Thursday, August 1st, 2013
সুন্দরবন কার? ভারতের না আমাদের?
বিস্তৃত সুন্দরবনের একাংশ ভারতে থাকলেও বাংলাদেশ অংশে আয়তনের বিশালতায় সুন্দরবনের রয়েছে নিজস্ব পরিচিতি। সুন্দরবন আমাদের অস্তিত্বের সাথে সম্পর্কিত। হাজার বছরের বিবর্তনে পরিণত এই বন কম করে হলেও ৫ লক্ষ মানুষের জীবন-জীবিকার একমাত্র সহায়। সুন্দরবন উঠে এসেছে আমাদের সাহিত্য চর্চায়। বন-বিবি আর পীর গাজীর এই বনের প্রভাব রয়েছে আমাদের অধ্যাত্নিক চেতনায়। আর এই বনের উপরই এবার লোভাতুর দৃষ্টি পড়েছে আমাদের উপর চিরকাল ‘দাদাগিরি’ দেখিয়ে আসা ভারতের।
বাঘ আমাদের অনন্য প্রতীক। পৃথিবীর বিস্ময় এই বেঙ্গল টাইগারের একমাত্র আবাসস্থল আমাদের সুন্দরবন। অসংখ্য প্রজাতির প্রাণী আর উদ্ভিদের প্রাণ প্রাচুর্যে ভরা এই বন খুব একটা শান্তিতে নেই। পৃথিবী জুড়ে বেড়ে চলা উষ্ণতার বিরূপতা একে গ্রাস করছে। এই বনের উপর আমাদের নিত্য আগ্রাসন প্রাকৃতিক রুদ্রতাকেও ছাড়িয়ে গেছে বহু গুণ। বন বিভাগের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে সুন্দরবন এলাকায় গড়ে উঠেছে মাফিয়া রাজত্ব। সেখানে নদীতে বিষ মিশিয়ে মাছ মারা হচ্ছে, ফাঁদ পেতে ধরা হচ্ছে হাজার হাজার হরিণ আর প্রতি বছর অসংখ্য বাঘের বাচ্চা পাচারের ঘটনা আমাদের কারোরই অজানা নয়। এই মাফিয়া চক্র নির্বিচারে কাটছে বনের গাছ। প্রতিবছর বনবিভাগ যত টাকা রাজস্ব আদায় করে তার চেয়েও শত গুণ বেশী চাঁদা আদায় হয় সুন্দরবনের জেলে-মৌয়াল-বাওয়ালী’দের কাছ থেকে। অর্থাৎ সুন্দরবন নানা কারণেই অস্তিত্বের সংকটে আছে। আর এর উপর যদি সুন্দরবন থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প করে ফেলা হয় তবে এ বন যে অচিরেই ছবির ফ্রেমে আশ্রয় নিবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
পৃথিবীতে প্রচলিত জ্বালানী গুলোর মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট হচ্ছে কয়লা। এর ভয়াবহ দূষণ বিবেচনায় ২০০৮ সালে কর্ণাটক রাজ্যের রাজীব গান্ধী ন্যাশনাল পার্কের ২০ কিলোমিটার দূরে ১ হাজার মেগাওয়াটের কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে সরে আসে ভারত। ২০ কিলোমিটার দূরবর্তী জীববৈচিত্র্য সম্পন্ন তাবিন অঞ্চল, ৭০ কিলোমিটার দূরবর্তী তান সাংকারান মেরীণ পার্ক, এমনকি ১০০ কিলোমিটার দূরবর্তী উপকূলীয় অঞ্চলে বিরূপ প্রভাব বিবেচনায় মালয়েশিয়ার সাবাহ ৩০০ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করে দেয়া হয় ২০১১ সালে। অথচ আমাদের সুন্দরবনের উপর কোনরূপ প্রভাব বিচার বিশ্লেষণ না করে ভারতীয় কোম্পানী এনটিপিসি রামপাল প্রকল্প করতে উদ্যোগী হয়। গঠিত হয় যৌথ কোম্পানী। ২৬৪০ মেগাওয়াটের এই বিশাল প্রকল্প থেকে প্রথম পর্যায়ে উৎপাদিত হবে ১৩২০ মেগাওয়াট আর পরবর্তী পর্যায়ে উৎপাদনে আসবে আরও ১৩২০ মেগাওয়াট।
