?> রামপাল ও ফুলবাড়ির সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বিষয়ে সংবাদ সন্মেলন « NCBD – National Committee of Bangladesh

Sunday, March 10th, 2013

রামপাল ও ফুলবাড়ির সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বিষয়ে সংবাদ সন্মেলন

গত ৯ মার্চ ২০১৩ সকাল ১১টায় রামপাল ও ফুলবাড়ি পরিস্থিতি বিষয়ে জাতীয় কমিটির সংবাদ সন্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সংবাদ সন্মেলনের শুরুতে জাতীয় কমিটির নারায়ণগঞ্জ শাখার আহবায়ক রফিউর রাব্বি’র ছেলে তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে এবং শোক ও সংহতি প্রকাশ করে দাড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। সংবাদ সন্মেলনে দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতির বিবেচনায় ৯-১১ মার্চ পূর্ব ঘোষিত খুলনা-রামপাল লংমার্চ কর্মসূচী স্থগিত করবার সিদ্ধান্ত জানানো হয়।তবে যেসব দাবীতে এই কর্মসূচীর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিলো সেগুলোর ভিত্তিতে ৯ মার্চ খুলনা ও বাগেরহাটে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল অনুষ্ঠিত হওয়ার কর্মসূচীর কথা জানানো হয়।সংবাদ সন্মেলনের বক্তব্য এখানে তুলে ধরা হলো:

রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র:

গত ৩-৫ মার্চ ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশ সফর করেন।তিনি ঢাকায় প্রদত্ত বক্তব্যে সুন্দরবন রক্ষায় দুই দেশের যৌথ ভূমিকার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখছি, দুই দেশের সরকার যৌথভাবে ভারতীয় একটি কোম্পানির মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা নিশ্চিত করতে ও দেশি কিছু সুবিধাভোগীর স্বার্থে রামপাল বিদ্যুৎ প্লান্টের মাধ্যমে বরং সুন্দরবন ধ্বংসের আয়োজন করছেন।

উপরন্তু ভারতীয় কোম্পানির জন্য সুবিধা বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। সম্প্রতি সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, ভারতের কোম্পানি এনটিপিসি ‘রামপালের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পাওয়া নিজেদের মুনাফার সম্পূর্ণ অংশই বাংলাদেশ সরকারকে কর না দিয়ে দেশে নিতে পারবে।…কোনো বিদেশি কোম্পানিকে এ ধরনের কর রেয়াত দেওয়ার ঘটনা এই প্রথম।’ (প্রথম আলো, ৮.৩.১৩)

আমরা বারবার বলেছি, বাংলাদেশের স্বার্থ নিশ্চিত করে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্লান্টের সমস্যা কমিয়ে অন্য কোনো উপযুক্ত স্থানে যথাযথ প্রক্রিয়ায় তা স্থাপন করা যেতে পারে। কিন্তু সুন্দরবনকে ধ্বংস করে, সম্পূর্ণ বে-আইনি, অস্বচ্ছ ও জবরদস্তিমূলক প্রক্রিয়ায় দেশের স্বার্থবিরোধী এই প্রকল্প দেশবাসী মেনে নেবে না। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ভারতীয় কোম্পানির লাভ হবে, কিন্তু আমাদের সর্বশেষ প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা বর্ম ও বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন ধ্বংস হবে, অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ বিপর্যস্ত হবে, বিদ্যুৎ সমস্যারও কোনো টেকসই সমাধান হবে না। ইতিমধ্যে অনেক বিশেষজ্ঞ, পরিবেশ সংগঠনও এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে মত দিয়েছেন। সকল যুক্তি-তথ্য অগ্রাহ্য করে সরকার যেভাবে এই জাতীয় স্বার্থবিরোধী প্রকল্প নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে তা প্রতিরোধ না করলে বাংলাদেশ এক ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হবে। এটি একটি জাতীয় হুমকি, সুতরাং এর বিরুদ্ধে জাতীয়ভাবে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ আরও বিস্তৃত করতে দেশবাসীর প্রতি আমরা আহ্বান জানাই। সুন্দরবনের পক্ষে সম্প্রতি লক্ষ লক্ষ তরুণ ভোট দিয়েছেন। আমরা আশা করি, সুন্দরবন ধ্বংসের বিরুদ্ধে তাঁরাও এই প্রতিরোধে যোগ দেবেন।

