?> পতেঙ্গায় প্রাইভেট পোর্ট : এসএসএ ইনকর্পোরেশনের আড়ালে কারা « NCBD – National Committee of Bangladesh

Thursday, March 4th, 2010

পতেঙ্গায় প্রাইভেট পোর্ট : এসএসএ ইনকর্পোরেশনের আড়ালে কারা

কনটেইনার টার্মিনাল স্থাপনের স্থান নির্ধারণ করা হয়েছিল কর্ণফুলীর মোহনায়, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সমুদ্রে বের হওয়ার মুখে। সুতরাং এর কৌশলগত গুরুত্ব তো বটেই চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যকারিতা, কর্তৃত্ব  এমনকি অস্তিত্ব নিয়েই তখন প্রশ্ন উঠতে থাকে। কর্ণফুলী নদীর ডান তীরে পতেঙ্গায় চট্টগ্রাম বন্দর এলাকায় ‘২০.৯৭ একর জমি লিজের মাধ্যমে প্রথম পর্যায়ে ৯৯ বছর মেয়াদে এবং পরবর্তী পর্যায়ে আরো ৯৯ বছরের জন্য ইজারা এবং ওই জমি সংলগ্ন ১৫০০ মিটার দৈর্ঘ্য নদীমুখ নদীর তীর থেকে নদীর অভ্যন্তরে ৫৮ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত জল এলাকাসহ বার্থ/জেটি নির্মাণের জন্য প্রথম দফায় ৩০ বছর মেয়াদে এবং পরবর্তীতে আরো ৬ দফা ৩০ বছর মেয়াদি অর্থাৎ মোট ২১০ বছর মেয়াদি লাইসেন্স প্রদান’ সংক্রান্ত এই চুক্তির ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে খুব দ্রুত অগ্রসর হওয়ার তৎপরতা দেখা যায়। চুক্তিনামার প্রস্তাবে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় পতেঙ্গা এলাকায় ‘ব্যক্তিমালিকানাধীন ১৫৮.৮৭ একর জমিসহ বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের মালিকানাধীন আরো ৫২.৭৭ একর জমির মালিকানা হস্তান্তরের জন্য’ প্রয়োজনীয় সুপারিশ ও সহযোগিতা প্রদান করবে বলা হয়। তদুপরি ভবিষ্যতে তারা তাদের টার্মিনাল সম্প্রসারণ করতে চাইলে প্রয়োজনের অতিরিক্ত জমির মালিকানা যাতে পেতে পারে তার ব্যবস্থা নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় নিশ্চিত করবে এই মর্মে শর্তও দেওয়া ছিল।

মন্ত্রণালয় এবং বিভিন্ন ‘বিশেষজ্ঞ’ কার্যক্রম কীভাবে এসব কোম্পানির স্বার্থে গোছানো হয় তা এই সময়কার বিভিন্ন সভার প্রস্তাব, সিদ্ধান্ত, কমিটি গঠন ইত্যাদি পদক্ষেপ খেয়াল করলে বোঝা যায়। ১৯৯৭ সালে প্রস্তাব জমা দেওয়ার পর তা মন্ত্রিপরিষদের প্রাথমিক সম্মতি পেয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে যায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য। অনেক দেনদরবারের পর ২০০০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি এই প্রস্তাব পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং এ নিয়ে এসএসএ কোম্পানির সঙ্গে ‘নেগোসিয়েশনে বিশেষজ্ঞ সার্ভিস প্রদানের জন্য’ মন্ত্রণালয় যাদের সঙ্গে ‘ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস এগ্রিমেন্ট’ স্বাক্ষর করে তারা হলো, বিশ্বব্যাংকের অর্থ ও নীতিমালায় পরিচালিত ‘সরকারি’ প্রতিষ্ঠান আইআইএফসি (ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ফ্যাসিলিটেশন সেন্টার)। এখানে আমরা মনে করতে পারি, এই আইআইএফসি ২০০৬ সালে কয়লা নীতি প্রণয়ন করেছিল, যেখানে মাটি, পানি ও মানুষ বিনাশী উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে উত্তোলন করে কয়লা রফতানির জন্য ফুলবাড়ী কয়লা খনি এশিয়া এনার্জিকে ও বড়পুকুরিয়া টাটাকে দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছিল। পরে ব্যাপক জনপ্রতিরোধের কারণে এই কয়লা নীতি পরিত্যক্ত হয়।

