ার হয়তো তাদের নেই! এ কারণে তারা নতুন একটা চালাকি করেছে, তারা এবার ২৪ ঘন্টার ঘনত্বের বদলে সুন্দরবনের কাছে সালফার ও নাইট্রোজেন গ্যাসের বার্ষিক ঘনত্বের হিসাব বের করে দেখাতে চেয়েছে সালফার ও নাইট্রোজেনের বার্ষিক গড় ঘনত্ব নিরাপদ সীমার মধ্যেই থাকে!
সংশোধিত ইআইএ রিপোর্টে সুন্দরবনের কাছে সালফার ও নাইট্রোজেন গ্যাসের ঘনত্বের হিসাবটি এ রকম:
লক্ষণীয় বিষয় হল, এবারে সুন্দরবনের কাছে সালফার অক্সাইড গ্যাসের ২৪ ঘণ্টার মাত্রা দেখানো হয়েছে ৫৮.৪৩ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার এবং বার্ষিক গড় মাত্রা দেখানো হয়েছে ১৯.৩৬ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার। পরিবেশ আইন ১৯৯৭ এর মাত্রাকে এর আগের রিপোর্টে ২৪ ঘন্টার গড়ের সঙ্গে তুলনা করা হলেও এবারে পরিবেশ আইনের স্ট্যান্ডার্ড ৩০ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটারকে বার্ষিক ঘনত্বের সীমা হিসেবে দেখানো হয়েছে।
অথচ এর আগের রিপোর্টে পরিবেশ আইনের স্ট্যান্ডার্ডকে ২৪ ঘণ্টার গড় হিসেবে দেখানো হয়েছিল যা নিচের টেবিল থেকে স্পষ্ট হবে:
একইভাবে এবার নাইট্রোজেন অক্সাইডের মাত্রা দেখানো হয়েছে ২৪ ঘণ্টার গড় ৪৭.২ মাইক্রোগ্রাম যা পরিবেশ আইন ১৯৯৭ এর স্পর্শকাতর এলাকার জন্য নির্ধারিত মাত্রা (৩০ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার) এর চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু নিচের টেবিলে আমরা দেখছি, ২৪ ঘন্টার গড়ের সঙ্গে পরিবেশ আইনের মাত্রার তুলনাটি করা হয়নি, ঘরটি ফাঁকা রেখে দেওয়া হয়েছে।
অথচ এর আগের বার, পরিবেশ আইন ১৯৯৭ এর মাত্রাটিকে ২৪ ঘণ্টার গড় মাত্রার সঙ্গেই তুলনা করা হয়েছিল:
সংশোধিত ইআই্এ’র দাবি অনুসারে বার্ষিক গড় মাত্রা যদি নিরাপদসীমার মধ্যে থাকেও, তাহলেও নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি-– এই চারমাস প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টায় গড়ে সালফার ও নাইট্রোজেন অক্সাইড গ্যাসের মাত্রা এই হারে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৭ এর নির্ধারিত মাত্রার তুলনায় বেশি থাকে তাহলে তা সুন্দরবনের পরিবেশের উপর ভয়ংকর প্রভাব ফেলবে না এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।
চতুর্থত, ফ্লু গ্যাস ডিসালফারাইজার বা এফজিডি(FGD) ব্যাবহরের মাধ্যমে নির্গত সালফারের পরিমাণ কমানোর একটা আশ্বাস সংশোধিত ইআইএ রিপোর্টে দেয়া হয়েছে। এভাবে এফজিডি ব্যাবহার করলে সালফারের পরিমাণ নিরাপদ মাত্রার চেয়ে অনেক কম হবে দেখানো হলেও, এখানেও একটা ফাকি আছে। ইআইএ রিপোর্ট অনুসারে কয়লায় সালফারের পরিমাণ ০.৬% এর চেয়ে বেশি হলেই কেবল মাত্র এফজিডি ব্যাবহার করা হবে। অথচ ০.৬% সালফার সমৃদ্ধ কয়লা থেকে নির্গত সালফারের মাত্রা এফজিডি ব্যাবহারের ফলে সুন্দরবনের কাছে ৫৮.৪৩ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার থেকে ১৪.৪ মাইক্রোগ্রাম এ নেমে আসবে বলে হিসেব করে দেখানে হয়েছে!
