?> রামপাল থেকে রূপপুরঃ সেবা থেকে ব্যবসা « NCBD – National Committee of Bangladesh

Thursday, September 12th, 2013

রামপাল থেকে রূপপুরঃ সেবা থেকে ব্যবসা

বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতের ‘নৈরাজ্য সংবাদ’ অতি চিপড়ানো এক লেবু। এ নিয়ে গত এক দশকে যত আলাপ-আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে অন্য কোন একক বিষয়ে তা হয়নি। হাওয়া ভবন থেকে খাম্বা-খুঁটির ব্যবসা কিংবা ফার্নিচার কোম্পানী থেকে তুখোড় বিদ্যুৎ বণিকে রূপান্তর অথবা মন্ত্রীর সামান্য পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের হঠাৎ করে বিদ্যুৎ সেক্টরে মাফিয়া ডন বনে যাওয়ার গল্প নিয়ে তুবড়ি ছোটানো টক‌্ শো আর রোমাঞ্চকর পত্রিকার রিপোর্ট আমরা কম দেখিনি। খাম্বা-খুঁটির হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির কথা তুলে এ সরকার আমাদের ঘাড়ে চেপে বসলেও আমরা এর বিচার পাইনি। নেতা-নেত্রীদের কথার ভাঁড়ামো দেখেছি কাজের কাজ দেখিনি। আবার কুইক রেন্টালের লুটের মেশিনে ভর্তুকির টাকায় ভূঁইফোড় ব্যবসায়িদের আঙ্গুল ফুলে বটগাছ হয়ে গেলেও এর পক্ষে দোসরদের তাবেদারির কমতি দেখিনি। ধান ছিটালে যেমন কাকের অভাব হয় না তেমনি হাজার কোটি টাকার কুইক প্রফিট থেকে কিছু দান-দক্ষিণা ছড়ালে এদেশে চাটুকারেরও কমতি থাকে না। নগদ নারায়ণ পকেটে পড়ায় এদের চোখে শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনটাই বড় হয়ে ধরা দেয়, বিনিময় মূল্যটার দিকে এরা ফিরেও তাকায় না। তাই বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত এখন ক্ষমতাবান রাক্ষসদের রঙ্গমঞ্চ। এখানে আমরা উন্নয়নের পাপেট-শো দেখছি, লুটের ভাগ নিতে আসা বিদেশীদের সাথে দোস্তি পাতানোর গল্প দেখছি। এখানে আরো আছে স্বপ্নের সুড়সুড়ি, ডিজিটাল মাস্তি, সেই সাথে দেশপ্রেমের কিস্তি। আর পর্দার আড়ালে চলছে জন-জীবন-পরিবেশ ধ্বংস করা লুটপাটের দেন দরবারী। ‘দৃশ্যমান’ উন্নতিতে সাময়িক বিদ্যুৎ হয়তো পাওয়া যাবে কিন্তু হয়ে যাওয়া ‘অদৃশ্যমান’ ক্ষতি পোষাবে না কয়েক জনমে’ও।

সরকারের ধারাবাহিক নীতি বাস্তবায়নের ফলে বিদ্যুৎ খাত ধীরে ধীরে বেসরকারীকরণ হয়ে যাচ্ছে। সরকারী বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো ধারাবাহিকভাবে সুলভ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে গেলেও বেসরকারী কেন্দ্রগুলোর খরচ মেটাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। পাবলিক সেক্টরে বিদ্যুৎ উৎপাদন ৩ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও প্রাইভেট সেক্টর থেকে বিদ্যুৎ কিনতে খরচ হচ্ছে ইউনিট প্রতি ১৩ থেকে ১৮ টাকা, কোন কোন ক্ষেত্রে ৩৭৩ টাকা! অত্যাবশ্যকীয় অন্যান্য খাত হতে বাজেট কাট-ছাট করে ভর্তুকির টাকা গেলানো হচ্ছে বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীদের। এই সেক্টরে সর্বগ্রাসী রোগ দেখা দিয়েছে। আর এর নতুন উপসর্গ হিসেবে যোগ হয়েছে ১৩২০ মেগাওয়াট রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প আর ২ হাজার মেগাওয়াট রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্প।