বন্দরের উপরোক্ত প্রকল্পের পক্ষে তদ্বির বা চাপ দিতে গিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত এই আইআইএফসিকে ‘বিশ্বব্যাংকের প্রতিষ্ঠান’ বলেই অভিহিত করেছেন এবং এর সমীক্ষাকেই সাক্ষী মেনেছেন। নৌপরিবহন মন্ত্রীর কাছে মার্কিন কোম্পানির সঙ্গে অবিলম্বে চুক্তি স্বাক্ষরের পক্ষে জোর সুপারিশ করে ‘আগের দিনের আলোচনার সূত্রে’ লেখা চিঠিতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মেরি অ্যান পিটার্স স্পষ্ট করে বলছেন, ‘এর জন্য কোনো টেন্ডারের প্রয়োজন নেই।’ কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, ‘স্বচ্ছতার সঙ্গে সব আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে, বিশ্বব্যাংকের প্রতিষ্ঠান আইআইএফসি  এ বিষয়ে কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করে অনুকূল মতামত দিয়েছে’ ইত্যাদি (চিঠির ফটোকপি, তারিখ অস্পষ্ট, সম্ভবত ২০০০)। বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফ্রেডরিখ টেম্পলও একই সময় এই চুক্তি সম্পাদনের জন্য বারবার তাগিদ দিয়েছেন। মেরি তার চিঠিতে যেসব যুক্তি দিয়েছেন সেগুলোসহ চুক্তির পক্ষে বিস্তারিত পরে এক পুস্তিকায় প্রকাশিত হয় ২০০১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। পুস্তিকার শিরোনাম ‘বেসরকারি খাতে পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল’। এতে এসএসএ আমেরিকার সাফল্যগাথা ছাড়াও এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের উন্নয়নের রঙিন সম্ভাবনা ও প্রত্যক্ষভাবে বিলিয়ন ডলার লাভের প্রচার ছিল।

মন্ত্রণালয় কীভাবে কোম্পানির পক্ষে নিবেদিত হয়ে কাজ করে তার অনেক দৃষ্টান্তই সে সময় তৈরি হয়েছে। এর একটি এখানে উল্লেখ করা যায়। ২০০০ সালে (তারিখ অস্পষ্ট) চুক্তির পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্ত্ততকৃত সারসংক্ষেপে বলা হয়, ‘উল্লেখ্য যে, সরকার কর্তৃক ১৯৯৬ সালে প্রণীত বিনিয়োগ নীতিমালায় পোর্ট সেক্টরকে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে যার ফলে এ সেক্টরকে সরকারি খাতের সুরক্ষিত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অন্যদিকে পঞ্চম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার (১৯৯৭-২০০২) কৌশল হিসেবে অভ্যন্তরীণ নৌ কন্টেইনার টার্মিনাল এবং চট্টগ্রাম বিদ্যমান পোর্ট এলাকার বাইরে কন্টেইনার টার্মিনাল স্থাপনের নিমিত্তে বেসরকারি খাতকে উন্মুক্ত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।’ কাদের জন্য নীতিমালা তৈরি হয় তা এ থেকে কিছুটা আন্দাজ করা সম্ভব। তথাকথিত ‘দাতা গোষ্ঠীর’ কাছে সরকারের প্রতিশ্রুতির কথাও এখানে যুক্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এই সারসংক্ষেপে, অতএব, সিদ্ধান্ত টানা হয় যে, ‘বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের কন্টেইনার/জাহাজ জট এক বিশাল এবং জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে সম্প্রতি বন্দরে প্রতি বছর কন্টেইনার প্রবৃদ্ধির হার ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ায় বন্দর কর্তৃপক্ষের পক্ষে বিভিন্ন সমস্যার কারণে দক্ষভাবে তা হ্যান্ডলিং করা সম্ভব হচ্ছে না। এ সমস্যা আগামী ২-৩ বছরের মধ্যে সমাধান করা না হলে বন্দরে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বেসামাল হয়ে পড়বে যা দেশের আমদানি/রফতানি/শিল্পায়ন/কৃষি উন্নয়নের ওপর এক ভয়াবহ বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলবে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রস্তাবিত নিউমুরিং প্রকল্পটি আগামী ২০০৩ সালের আগে বাস্তবায়িত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এমতাবস্থায় চট্টগ্রামের পতেঙ্গা এলাকায় বেসরকারি খাতে প্রস্তাবিত কন্টেইনার টার্মিনাল প্রতিষ্ঠিত হলে আগামী ২ বছরের মধ্যে উপরোক্ত সমস্যাগুলো সমাধান করা সম্ভব হবে। তাই বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে প্রস্তাবিত প্রকল্পটি জরুরি ভিত্তিতে এখন থেকেই বাস্তবায়ন করা অত্যাবশ্যকীয়। সুতরাং এসএসএ (বাংলাদেশ) লিমিটেডের প্রস্তাব মতে পতেঙ্গাস্থ টার্মিনালের স্থান সরকারি হুকুম দখলের মাধ্যমে অধিগ্রহণ করে তাদের হস্তান্তর করা যেতে পারে।’ এই সারসংক্ষেপ ও প্রস্তাব স্বাক্ষর করেন এএইচ মোফাজ্জল করিম, সচিব, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়।