এফজিডি ব্যাবহার করলে বিশ্ব ব্যাংকের হিসাব অনুসারে ক্যাপিটাল কষ্ট ১১ থেকে ১৪ শতাংশ বেড়ে যায়। এফজিডি’র মাধ্যমে প্রতি টন সালফার ডাই অক্সাইড পরিশোধন করতে ৫০০ ডলার খরচ হলে বছরে ৫২ হাজার টন সালফারডাইঅক্সাইডের জন্য খরচ হবে ২.৬ কোটি ডলার বা ২০৮ কোটি টাকা। অথচ ইআইএ রিপোর্ট অনুসারে ফিজিবিলিটি স্টাডি রিপোর্টে পরিবেশ দূষণের যন্ত্রপাতি স্থাপনের ব্যায় ধরা হয়েছে ১৯৬৫.৭ মিলিয়ন বা ১৯৬.৫৭ কোটি টাকা এবং পরিচালনা খরচ ধরা হয়েছে ২৯৪.৯ মিলিয়ন বা ২৯.৪৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ এফজিডি স্থাপনের খরচ যদি বাদও দিই,শুধু বছরে ৫২ হাজার মেট্রিক টন সালফার ডাই অক্সাইড পরিশোধণের জন্য প্রয়োজনীয় ২০৮ কোটি টাকার মাত্র ৭ ভাগের এক ভাগ অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে বায়ু-পানি-শব্দ সহ সব ধরণের দূষণ পরিশোধনের খরচ হিসেবে!
The environmental equipment cost will be BDT 1965.7 million and the environmentaloperation and maintenance cost will be BDT 294.9 million per year according to the feasibility report.(সংশোধিত ইআইএ, পৃষ্ঠা ৪১৭)
শুধু তাই নয়, পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য যে সব যন্ত্রপাতি স্থাপনের খরচ দেখানো হয়েছে, সেখানেও এফজিডির কথা উল্ল্যেখ করা হয় নি:
এ থেকেই বোঝা যায়, পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণের অন্যান্য গালভরা কথার মতোই এফজিডি ব্যাবহারের মাধ্যমে সালফার দূষণ নিয়ন্ত্রণের আশ্বাসও আসলে একটা ধাপ্পা ছাড়া আর কিছুই না।
পশুর নদীর পানি দূষণ প্রসঙ্গে: কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র হতে নির্গত পানি দূষণের আশংকা প্রসঙ্গে পিডিবি’র বক্তব্য হলো:
“প্রতিবেদনে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহৃত পানি নির্ধারিত মাত্রায় পরিশোধন পূর্বক নি:সরণ করাকেই ‘zero (0)’ discharge হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যবহৃত পানি DoE প্রদত্ত মানদন্ড অনুযায়ী দূষণমুক্ত না করে নদীতে ফেলা হবে না। প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্ষেত্রে তা মেনে চলা হবে বিধায় জীববৈচিত্রের উপর কোনরূপ প্রভাব পরবে না। DoE এর নির্ধারিত মানদন্ড ও EIA প্রতিবেদনে প্রদত্ত EMP অনুযায়ী বিষয়টি কঠোরভাবে পালন করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকল মহল (NGO সহ) সচেষ্ট থাকিবে।“
আমাদের জবাব: প্রতিশ্রুতি অনুসারে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যাবহ্রত পানি নির্ধারিত মাত্রায় পরিশোধন পূর্বক নি:সরণ করা হলেও পশুর নদী থেকে পানি প্রত্যাহার, তারপর বিপুল বেগে পানি আবার নদীতে নির্গমন, নির্গমনকৃত পানির তাপমাত্রা ইত্যাদি নদীর স্বাভাবিক পানি প্রবাহ, পানির প্লবতা, পলি বহন ক্ষমতা, মৎস ও অন্যান্য প্রানী ও উদ্ভিদের জীবন চক্র ইত্যাদির উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ার আশংকা থেকে যায়। তাছাড়া বাংলাদেশে DoE, NGO সহ “সংশ্লিষ্ট সকল