Sunday, April 7th, 2013
এশিয়া এনার্জির উন্মুক্ত কয়লা খনন: এবার টার্গেট বিরামপুর
উন্মুক্ত কয়লা খননের জন্য ফুলবাড়িতে কোন ভাবেই সুবিধা করতে না পেরে এশিয়া এনার্জি এবার পার্শ্ববর্তী উপজেলা বিরামপুরকে টার্গেট করেছে। এজন্য এশিয়া এনার্জি ও তার দালালরা প্রচার করছে প্রস্তাবিত ফুলবাড়ি উন্মুক্ত কয়লা খনি হলে বিরামপুরের নাকি তেমন ক্ষতি হবে না, ফুলবাড়ি শহর পুরোটা ধ্বংস হলেও বিরামপুর উপজেলা সদর অক্ষত থাকবে, সেই সাথে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। ফলে ফুলবাড়ি জিরো হলে নাকি বিরামপুর হিরো হবে! এভাবে বিরামপুর উন্নয়ণের মিথ্যা প্রচারণার মাধ্যমে বিরামপুরবাসীকে বিভ্রন্ত করে উন্মুক্ত খনির পক্ষে টানার অপতৎপরতা চালাচ্ছে এশিয়া এনার্জি ও তার দালালরা। আমরা ব্রিটিশ ইস্ট কোম্পানির স্টাইলে স্থানীয় জনগণের মধ্যে এশিয়া এনার্জির এই বিভেদ সৃষ্টির তৎপরতার নিন্দা জানাই।
প্রথমত, নামে ফুলবাড়ি কয়লা খনন প্রকল্প হলেও এশিয়া এনার্জির প্রস্তাবিত উন্মুক্ত কয়লা খনিটি বাস্তবে চারটি উপজেলা জুড়ে অবস্থিত; কয়লা খনিটির ৩৪.৬ শতাংশ ফুলবাড়ি, ২৬.৬ শতাংশ বিরামপুর, ২৫.১ শতাংশ নওবাগঞ্জ এবং ১৩.৭ শতাংশ পার্বতীপুর উপজেলায় পড়েছে। মোট ৫১৯২ হেক্টর কয়লা খনির ১৩৭৯ হেক্টরই বিরামপুর উপজেলার খানপুর ইউনিয়নের অন্তর্গত। এশিয়া এনার্জির হিসাব অনুসারে উন্মুক্ত কয়লা খননের ফলে যত মানুষ নিজ বসতি থেকে উচ্ছেদ হবে তার ১৭ শতাংশই উচ্ছেদ হবে বিরামপুর উপজেলা থেকে। এছাড়া বিরামপুরের ৩১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ৪০টি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ১৭৬ টি কবরস্থান ধ্বংস হবে। (সূত্র: এশিয়া এনার্জির পুনর্বাসন পরিকল্পনা, অধ্যায় ৪) এশিয়া এনার্জির পরিকল্পনা অনুসারে ফুলবাড়ি থেকে উন্মুক্ত খনন কার্যক্রম শুরু হয়ে পর্যায় ক্রমে বিরামপুরের দিকে অগ্রসর হবে; খনির প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে ফুলবাড়ি ও পার্বতিপুরে উন্মুক্ত খনন করা হলেও তৃতীয় পর্যায়ে এসে বিরামপুরের ১টি গ্রাম, পঞ্চম পর্যায়ে ৭টি গ্রাম এবং ৬ষ্ঠ পর্যায়ে আরো ১৬টি গ্রাম পুরোপুরি ধ্বংস করা হবে।(সূত্র: এশিয়া এনার্জির পুনর্বাসন পরিকল্পনা, অধ্যায় ১২)