এই নোট লেখার পর ১০ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে, আলোচ্য প্রকল্পটি বাস্তবায়িত না হওয়ায় কী ‘ভয়াবহ বিরূপ প্রতিক্রিয়া’ সৃষ্টি হয়েছে এবং জাতীয় বন্দরের সর্বনাশ করে একটি বিদেশী কোম্পানির হাতে অর্থনীতি ও সমুদ্র মুখ ছেড়ে দেওয়ার উৎসাহ তাদের মধ্যে কীভাবে সৃষ্টি হয়েছিল সে বিষয়ে এখন এই নোট প্রস্ত্ততকারীদের কাছে জবাব চাওয়া প্রয়োজন।

কিন্তু কাদের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের এসব আয়োজন চলছিল? এই এসএসএ (বাংলাদেশ) লিমিটেড কারা? কাদের জন্য মার্কিন দূতাবাস, বিশ্বব্যাংক, মন্ত্রী, আমলাদের প্রভাবশালী গোষ্ঠী, কতিপয় সংবাদপত্র, কনসালট্যান্ট একসুরে অস্থির আওয়াজ তুলেছিলেন?

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান মাহমুদ-উল-ইসলাম এবং চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হেলাল উদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রাম বন্দর উন্নয়ন ফোরামের পক্ষ থেকে প্রকাশিত এক পুস্তিকায় এই প্রস্তাবিত চুক্তির অনেকগুলো সমস্যা তুলে ধরেছিলেন। এর মধ্যে প্রথমেই যা উল্লেখযোগ্য তা হলো, যে কোম্পানির হাতে এই প্রকল্প তার আসল পরিচয় নিয়ে চরম অস্বচ্ছতা। তারা বলছেন, ‘এসএসএ (বাংলাদেশ) লিমিটেড নামক কোম্পানির আর্টিকেলস অব এসোসিয়েশন থেকে দেখা যায়, অরিয়েন্ট মেরিটাইম লিমিটেডের ৫০% শেয়ার ও এসএসএ নেদারল্যান্ড বিভি’র ৫০% শেয়ারের ভিত্তিতে এসএসএ (বাংলাদেশ) লিমিটেড নামক কোম্পানি গঠিত হয়েছে। ওই আর্টিকেলস থেকে দেখা যায়, মূলত এসএসএ নেদারল্যান্ড কোম্পানিটি নেদারল্যান্ডের একটি কোম্পানি। ওই কোম্পানির আর্টিকেলস অব এসোসিয়েশন থেকে আরো দেখা যায়, কোম্পানির শেয়ার মূলধন হবে এক কোটি টাকা। যার ৫০% ভাগ শেয়ার উভয়ে ভাগ করে দেবেন। মাত্র এক কোটি টাকার শেয়ার মূলধন নিয়ে গঠিত সদ্য রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত একটি নতুন কোম্পানি কিভাবে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে পতেঙ্গায় প্রাইভেট পোর্ট নির্মাণ করবে তা অনুধাবন করা মুশকিল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এসএসএ (বাংলাদেশ) লিমিটেড ২৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে পতেঙ্গার প্রাইভেট পোর্ট নির্মাণের কথা সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে ও পত্রপত্রিকায় প্রচার করে বেড়াচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে স্টিভিডোর সার্ভিস অব আমেরিকা ইনকর্পোরেশন নামে অন্য আরেকটি কোম্পানি ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইএফসি-বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিষ্ঠান) নামক অর্থলগ্নীকারী প্রতিষ্ঠান থেকে পতেঙ্গায় প্রাইভেট কন্টেইনার পোর্ট ও টার্মিনাল নির্মাণের জন্য ঋণের মাধ্যমে বিনিয়োগের টাকা সংগ্রহের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এতে আরো রহস্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, ওই এসএসএ ইনকর্পোরেশনকে বাংলাদেশ সরকার প্রাইভেট পোর্ট নির্মাণের জন্য কখনো কোনো অনুমোদন দেয়নি। তাহলে ওই এসএসএ ইনকর্পোরেশন কেন ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের সঙ্গে পত্র লেখালেখি করে পতেঙ্গায় প্রাইভেট পোর্ট নির্মাণের জন্য অর্থ সাহায্য চাচ্ছে তা আমাদের বোধগম্য হচ্ছে না। এর পেছনে কোনো একটি বিশেষ ষড়যন্ত্র কাজ করছে বলে আমরা মনে করি।’