Thursday, March 25th, 2010
প্রাইভেট পোর্ট : থেমে নেই নতুন উদ্যোগ
বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ৬ জন সচিবকে সদস্য করে গঠিত ‘সচিব কমিটি’, ৩০ এপ্রিল ২০০২, তাদের প্রতিবেদনে এসএসএ’র প্রকল্পের পক্ষে জোর সুপারিশ করে যুক্তি সাজালেন এইভাবে, ‘কমিটি মনে করে যে বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে প্রতিযোগিতামূলক বাণিজ্য বাস্তবায়নে দেশজ উৎপাদন ও আমদানি-রফতানি সম্প্রসারণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্যবিমোচনের লক্ষ্যে এরূপ একটি প্রকল্পের দ্রুত বাস্তবায়ন প্রয়োজন।’ তারা নির্দিষ্ট ও পরিষ্কারভাবে এসএসএবি সম্পর্কে আরো বললেন, ‘এসএসএবি কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশ্বে ‘বিগ-ফাইভ’ নামে খ্যাত ৫টি প্রতিষ্ঠানের অন্যতম। অমূলক দরপত্র আহবান অথবা ‘সুইস চ্যালেঞ্জ, পদ্ধতি অনুসরণের উদ্যোগ গৃহীত হলে কন্টেইনার নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নে ‘বিগ-ফাইভ’-এর অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসবে কিনা সে বিষয়ে কোনো নিশ্চয়তা নেই। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এসএসএবিকে সরকার এপ্রিল, ১৯৯৮ অফার দেওয়ার পরে এবং পরবর্তীতে গঠিত নেগোসিয়েশন কমিটির দীর্ঘ ১৩ মাসব্যাপী আলোচনার সময় ২০০১ পর্যন্ত এই ‘বিগ-ফাইভ’-এর অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান এরূপ প্রকল্প প্রস্তাব সরকারের কাছে জমা দেয়নি। যদিও সে সুযোগ গ্রহণে তাদের কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল না। এ ক্ষেত্রে বর্তমান পর্যায়ে এসএসএ-র সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ইতোমধ্যে অনুস্বাক্ষরিত ‘ইমপ্লিমেন্টেশন এগ্রিমেন্ট’কে দেশের স্বার্থে অনুকূল করার উদ্যোগ নেওয়া সুবিবেচিত হবে বলে কমিটি মনে করে।’
এই কমিটির ৬ জন প্রভাবশালী সচিবের নাম সবার জানা থাকা দরকার। তারা ছিলেন (সেই সময়ে তাদের দায়িত্বসহ) : সোহেল আহমদ (সচিব, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও আহবায়ক প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি), এম সাইফুল ইসলাম (সচিব, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়), মুহাম্মদ আবদুল হক (সচিব, রাষ্ট্রপতির সচিবালয়), আফজাল হোসেন আহমদ (সচিব, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়), জাকির আহমদ খান (সচিব, অর্থ বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয়) এবং গোলাম রহমান (সচিব, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়)।
ক্ষমতাধর সচিব কমিটির এই রিপোর্টের বরাত দিয়েই এরপর ৪ মে গোলাম রহমান (সচিব, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়) নৌপরিবহনমন্ত্রী আকবর হোসেনের স্বাক্ষরসহ প্রেরিত পত্রে ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদয় বিবেচনা ও অনুমোদনের জন্য’ যে প্রস্তাব পেশ করলেন তা হলো, যেহেতু ‘সচিব কমিটি’ সবকিছু জানেন এবং সবকিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন সেহেতু ‘…এমতাবস্থায় ইতিপূর্বে গঠিত সচিব কমিটিকে এসএসএবি’র সঙ্গে নেগোসিয়েশন সম্পন্ন করার জন্য মন্ত্রিপরিষদ থেকে অনুরোধ জানানোর প্রস্তাব করা হলো।’