মহল” বহাল তবিয়তে থাকা স্বত্ত্বেও খোদ রাজধানী ঢাকা সহ সারা দেশের নদী গুলোতে যে হারে কারখানার দূষিত পানি পরিশোধন ছাড়াই নির্গত হয়ে ভয়াবহ নদী দূষণ করছে, সেই বাস্তবতা মাথায় রাখলে সুদুর সুন্দরবনের পশুর নদীতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চালিত একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে পানি সঠিক মাত্রায় পরিশোধণ পূর্বক নি:সরণ হবে- এই ভরসা রাখা মুশকিল।
ছাই এর দূষণ ও ব্যাবহার প্রসঙ্গে:
কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নির্গত ছাই এর মাধ্যমে বায়ু দূষণ, পানি দূষণ, ছাই এর পুকুরে রাখা ছাই এবং ১৪১৪ একর জমি ভরাট করার জন্য ব্যাবহ্রত ছাইয়ের মাধ্যমে মাটির নীচের এবং মাটির উপরের নদী-খালের পানি দূষণের আশংকার বিষয়ে পিডিবি’র বক্তব্য:
“বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ঊঝচ থেকে সংগৃহীত ঋষু অংয এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ইড়ঃঃড়স অংয পরিবেশ সহায়ক হিসেবে সংরক্ষণের জন্য ঝষঁৎৎু করণ পূর্বক অ্যাশ পন্ডে সংরক্ষণ করা হবে। ফলে এ দুই ধরনের ছাই বাতাসে উদ্গীরণের কোন সম্ভাবনা নাই। উৎপাদিত ছাই এ যে সমস্ত ভারী ধাতু (যবধাু সবঃধষ) আছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে তা সহনীয় মাত্রার অনেক নিচে বিদ্যমান থাকবে, যা ভূগর্ভস্থ পানি দূষণের জন্য ভয়াবহ নয়। এছাড়া যে পুকুরে ছাই সংরক্ষণ করা হবে তার তলদেশ এবং পাড় কংক্রিট দ্বারা নির্মিত হবে। ফলে এখান থকে পানি চুয়নোর কোন সম্ভাবনা নেই। এছাড়া রামপাল এলাকার ভূমিস্থ মিষ্টি পানির আধার ১০-১৫ মি. পুরু কাঁদার স্তরের নিচে অবস্থিত। প্রকল্প এলাকা উন্নয়নের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র এক বারই ছাই ব্যবহার করা হবে। এমতাবস্থায় সেক্ষেত্রে ভূগর্ভস্থ পানি দূষণের কোন আশংকা নাই।“
আমাদের জবাব:
প্রথমত, ছাইয়ে থাকা বিভিন্ন ভারী ধাতু যেমন আর্সেনিক, পারদ, সীসা, নিকেল, ভ্যানাডিয়াম, বেরিলিয়াম, ব্যারিয়াম, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, সেলেনিয়াম, রেডিয়াম ইত্যাদি সামান্য পরিমাণে থাকলেও বিপুল পরিমাণ ছাই থেকে সম্মিলিত ভাবে ঠিক কত পরিমাণ ধাতু নির্গত হবে তার কোন হিসেব ইআইএ রিপোর্টে না করেই বলে দেয়া হয়েছে “তা সহনীয় মাত্রার অনেক নিচে থাকবে”। অথচ ইউনিয়ন অব কনসার্নড সাইনটিস্টের হিসেব মতে ৫০০ মেগাওয়াটের একটি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বছরে ১৭০ টন বিষাক্ত মারকারি বা পারদ, ২২৫ পাউন্ড আর্সেনিক, ১১৪ পাউন্ড সীসা, ৪ পাউন্ড ক্যাডমিয়াম ইত্যাদি ভারী ধাতু থাকে। ১৩২০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে এর চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি বিষাক্ত ভারী ধাতু ছাইয়ের সাথে নির্গত হবে। অথচ সেই বিষাক্ত ছাই দিয়ে ১৪১৪ একর জমি ভরাট করা হবে আর আমাদেরকে আশ্বস্ত করা হবে পানির স্তর কাদার নীচে থাকার কারণে জমি ভরাটে একবার ছাই ব্যাবহার করলে ভূগর্ভস্থ পানি দূষণের কোন আশংকা নেই!