আমাদের বিদ্যুৎ প্রয়োজন। কিন্তু সুন্দরবন তো বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিকল্প হতে পারে না। বাংলাদেশে লুটপাটের আখড়া বিদ্যুৎ ও জ্বালানী খাতের বর্তমান সংকট অনেকাংশেই আরোপিত। রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে অকেজো করে রাখা হয়েছে ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা কুইক প্রফিটকারী কোম্পানী গুলোর জন্য। অথচ মাত্র ১ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগে BMRE পদ্ধতিতে রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ কেন্দ্র গুলোকে মেরামত করলে বর্তমান অবকাঠামোতেই পাওয়া সম্ভব ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট। যেই প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ আমরা পেতে পারতাম মাত্র ৩ টাকায় সেই বিদ্যুৎ আমাদেরকে কিনতে হচ্ছে ১৩ থেকে ১৮ টাকায়। প্রতি বছর ভর্তুকির নামে বিদ্যুৎ খাতে লুটপাটের হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে যার ফলে বঞ্চিত হচ্ছে আমাদের শিক্ষা, চিকিৎসা, গবেষণা সহ অন্যান্য খাত।
রামপাল প্রকল্পের মাধ্যমে বিদ্যুৎ খাতের এই চলমান লুটপাট আর ধ্বংসের পাকে বাধা পড়তে যাচ্ছে আমাদের সুন্দরবন। ইতোমধ্যেই অধিগ্রহণের নামে ১৮৩৪ একর জায়গা জোরপূর্বক দখল করে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধায়নে মাটি ভরাটের কাজ চলছে। এর ফলে ওই এলাকার বছর প্রতি ১২৮৫ টন ধান আর ৫৬৯ মেট্রিক টন ধানের উৎপাদন এরই মাঝে বন্ধ হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু হলে আশেপাশের এলাকার ২ লক্ষ টন ফসল আর ৫ হাজার মেট্রিক টন মাছের উৎপাদনও বন্ধ হয়ে যাবে সে ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ মহল নিশ্চিত আশংকা প্রকাশ করেছেন।
রামপাল প্রকল্পে ভারত সংশ্লিষ্টতার প্রক্রিয়াও চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। এ প্রকল্পে ভারত বিনিয়োগ করবে মাত্র ১৫ শতাংশ। ৭০ শতাংশ ভারতেরই কোন ব্যাংক হতে উচ্চসুদে ঋণ করা হবে বলে ধারণ করা হচ্ছে। এখানে ভারত মূলধনী যন্ত্রপাতির ব্যবসা করবে, কন্সালটেন্সি ফি কামাবে, কর অবকাশ সুবিধা পাবে, উৎপাদিত বিদ্যুৎ ভারত নির্ধারিত দামেই আমাদের কিনতে হবে। কিন্তু প্রকল্প মুনাফা আবার সমানভাগেই ভাগ হবে।
রামপাল প্রকল্প যে সুন্দরবনের নিশ্চিত মৃত্যু নিয়ে আসছে এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ মহল শতভাগ নিশ্চিত। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আব্দুস সাত্তার মন্ডল এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ হারুণ চৌধুরী তাদের নিজ নিজ গবেষণা প্রবন্ধে এ ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে তাদের বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন। তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবি সমিতি (বেলা) সহ বিভিন্ন সংগঠন এ ব্যাপারে তাদের আশংকার কথা তুলে ধরেছেন। অথচ বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার পংকজ শরণ সুন্দরবনের উপর রামপাল প্রকল্পের বিরূপ প্রভাবের শংকাকে ‘গুজব’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ বাংলাদেশের সচেতন বিশেষজ্ঞ মহলের গবেষণা, দেশের স্বার্থ ও পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে বহুদিন ধরে যুক্ত বিভিন্ন সংগঠনের আশংকা ভারত নিতান্তই ‘গুজব’ বলে মনে করে। নীতি বিবর্জিত ব্যবসায়িক স্বার্থসিদ্ধি আর আধিপত্যবাদের কোন পর্যায়ে গেলে বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের ছাত্র-শিক্ষক-জনতার গবেষণা আর আশংকাকে ‘গুজব’ বলে উড়িয়ে দেয়া যায় তা ভাবতেই গায়ে শিহরণ জাগে।