বাংলাদেশে উচ্চ পর্যায়ের আমলাদের সুচতুর ফাইল নোট দিয়ে এরকম প্রকল্পের অনুমোদন প্রায় ক্ষেত্রেই হয়, তার বিষফল ভোগ করতে হয় দেশ ও দেশের মানুষকে, তাদের কোনো দায়দায়িত্ব বা জবাবদিহিতা থাকে না। কিন্তু এই ক্ষেত্রে বিষয়টি আটকে গেল সমাজের বিভিন্ন অংশের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে। দেশের ‘সুশীল সমাজ’ নামে পরিচিত অনেক ব্যক্তি, গোষ্ঠী, মিডিয়া যখন এই প্রকল্পের পক্ষে সোচ্চার তখন বন্দরের শ্রমিকদের ভূমিকা ছিল বাংলাদেশের জন্য বড় রক্ষাকবচ। এসব আন্দোলনের চাপেই বিষয়টি এর মধ্যে আদালতেও উত্থাপিত হয়। হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মাহমুদ-উল-ইসলাম, চট্টগ্রাম বন্দর শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি এ এস এম নজরুল ইসলাম, চট্টগ্রাম বন্দরের হাইড্রোগ্রাফি বিভাগের প্রধান সহকারী সুনিল কুমার আইচ এবং রাজনীতিবিদ শাহ আলম। তাদের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন কামাল হোসেন। ১২ সেপ্টেম্বর ২০০২ তারিখে আদালতে মালিকানা নিয়ে জালিয়াতির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থিত করা হয়। এই মামলার অন্যতম আইনজীবী হরিসাধন দেব ব্রহ্মণ মামলায় বিষয়টি আদালতে যেভাবে উপস্থিত করা হয় তার বর্ণনা দেন।
আদালতে বলা হয়, ‘নেদারল্যান্ডের এসএসএ নেদারল্যান্ড বিভি ও বাংলাদেশ ওরিয়েন্ট মেরিটাইম লি. সমন্বয়ে বিগত ৪ ডিসেম্বর ১৯৯৭ ইংরেজি তারিখ রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ থেকে সার্টিফিকেট অব ইনকরপোরেশন আদায় করে। উক্ত কোম্পানি বিগত ২৯ ডিসেম্বর ১৯৯৭ ইংরেজি তারিখে বাংলাদেশ সরকারের নৌ-পরিবহনমন্ত্রীর নিকট চট্টগ্রামের পতেঙ্গা ও ঢাকার পানগায়ে প্রাইভেট পোর্ট এবং সমন্বিত বার্জ সার্ভিসের আবেদন করেন। ওই কোম্পানির প্রস্তাব বিগত ২৯ এপ্রিল ১৯৯৮ তারিখে সরকার অনুমোদন করেন। এসএসএ নেদারল্যান্ড বিভি নামক কোনো কোম্পানি নেদারল্যান্ডে আছে কিনা তথ্য সংগ্রহে দেখা যায়, বিগত ১ ডিসেম্বর ১৯৯৭, ৪ ডিসেম্বর ১৯৯৭ ও ২৯ এপ্রিল ১৯৯৮ তারিখ এসএসএ নেদারল্যান্ড বিভি নামক কোনো কোম্পানির অস্তিত্ব ছিল না। এসএসএ নেদারল্যান্ড বিভি একটি নেদারল্যান্ডিয় কোম্পানি বিগত ৩১ মে ২০০১ তারিখে নিবন্ধিত হয়। কিন্তু ২৯ জুন সেই কোম্পানির অবসায়নের (winding up) সিদ্ধান্ত হয় এবং তা বিগত ৭ ডিসেম্বর ২০০১ তারিখ অবলুপ্ত (winding up) হয়। পরবর্তীতে এসএসএ নেদারল্যান্ড বিভি’র পরিবর্তে এসএসএ হোল্ডিং ইন্টারন্যাশনাল (বাংলাদেশ) ইঙ্ক, এসএসএ (বাংলাদেশ) লি.-এর হোল্ডিং কোম্পানি হিসেবে দেখানো হচ্ছে। এসএসএ নেদারল্যান্ড বিভি’র দুই প্রতিনিধি মি. হেমিংওয়ে ও মি. ওয়াল্টার এসএসএ নেদারল্যান্ড বিভি থেকে বিগত ৪-১২-২০০১ তারিখে পদত্যাগ করে একই দিনে এসএসএ হোল্ডিং ইন্টারন্যাশনাল (বাংলাদেশ) লি.-এর প্রতিনিধি হিসেবে রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানির নিকট পিডি দাখিল করেছে। ফলে এসএসএ (বাংলাদেশ) লি.-এর গঠন, নিবন্ধন ও সরকার থেকে প্রাইভেট পোর্ট কন্টেইনার টার্মিনাল প্রকল্প আদায়ের সময় এসএসএ (বাংলাদেশ) লি. রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ ও বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। এর দরুন অস্তিত্বহীন কোম্পানি নিয়ে গঠিত এসএসএ (বাংলাদেশ) লি.-এর অস্তিত্ব আইনের দৃষ্টিতে অগ্রহণীয় এবং সমর্থনহীন।’