সুন্দরবন থেকে মাত্র ৯ কিলোমিটার দূরে হতে যাচ্ছে বিশাল রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প। এই রাক্ষুসে প্রকল্পের প্রথম শিকার হয়েছেন স্থানীয় ৪ হাজার পরিবার। তথাকথিত উন্নয়নের বলি হিসেবে হারাতে হচ্ছে লক্ষ টন ধান আর মাছের উৎপাদন। এর পরবর্তী নিশ্চিত শিকার হতে যাচ্ছে আমাদের অহংকারের সুন্দরবন। সকল ঝড়-ঝঞ্জা-দূর্বিপাক থেকে আমাদের একমাত্র রক্ষাকবচ সুন্দরবনের সুরক্ষার দিকটি বাদ দিলেও এখান থেকে প্রাপ্ত বিদ্যুৎ কতটুকু সুলভে ব্যবহার করতে পারব তা নিয়েও আছে চরম অনিশ্চয়তা। রামপাল কেন্দ্রের বিদ্যুৎ মূল্য নির্ধারণ করবে ভারত এবং তা কোনভাবেই ৮ টাকার কম হবে না। উপরন্তু রিভিউ কমিটির পরামর্শে বছর বছর এর দাম কেবলই বাড়বে। অর্থাৎ এটা কোনভাবেই কুইক রেন্টালের চেয়ে কম ধবংসাত্নক না বরং পরিবেশ অর্থনীতি বিবেচনায় এটা আরও ভয়ংকর। অর্থাৎ আগামী দিনের সরকারী বিদ্যুৎ ‘সেবা’ও বেসরকারী আদলে কিনতে হবে। বিদ্যুতের প্রাচুর্য হয়তো আসছে কিন্তু আমার-আপনার দৈন্যতা একে স্পর্শও করতে পারবে না।

বিদ্যুৎ খাতের আরেক বিপর্যয় নিয়ে আসছে রূপপুর পরমাণু প্রকল্প। রাশিয়ার সাথে করা চুক্তি অনুযায়ী ২০২২ সালের মধ্যেই গ্রীডে আসার কথা ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। যে কোন সময় মারাত্মক দূর্ঘটনা ঘটে যাবার শঙ্কা ছাড়াও বিশাল প্রারম্ভিক ব্যয়, নিয়ত তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানোর ঝুকি, সন্ত্রাসী হামলার আশংকা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যয় আর সর্বোপরি সামগ্রিক চক্র বিবেচনায় উচ্চমূল্যের বিদ্যুতের কারণে ইতালী, বেলজিয়াম, জার্মানীর মত আধুনিক রাষ্ট্র যখন পরমাণু বিদ্যুৎ পরিত্যাগ করছে ঠিক তখনি রাশিয়ার ব্যবসায়িক কূটকৌশলের জালে বন্দী হয়ে বাংলাদেশ রূপপুরে এ ধবংসাত্নক প্রকল্পটি করতে যাচ্ছে। তুলনামূলক আধুনিক ভিভিইআর-১২০০ কিংবা ভিভিইআর-১৫০০ প্রযুক্তি ব্যবহার না করে ভিভিইআর-১০০০ কেই বলা হচ্ছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। আধুনিককালে নানা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সম্বলিত আপাত ঝুকিহীন ১ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ব্যয় হয় কম করে হলেও ৩৫ হাজার কোটি টাকা যেখানে মোটামুটিভাবে ৭ হাজার কোটি টাকায় প্রচলিত জ্বালানীভিত্তিক সমক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ সম্ভব। এ ধরণের প্রকল্প দীর্ঘদিনের শিক্ষা-গবেষণা-চর্চা আর অবকাঠামোগত উন্নয়নের বিষয়। অথচ জাতীয় নিরাপত্তার বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে প্রকল্পটি তুলে দেয়া হয়েছে রাশিয়ান কোম্পানীর হাতে। অথচ রূপপুর কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় বিপুল পরিমাণ পানি উত্তোলনের ফলে আশেপাশের এলাকায় মরুকরণের শঙ্কা, নিয়ত ছড়ানো তেজস্ক্রিয়তায় কৃষির ক্ষতি আর বিশাল ব্যয়ের অর্থনৈতিক চাপ বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে না। হঠাৎ কোন দূর্ঘটনায় লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর শঙ্কা না হয় হিসেবের বাইরেই থাকল!

পণ্যের বাজারে সামর্থহীনের ক্ষুদার জীবন যেমন অসহায় তেমনি আসছে সব প্রকল্পের উচ্চমূল্যের বিদ্যুৎ ব্যবহার না করতেই আমরা নিরুপায়। বিদ্যুৎ তখন গ্রীডেই থাকবে, বিত্তবানদের ঘরের এসি আর ওয়াশিং মেশিন চলবে কিন্তু আপনার-আমার ঘরের বাতি আর জ্বলবে না।