দ্বিতীয়ত, উৎপাদিত ছাই কে স্লারিতে রুপান্তিরত করে কংক্রিটের অ্যাশ পন্ডে রাখা হবে বলে আশ্বস্ত করার চেষ্টা হলেও পশুর নদীর ঠিক পাশেই কিন্তু সেই অ্যাশ পন্ড স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। জোয়ার ভাটা বন্যা ঝড় জলোচ্ছ্বাস প্লাবিত অঞ্চলে ছাই এর পুকুর প্লাবিত হয়ে নদী-খালের পানির সাথে ছাই মিশ্রিত বিষাক্ত পানি মিশে যাওয়ার আশংকা তাই অমূলক নয়।
তৃতীয়ত, ইআইএ রিপোর্টে ছাই এর বহুবিদ ব্যাবহারের আশ্বাস দেয়া হলেও বাংলাদেশে ইতিপূর্বে স্থাপিত বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বার্ষিক ১ লক্ষ টন ছাই এর সুষ্ঠু ব্যাবহার করতে পারেনি বাংলাদেশ। তাছাড়া যে এনটিপিসি কোম্পানি এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনা করবে সেই এনটিপিসি’র ছাই ব্যাবস্থাপনা ও ব্যাবহার খোদ ভারতেই সন্তোষজনক নয়।
গত ২০১০ সালের ৭-৯ জুলাই অনুষ্ঠিত ভারতীয় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং কয়লা খনির পরিবেশ সমীক্ষা বিষয়ক এক্সপার্ট অ্যাপরাইজাল কমিটি এনটিপিসি কর্তৃক ছাই ব্যাবহার সম্পর্কে মন্তব্য করে:
“The Committee further observed that the present volume of fly ash generated and the quantity utilized from M/S NTPC Ltd. power plants all over the country is far from satisfactory.”
চতুর্থত, ছাইয়ে থাকা রেডিও অ্যাক্টিভ ম্যাটিরিয়াল যেমন: ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম ইত্যাদির ক্ষতিকর প্রভাব পর্যালোচনা না করার ব্যাপারে পরিবেশ আইনবিদদের সংগঠন বেলার তোলা অভিযোগের জবাবে পিডিবি দায়সারা গোছে বলে দিয়েছে কয়লার মধ্যে এসব সামান্য পরিমাণে থাকার কারণে কোন ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে না এবং যে ধরণের কয়লায় রেডিও অ্যাক্টিভ ম্যাটেরিয়াল বেশি থাকে সে ধরণের কয়লা যেন আমদানী না করা হয় তা বিডিং ডকুমেন্টে উল্ল্যেখ থাকবে বলে আশ্বস্ত করতে চেয়েছে।এমনকি ইআইএ রিপোর্টে এই ছাই ব্যাবহারে মাটির উর্বরা শক্তিবাড়ার কথাও বলা হয়েছে। অথচ এইসব বিষয় আমলে নিয়ে খোদ ভারতের এক্সপার্ট অ্যাপ্রাইজাল কমিটি কৃষি জমিতে ছাইয়ের ব্যাবহার অনুমোদন করেনি।
ভারতীয় এক্সপার্ট এপ্রাইজাল কমিটি গত ৬-৭ ডিসেম্বর ২০১০ এ কৃষি জমিতে ফ্লাই অ্যাশের ব্যাবহারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বলে:
“Regarding use of Fly Ash in agriculture, the Committee also expressed its strong reservations considering that the available information is limited and not supported by long term scientific study. Considering that fly ash is reported to contain about 48 elements including radioactive elements and toxic heavy metals (in mild dose), the Committee advocated that unless scientific study rules out long term adverse health impacts, as such, this method of fly ash disposal shall not be resorted to.”
দেখা যাচ্ছে, খোদ ভারতীয় কর্তৃপক্ষই এনটিপিসি’র ফ্লাই অ্যাশ ব্যাবহারে সন্তুষ্ট নয় এবং ফ্লাই অ্যাশে ৪৮ ধরণের বিষাক্ত ধাতু, তেজস্ক্রিয় উপাদন ইত্যাদির উপস্থিতির অভিযোগটি আমলে নিয়ে কৃষি জমিতে ফ্লাই অ্যাশ ব্যাবহারের বিষয়ে আপত্তি দিয়েছে আর রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ইআইএ রিপোর্টে আমাদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা চলছে ছাই ব্যাবহারে জমির কোন ক্ষতি হবে না, পানি দূষণ হবে না ইত্যাদি বলে!