দৈনিক ইত্তেফাকের নিউজ লিংক <http://www.ittefaq.com.bd/index.php?ref=MjBfMDJfMDFfMTNfMV8xXzFfMTU3MTU%3D>
ভারত যদি এতই নিঃসন্দেহ হয় যে, সুন্দরবনের উপর এই বিশাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কোন প্রভাব পড়বে না তবে কেন তারা তাদের সুন্দরবন অংশের আশেপাশে এটা করছে না? কেন বাংলাদেশের সুন্দরবন অংশের কাছেই তাদের এটা করতে হবে? এটা যেহেতু যৌথ বিনিয়োগের ব্যবসা তবে উৎপাদিত বিদ্যুৎ তো আমরা ভারতের অংশে স্থাপিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে সহজেই কিনে নিতে পারি- এতে সমস্যা কোথায়? এতে বাধার প্রাচীর তুলে দাঁড়িয়ে আছে ভারতের আইন। তাতে স্পষ্ট করে বলা আছে, ভারতের জীব-বৈচিত্র্য সম্পন্ন কোন অঞ্চলের ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে কোন বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা যাবে না। তাই ভারতীয় কোম্পানী সুন্দরবন ধ্বংসকারী রামপাল প্রকল্প খুব সহজেই এখানে করে ফেললেও ভারতের নিজের অংশে তা করার কথা চিন্তাও করতে পারত না। তাই মনে প্রশ্ন জাগে, খুলনা-সাতক্ষীরা-বাগেরহাট অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত সুন্দরবন আসলে কার? ভারতের না বাংলাদেশের?
ভারতকে আমরা বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্র হিসেবেই পাশে পেতে চাই। আমাদের হাজার বছরের বন্ধু বৎস্যল বাঙ্গালীয়ানায় আমরা আমাদের বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে অপেক্ষা করছি। কিন্তু ভারতের কাছ থেকে আমরা বন্ধুর ভালবাসা পাইনি, পেয়েছি জোতদার সুলভ আগ্রাসন আর জমিদার সুলভ শোষণ। সীমান্তে তারা আমাদের হত্যা করে হাজারে হাজারে। ফেলানীকে মেরে ঝুলিয়ে রাখে কাটাতারে। বিবস্ত্র করে পিটিয়ে ভিডিও ছেড়ে দেয় অনলাইনে। নদীর পানির ন্যায্য ভাগ আমাদেরকে না দিয়ে জমির ফলন ধবংস করে, নষ্ট করে মাছের উৎপাদন। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে আমাদের বাজার দখল করে। তিতাস নদী ভরাট করে ভারতীয় মালামাল পরিবহনের জন্য তৈরী করে এপার-ওপার রাস্তা আর এসবের বিরুদ্ধে কথা বললেই সমতা সুলভ আচরণ না করে বড় ভাই সুলভ চোখ রাঙ্গানী দেয়।
ভারতের কারণে আমাদের বহু নিজস্বতাই আজ বিলীন হতে চলেছে। এখন ভারতের চোখ পড়েছে আমাদের অহংকারের সুন্দরবনের উপর। ভারতের পরিকল্পিত আগ্রাসন আর আমাদের শাসকগোষ্টীর যোগসাজশে অচিরেই বিলীন হয়ে যাবে আমাদের একান্ত নিজস্ব- পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন।
সুন্দরবন এখন তাই ভারতের ভয়ে কাঁপছে আর বন হারানোর ভয়ে কাঁপছি আমরাও।
অবশিষ্টঃ ভারতের ক্রমাগত আগ্রাসনের এই ভয়কে জয় করার সময় এসেছে। উন্নয়নের মূলা ঝুলিয়ে ভারতীয় স্বার্থসিদ্ধির রামপাল প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশের সুন্দরবন ধ্বংস করার চক্রান্ত রুখতে হবে এখনই। সুন্দরবনকে রক্ষার আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আরেকটি মুক্তি অর্জনের সময়ও এখনই।