অথচ অমিত সম্ভাবনার বাংলাদেশ প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ। জ্বালানী ব্যবস্থায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার জন্য একটি রাষ্ট্রের যা যা প্রয়োজন বাংলাদেশে তার কোনটারই কমতি নেই। এ কথা প্রচলিত এবং অপ্রচলিত উভয় প্রকার জ্বালানীর ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য। আমাদের বিস্তীর্ণ সমুদ্র সীমানায় গ্যাস প্রাপ্তির অমিত সম্ভাবনাকে আমরা কাজে লাগাতে পারছি না। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্স-পেট্রোবাংলাকে পঙ্গু করে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে দেশী-বিদেশী লবিস্টদের চাপে সাগরের গ্যাস ব্লক বিভিন্ন বিদেশী কোম্পানীর হাতে তুলে দেবার প্রক্রিয়া ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। আমাদের উত্তরাঞ্চলের বিশাল কয়লার মজুদ সকল প্রভাব বিবেচনায় নিতে জাতীয় পর্যায়ে ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উপযুক্ত ব্যবহারের দিকে না যেয়ে ভূঁইফোড় অনভিজ্ঞ বিদেশী কোম্পানীর হাতে তুলে দেয়া হয়েছে যাদের প্রধান লক্ষ্য পরিবেশ প্রতিবেশের চিন্তা না করে ২ লক্ষ মানুষকে সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করে উন্মুক্ত কয়লা খনি প্রকল্প চালু করে দ্রুত মুনাফা করা।

আমাদের বিশাল পশু সম্পদ আর পোল্ট্রি শিল্প কাজে লাগিয়ে সামান্য অবকাঠামো উন্নয়নে বর্তমান অবস্থাতেই পাওয়া সম্ভব কমপক্ষে ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এছাড়া প্রতিদিন তৈরী হওয়া বর্জ্যের মাধ্যমে বিদ্যুৎ তৈরীর সম্ভাবনা তো রয়েছেই। বাংলাদেশে বছরের প্রায় ৩০০ দিন প্রখর সূর্যালোক থাকে যা বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বিরল। ব্যাটারী বিহীন গ্রীড কানেক্টেড সিস্টেমে মিনিগ্রীড ব্যবস্থার মাধ্যমে অঞ্চলভিত্তিক উপায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জন খুবই সম্ভব। অথচ তা না করে এই সোলার সিস্টেমের ব্যবসা ছেড়ে দেয়া হয়েছে অনভিজ্ঞ-ব্যবসায়িক নীতি বিবর্জিত বিভিন্ন কোম্পানীর হাতে যারা উচ্চমূল্যের ব্যাটারী কেন্দ্রিক ব্যবসায় কোটি কোটি টাকা অযৌক্তিক মুনাফা করছে। আর অন্যদিকে চাপিয়ে দেয়া দাম বৃদ্ধির ফলে সোলার সিস্টেম আশানূরুপ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে না।

বাংলাদেশে সুবিস্তৃত উপকূলীয় অঞ্চলে বাতাসের বেগ সারা বছর জুড়ে গড়ে ৫ মি./সে. যা কিনা বায়ুবিদ্যুত প্রসারে খুবই উপযোগী। অথচ এই সম্ভাবনা কাজে লাগাতে কোন উদ্যোগ নেই। আমাদের দেশে নদীগুলোর বর্তমান প্রবাহতেই শুধুমাত্র কিছু টাকা ব্যয়ে ড্রেজিং করে এবং অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে কোনরূপ বাধ নির্মাণ না করে ‘রান অফ দ্য রিভার’এর মাধ্যমে কম করে হলেও ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সারা বছর ধরে পাওয়া সম্ভব। এতে করে যেমন নদীর নাব্যতা বাড়বে তেমনি নদীগুলো আবার মৎস্য সম্পদে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে। কিন্তু এ ব্যপারে কোন উদ্যোগ নেই, ঠিক যেমনটি উদ্যোগ নেই মাটির নীচের তাপ প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রেও।

যে কোন উপায়ে সংকট জিইয়ে রাখতে পারলেই এদের লাভ। আগে ছিল বিদ্যুৎ উৎপাদনহীনতায় যোগান না দিতে পারার সংকট আর এখন বেসরকারী কেন্দ্রগুলো হতে উচ্চমূল্যের বিদ্যুৎ না কিনতে পারার সংকট। আগে বিদ্যুতের যোগান ছিল সরকারের সেবা আর এখন তা লাভজনক ব্যবসা।

বিদ্যুৎ উৎপাদনের মূলা আমাদের সামনে ঝুলিয়ে পর্দার আড়ালে এরা নিজেদের আখের গুছাচ্ছে। সুন্দরবন ধবংস হলে এদের কী! রূপপুরের দূর্ঘটনা ঘটলেই বা এদের কী! এদের কাছে বাংলাদেশ শুধুই টাকা কামাবার মেশিন। এদের কেউ কেউ তো বিদেশী পাসপোর্টধারী আর সবাই সম্পদ পাচারকারী। কিন্তু আমরা এইসব দেশ বিরোধী চুক্তির বাতিল চাই। সুন্দরবনের পরিচর্যা চাই। রূপপুরের সুরক্ষা চাই। আর সবচেয়ে বড় কথা মানুষের বাংলাদেশে এইসব রক্তপিপাসুদের হাত থেকে চিরদিনের জন্য মুক্তি চাই।