সুন্দরবনের মধ্যে দিয়ে কয়লা পরিবহনের বিপদ ও মংলা বন্দর প্রসঙ্গে:
রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য সুন্দরবনের মধ্যে দিয়ে কয়লা পরিবহণের ফলে পানি দূষণ, বায়ু দূষণ, শব্দদূষণ, আলো দূষণের বিপদ সম্পর্কে পিডিবি জবাব দিয়েছে:
“বর্তমানে সুন্দরবনের ভিতর যে বিদ্যমান নৌ-পথ দিয়ে জাহাজ, যন্ত্রচালিত নৌযান চলাচল করে সে পথেই কয়লাবাহী জাহাজ চলাচল করবে। আকরাম পয়েন্ট পর্যন্ত সপ্তাহে মাত্র ১টি বা ২টি কয়লাবাহী জাহাজ নোংগর করতে হবে। এ সব জাহাজ চলাচলের সময় দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক আইন ও নিয়ম মেনে চলাচল করে সে নিয়মেই আলোচ্য জাহাজগুলো চলাচল করবে, যা পরিবেশের উপর দৃশ্যমান কোন প্রভাব ফেলবে না ।
EMP তে পদত্ত পদক্ষেপ অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নিলে দৃশ্যমান কোন কয়লার কণা বাতাসে ছড়াবে না বা পানিতে মিশবে না।সেকারণে, কোন কয়লার টুকরা, তেল, আবর্জনা ইত্যাদি পানি দূষিত করবে না।
সুন্দরবনের মোট এলাকা ৪৭৫ বর্গ কিলোমিটার। মালামাল খালাসের কারণে সর্বোচ্চ আনুমানিক এক বর্গ কি.মি. এলাকায় শব্দ দূষণ হতে পারে। EMP যথাযথ ভাবে পালন করলে এর পরিধি আরো কমে যাবে।
সপ্তাহে ১টি বা ২টি জাহাজ আক্রাম পয়েন্ট পর্যন্ত রাতের বেলায় চলাচল করলে এর আলোতে নগণ্য পরিমাণ এলাকার প্রাণী কুলের স্বাচ্ছন্দ বিঘিড়বত হতে পারে। বাস্তুবে বৎসরে ১০টির বেশী জাহাজ আক্রাম পয়েন্টে রাতের বেলায় নোংগর করার পয়োজন হবে না।“
আমাদের জবাব:
প্রথমত, সুন্দরবনের মতো ইকোলজিক্যালি সেনসিটিভ এলাকায় এক বর্গ কিমি এলাকায় মালামাল খালাসের কারণে সৃষ্ট শব্দ দূষণ গ্রহণ যোগ্য নয়।
দ্বিতীয়ত,আক্রাম পয়েন্টের পাশেই রয়েছে ইউনোস্কো ঘোষিত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট এবং সরকার ঘোষিত বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য।এরকম স্পর্শকাতার এলাকায় রাতের বেলা জাহাজ চলাচল এবং মালামালা খালাসের ফেলে সৃষ্ট শব্দ ও আলো দূষণে ‘নগন্য পরিমাণ এলাকার প্রাণী কুলের স্বাচ্ছন্দ বিঘ্ন’ করাও কাম্য নয়।
তৃতীয়ত,সুন্দরবনের ভিতর বিদ্যমান নৌ-পথ দিয়ে জাহাজ যন্ত্রচালিত নৌযান চলাচল করে সুন্দরবনের পরিবেশ ধ্বংস করছে বলেই এই পথ দিয়ে কয়লার জাহাজ চলাচল জায়েজ হয়ে যায় না, বরং ঐসব জাহাজ চলাচলও বন্ধ করে দেয়া দরকার।কারণ মংলা বন্দর চালু রাখতে হলে যে সুন্দরবনের মধ্য দিয়েই জাহাজ চলাচল করতে হবে এরকম কোন কথা নাই। মংলা বন্দর অভিমুখী জাহাজ কিছু দিন আগেও তো সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে চলাচল করতো না! ২০১১ সালের নভেম্বর মাসের আগ পর্যন্ত খুলনা হয়ে মংলা বন্দরের দিকে জাহাজগুলো ঘসিয়াখালী খাল দিয়ে আসা যাওয়া করত। এই খালটি ভরাট হয়ে যাওয়ায় এবং ভরাট হয়ে যাওয়া খালটি সময় মতো ড্রেজিং না করায় ২০১১ সালের নভেম্বর থেকে বিআইডব্লিইউটিএ সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে সন্ন্যাসী-রায়েন্দা-বগী-শরণখোলা-দুধমুখী-হরিণটানা-আন্ধারমানিক-মুগমারী-চাঁদপাই-জয়মণিরগোল হয়ে মংলা বন্দরে যাওয়ার অনুমতি দেয়।