দ্বিতীয়ত, ফুলবাড়ি-বিরামপুর-নওয়াবগঞ্জ-পার্বতীপুর এলাকায় অবস্থিত এই কয়লার ঠিক উপরেই রয়েছে পানির বিশাল স্তর। উন্মুক্ত খনন করে কয়লা উত্তোলণ করতে হলে কয়লার উপরের স্তরকে পানি শূন্য করতে হবে। আর কয়লা খনির উপরের পানি পাম্প করে সরিয়ে নিলে চারপাশের এলাকা থেকে পানি আসতে থাকবে সেজন্য চারপাশের বিশাল এলাকা পানিশূন্য না করে কয়লা খনির উপরের স্তর পানি শূন্য করা সম্ভব হবে না। এ জন্য পাম্পের মাধ্যমে প্রতিদিন ৮০ কোটি লিটার পানি সরিয়ে ফেলতে হবে। এর ফলে শুধু কয়লা খনি এলাকাই নয় আশপাশের বিশাল এলাকা পানি শূন্য হয়ে মরুভূমিতে পরিণত হবে। সরকারের গঠন করা কয়লা উত্তোলণ পদ্ধতি সম্পর্কিত মোশারফ হোসেন কমিটির সাম্প্রতিক রিপোর্টেও বিষয়টি স্বীকার করে বলা হয়েছে- এর ফলে চারপাশের অন্তত ৫৬ কিমি এলাকার পানি স্তর নীচের নেমে যাবে যার মধ্যে ২৭ কিমি পর্যন্ত এলাকার টিউবয়েল, ডিপ টিউবওয়েল, শ্যালো মেশিন এ পানি উঠবে না, সেচের পানি পাওয়া যাবে না, কৃষি ও মৎসচাষ অসম্ভব হয়ে পড়বে(পৃষ্ঠা ৫১)। বিরামপুর উপজেলা সদর কয়লা খনির কেন্দ্র থেকে ১০ কিমি দূরত্বের মধ্যে অবস্থিত হওয়ায় আশপাশের এলাকার মতো উপজেলা সদরও পানিশূন্য হয়ে বসবাস অনুপযোগী হয়ে যাবে।
তৃতীয়ত, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে ১ টন কয়লা উত্তোলণ করতে গিয়ে ২৫ টন মাটি উত্তোলণ করতে হয়। উত্তোলিত মাটিতে থাকা বিভিন্ন বিষাক্ত খনিজ পদার্থ বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে আশপাশের পানি দূষিত করে। প্রস্তাবিত ফুলবাড়ি কয়লা খনি এলাকায় মাটির নীচে সালফারের পরিমাণ ২% থেকে ৮% এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে ২০% হওয়ায় উত্তোলিত মাটিতে থাকা সালফার যৌগ বাতাস ও পানির সাথে বিক্রিয়া করে এসিড তৈরী হবে যাকে এসিড মাইন ড্রেনেজ বলা হয়। এই এসিড মিশ্রিত পানিতে তামা, সিসা, পারদ ইত্যাদি বিষাক্ত ভারী ধাতু মিশে গোটা এলাকার মাটির নীচের ও মাটির উপরের পানি দূষিত করে ফেলবে যা এশিয়া এনার্জির পরিবেশগত সমীক্ষা(ভলিউম ৩ পার্ট ২ সেকশন ৫) এবং সরকারের গঠিত কমিটির রিপোর্টেও(পৃষ্ঠা ৪৯) স্বীকার করা হয়েছে । এই এসিড মাইন ড্রেনেজ এর ফলে কয়লা খনির আশপাশের একটা বিশাল এলাকার পরিবেশ দূষিত হবে যার মধ্যে কয়লা খনি থেকে মাত্র ১০ কিমি সীমার মধ্যে থাকা বিরামপুর উপজেলা সদরও পরে।