মালিকানার বিষয়টি এরকম সম্পূর্ণ ঘোলাটে ও জালিয়াতিপূর্ণ হলেও প্রভাবশালী সচিবদের বিস্তারিত বিশ্লেষণে যথারীতি তার কিছুই ধরা পড়েনি এবং তাদের ফাইল কত দ্রুত চলছিল তা পাঠকেরা খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন। এরকম একটি প্রকল্পের অর্থায়নের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আন্তর্জাতিক বৃহৎ ক্ষমতাবান কয়েকটি প্রতিষ্ঠানও। এগুলোর মধ্যে ছিল : বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (ইডকল), বিশ্বব্যাংকের ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি), যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ওভারসিজ প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক। আর এই প্রকল্পের পক্ষে মার্কিন দূতাবাসের তৎপরতা এবং মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ব্যক্তিগত লবিং ও চাপসৃষ্টি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। একইসঙ্গে তখন গ্যাস রফতানির পক্ষেও এরা জোর তৎপরতা চালাচ্ছিল।
এসবের বিরুদ্ধে তখন দেশব্যাপী জনমত ও জনপ্রতিরোধ তৈরিতে কাজ করছিল তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি। তারই একপর্যায়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত লংমার্চের আয়োজন করা হয়। দীর্ঘ সেই লংমার্চে সেলাগানে, সম্মিলিত কণ্ঠে রচিত হয় জনগণের রায় :
‘চুলা ঠেলে জীবন শ্যাষ, মালিক হয়েও পাই না গ্যাস।’
‘বন গেল, জীবন গেল, মুনাফাখোরে নিল দ্যাশ।’
‘রক্ত দিব জীবন দিব, তেল-গ্যাস দিব না।’
‘পাইপলাইনে দালাল যাবে, তেল-গ্যাস যাবে না।’
‘ঘরে ঘরে জ্বলবে আলো, লুটপাটে যাবে না।’
‘আমার মাটি আমার মা, নাইজেরিয়া হবে না।’
‘কর্ণফুলীর মোহনা, আমার মায়ের গহনা।’
‘আমার মায়ের গহনা, মার্কিনীদের দিব না।’
‘বুশ ফেরাউন নমরুদ, সময়েরই বুদবুদ।’
‘লুট জুলুমের সময় শেষ, জনগণের বাংলাদেশ।’
অবশেষে ২০০২ সালের শেষে বন্দর নিয়ে সর্বনাশা জালিয়াতি প্রকল্প বাতিল হলো। কিন্তু তারপরও একই ধরনের তৎপরতার অবসান ঘটেনি। তা এখনো অব্যাহত আছে। বিভিন্ন সরকারের আমলে, অভিন্ন দেশী-বিদেশী স্বার্থগোষ্ঠীর কর্তৃত্বে ‘সংস্কার প্রক্রিয়ার’ মধ্য দিয়ে প্রণীত রাষ্ট্রীয় নীতিমালার কারণে বন্দরসহ জাতীয় প্রতিষ্ঠান এবং সমুদ্রসহ জাতীয় সম্পদ এখন অরক্ষিত।
এসএসএ-র প্রকল্পটি অনুমোদন করাতে তদ্বির প্রচারণায় সবসময় এই প্রকল্প অনুমোদন করলে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর হয়ে উঠবে- এই যুক্তি দেওয়া হতো। এখনো সিঙ্গাপুর ও তাদের পোর্টের মতো হবার কথা বলেই অনেক সর্বনাশা কর্মসূচি ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের চেষ্টা হচ্ছে।