ছবি: মংলার পথে পুরাতন নদী পথ (নীল) এবং সুন্দরবনের মধ্যে দিয়ে নতুন নদী পথ(লাল), সূত্র: প্রথম আলো।
এবং এই ভাবে ঘাসিয়াখালী খালের বদলে সুন্দরবনের মধ্যে দিয়ে জাহাজ চলাচলের কারণে ইতিমধ্যেই সুন্দরবনে পরিবেশ বিপর্যয় শুরু হয়েছে। গত ১৫ই মার্চ ২০১৩ প্রথম আলো লিখেছে:
“যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক বন্য প্রাণীবিষয়ক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির বাংলাদেশ স্তন্যপায়ী প্রাণী প্রকল্পের আওতায় সুন্দরবনের ভেতরের নৌপথের প্রভাব নিয়ে একটি গবেষণা চলছে। তাতে দেখা গেছে, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে প্রতিদিন ১৫০ থেকে ১৬০টি নৌযান চলে। এতে বনের নদীগুলোতে ঢেউয়ের গতি ও উচ্চতা বেড়ে গেছে। ফলে বনের দুই পাড়ে ভাঙন দেখা দিয়েছে। চাঁদপাই, নন্দবালা, জয়মনি, তাম্বুলুবুনিয়াসহ বিস্তীর্ণ এলাকায় গাছের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। গাছগুলো মরতে শুরু করেছে। পাড় ভাঙনের ফলে চাঁদপাই বনফাঁড়িটির অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে।
জানা গেছে, বনের যেখানে-সেখানে জাহাজ নোঙর করা হচ্ছে। ওই জাহাজে সুন্দরবনের জন্য ক্ষতিকর কোনো বস্তু আছে কি না, তা কেউ তদারক করছেন না। যাঁরা নোঙর করে অবস্থান করছেন, তাঁরা বনের মধ্যে বর্জ্য তেল ফেলছেন কি না, বা তাঁদের ফেলে যাওয়া কোনো পদার্থের কারণে বনের কোনো ক্ষতি হচ্ছে কি না, তা-ও দেখভালের কেউ নেই। ”
ছবি: সুন্দরবনের মধ্যে দিয়ে জাহাজ চলাচলের ফলাফল, প্রথম আলো, ১৫ ই মার্চ ২০১৩।
এই অবস্থায় কয়লা ভর্তি জাহাজ চলাচল করলে যে দূষণ আরো বাড়বে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তাছাড়া কয়লা পরিবহনের জন্য সুন্দরবনের মধ্যে কোল টার্নিমাল আরেক বিপদ হিসেবে কাজ করবে।
ছবি: কয়লা লোড করার সময় কয়লার গুড়ার ধুলায় চারপাশ অন্ধকার হওয়ার এই ছবিটি কানাডার বন্দর থেকে তোলা
কাজেই সুন্দরবনের মধ্যে দিয়ে মংলাবন্দর অভিমুখে বর্তমান জাহাজ চলাচলকে অযুহাত হিসেবে ব্যাবহার করে রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য কয়লা জাহাজ চলাচলের যৌক্তিকতা আরোপের চেষ্টার বদলে ঘাসিয়াখালী খালের ৮ কিমি পুর্ন খনন করে সাধারণ কার্গো জাহাজগুলোর দূষণের হাত থেকে সুন্দরবনকে রক্ষা করতে হবে।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে দেখা যায়,মূল ইআইএ রিপোর্টের মতোই সংশোধিত ইআইএ রিপোর্ট এবং পিডিবির জবাবের মধ্যেও যে কোন মূল্যে সুন্দরবনের পাশে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন জায়েজ করার জন্য ভুল মানদন্ড ব্যাবহার,ক্ষতিকর প্রভাব কমিয়ে দেখানো,কোন কোন ক্ষেত্রে ক্ষতির মাত্রার কোন পর্যালোচানাই না করা,ক্ষতির মাত্রাকে হালকা ভাবে উপস্থান, ফাপা আশ্বাস প্রদান ইত্যাদি প্রবণতা স্পষ্ট।