চর্তুথত, উন্মুক্ত কয়লা খননের ফলে লাখ লাখ মানুষ উচ্ছেদ এবং লাখ লাখ কর্মসংস্থান ধ্বংস হবে। বিনিময়ে কয়লা খনিতে কর্মসংস্থান হবে এশিয়ার এনার্জির হিসাব অনুসারেই ১২০০ থেকে ১৩০০ যার মধ্য থেকে উচ্ছেদ হওয়া মানুষের জন্য বরাদ্দ থাকবে মাত্র ১০০ থেকে ১৫০ টি! অনুমান করা কঠিন নয় এর মধ্যে থেকে বিরামপুর বাসীর ভাগ্যে কয়টি জুটবে। এছাড়া পরোক্ষ ভাবে রাস্তা ঘাট নির্মাণ সহ বিভিন্ন নির্মাণ কাজের জন্য ফুলবাড়ি বিরামপুর নওয়াবগঞ্জ পার্বতীপুর এলাকায় মোট ৩৫০০ থেকে ৩৭০০ কর্মসংস্থান তৈরী হওয়ার কথা বলা হলেও তা হবে সাময়িক এবং ধ্বংস হওয়া কর্মসংস্থানের তুলায় খুবই সামান্য। এশিয়া এনার্জির পরিকল্পনায় পরোক্ষ ভাবে বিদ্যমান দোকানদারি, দর্জিগিরি ইত্যাদি খাত সম্প্রসারিত হয়ে ৬০০০-৬৫০০ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার কথা বলা হলেও এটা ভাওতাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয় কারণ উন্মুক্ত কয়লা খননের ফলে যেখানে লাখ লাখ মানুষ উচ্ছেদ হবে সেখানে ব্যাবসা সম্প্রসারিত নয় বরং আরো সংকুচিতই হওয়াই স্বাভাবিক। (সূত্র: এশিয়া এনার্জির পুনর্বাসন পরিকল্পনা, অধ্যায় ১০)
পঞ্চমত, কয়লা খনির বিরামপুর অংশটুকু থেকে কয়লা্ উত্তোলণ শেষে এর বেশির ভাগটাই লেক এ পরিণত করা হবে। লেকের আয়তন হবে ৮১৭ হেক্টর, গভীরতা ২৫০ মিটার। (সূত্র: এশিয়া এনার্জির পরিবেশ সমীক্ষা, ভলিউম ২ , সেকশন ৫)
ষষ্ঠত, উন্মুক্ত কয়লা খনন করতে গিয়ে বিরামপুর-নওয়াবগঞ্জ সীমান্ত বারাবর প্রবাহিত খড়ি পুল নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে আরো পূর্ব দিকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে যার ফলে ভূমিক্ষয়, পলিপাতন বৃদ্ধি সহ জলজ বাস্তুসংস্থান ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে।( সূত্র: এশিয়া এনার্জির পরিবেশ সমীক্ষা, ভলিউম ১, অধ্যায় ৭)
কাজেই উন্মুক্ত কয়লা খননের ফলে শুধু ফুলবাড়ি উপজেলা ধ্বংস প্রাপ্ত হলেও বিরামপুর অক্ষত থাকবে এবং বিরামপুরের উন্নয়ণ হবে- এই রকম বক্তব্যের পেছনে কোন সত্যতা নেই। বরং এশিয়া এনার্জি প্রস্তাবিত উন্মুক্ত কয়লা খনি প্রকল্পের একটি বড় অংশ জুড়ে বিরামপুর অবস্থিত থাকায় উন্মুক্ত কয়লা খননের ফলে বিরামপুর উপজেলা প্রত্যক্ষ ভাবে ফুলবাড়ির মতোই ক্ষতিগ্রস্থ হবে। বস্তুত, উন্মুক্ত কয়লা খননের ফলে বসতি উচ্ছেদ, কৃষিজমি-নদী-জলাভূমি ধ্বংস, মরুকরণের মারত্মক ক্ষতিকর প্রভাব শুধু ফুলবাড়ি-বিরামপুর-নওয়াবগঞ্জ-পার্বতীপুরেই না, দিনাজপুর সহ গোটা উত্তরবঙ্গের জীবন-জীবিকা কৃষি ও পরিবেশের উপর পরবে।