ফুলবাড়ি পরিস্থিতি

গত ৬ মার্চ ঢাকায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ‘উন্মুক্ত খনির পক্ষে সরকার সিদ্ধান্ত দেবে’ বলে জানিয়েছেন। একদিকে সরকার বিশেষজ্ঞ কমিটির মতামত অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবে বলছেন, অন্যদিকে বহুদিন থেকে বিশেষজ্ঞ-মত উপেক্ষা করে অর্থমন্ত্রী উন্মুক্ত খনির পক্ষে ওকালতি করে আসছেন। বেআইনিভাবে এশিয়া এনার্জি নামে একটি ভুইফোঁড় কোম্পানি যখন বিশেষজ্ঞ ও জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্প নিয়ে দেশে ও বিদেশে নানা চক্রান্তে লিপ্ত তখন অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে আমরা নির্দোষ ‘উত্তোলন পদ্ধতি’ বিষয়ক বক্তব্য হিসেবে দেখতে পারি না। স্পষ্টতই এই বক্তব্য বাংলাদেশের কয়লাসম্পদ নিয়ে বেআইনিভাবে ঐ কোম্পানির আর্থিক জালিয়াতিপূর্ণ শেয়ার ব্যবসা এবং তাদের ধ্বংসাত্মক প্রকল্পকে সহায়তা করবার উদ্দেশ্যে প্রদত্ত। প্রধানমন্ত্রী এই প্রকল্প বাতিলের জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ, সরকার গঠিত তিনটি বিশেষজ্ঞ কমিটি এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে মত দিয়েছে, জনগণ জীবন দিয়েছেন এবং এখনও তাঁদের প্রতিরোধ জারি রেখেছেন। এইরকম একটি প্রকল্পের পক্ষে কোম্পানি দুর্নীতির লোভ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক ভীতি প্রদর্শন, দেশের মধ্যে তারকা লবিস্ট নিয়োগসহ নানাভাবে অপচেষ্টায় লিপ্ত আছে। অর্থমন্ত্রী নিজেকে এর শরিক হিসেবে প্রমাণ করলেন।

ফুলবাড়িসহ ছয় থানার জনগণ ২০০৬ সাল থেকে প্রতিরোধের প্রাচীর গড়েছেন, তাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আমরা আগামী ২৯ মার্চের মধ্যে এশিয়া এনার্জির সকল অপতৎপরতা বন্ধ ও তার বহিষ্কার, সকল চিহ্ন অপসারণসহ ফুলবাড়ী চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের দাবি জানাচ্ছি।

জাতীয় স্বার্থ বিরোধী তৎপরতা

জাতীয় কমিটি গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট সমাধানে বারবার সঠিক পথের বিশদ প্রস্তাব দেয়া সত্ত্বেও গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট সমাধানের নামে সরকার প্রথম থেকেই জনস্বার্থ বিবেচনায় না নিয়ে কিছু দেশি-বিদেশি গোষ্ঠীর স্বার্থে পরিচালিত হওয়ায় দেশের জন্য একের পর এক বিপদ তৈরি করছেন। রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ প্লান্ট মেরামত করলে পাওয়া যেতো ১৭শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। সেটা না করে ৮ গুণ বেশি দামে তার থেকে কম বিদ্যুৎ পাবার জন্য রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের ফাঁদে দেশকে ফেলে ভয়াবহ ঋণের বোঝা তৈরি করেছে সরকার। গ্যাস সংকট চলছে, কনোকো-ফিলিপস-এর সাথে রফতানিমুখী চুক্তিও বলবৎ আছে। অন্যদিকে বঙ্গোপসাগরের আরও ১২টি ব্লক বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেবার জন্য পিএসসি ২০১২ নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে সরকার। বিদেশি কোম্পানির উচ্চ মুনাফা নিশ্চিত করবার জন্য বারবার তাদের কাছ থেকে গ্যাস কেনার দাম বাড়ানো হচ্ছে। সব ব্লক বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেবার অর্থ হল, এক পর্যায়ে রফতানি অনিবার্য করে বাংলাদেশকে সম্পদশূন্য করা। একদিকে গ্যাস সংকট চলছে, অন্যদিকে ‘বাপেক্স-কে কাজ দেয়া হবে না’ এই শর্ত মেনে এডিবির কাছ থেকে ঋণ নেয়া হচ্ছে, নিজেদের মজুদ টাকাও বাপেক্সসহ জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির কাজে লাগানো হচ্ছে না। নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিশাল সম্ভাবনাও ক্ষুদ্র কিছু উদ্যোগের মধ্যে আটকে রেখে বিদেশি কোম্পানির ওপর পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে বিপজ্জনকভাবে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্লান্ট অনুমোদন করা হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষে সরকার

দেশের শিল্প, কৃষি, ব্যবসা, শিক্ষা চিকিৎসা, জীবনযাপন এবং সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য সম্ভবমতো কম দামে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ অত্যাবশ্যক। এর জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগ্রহণ জরুরি। তাতে বহুজাতিক কোম্পানি, দেশি কতিপয় ব্যবসায়ী ও কমিশনভোগীরা বিরাট লুটপাট থেকে বঞ্চিত হতো ঠিক, কিন্তু দেশ ও জনগণ গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট থেকে মুক্ত হতে পারতো। এজন্য প্রয়োজন হলো জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের সম্পদ শতভাগ জনগণের মালিকানায় রেখে তার পুরোটা বর্তমানে ও ভবিষ্যতে দেশের কাজে লাগানো। কিন্তু সরকার সে পথে না গিয়ে দখল, লুণ্ঠন ও পাচারের পথে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছে।

আমরা সরকারকে অবিলম্বে এই পথ থেকে সরে জাতীয় কমিটির ৭ দফা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পথে আসার জন্য সরকারের প্রতি আবারও দাবি জানাই।