?> বাংলাদেশের সমুদ্র ও সমুদ্র বন্দর-১: ভারতের বন্দর ব্যবহার নিছক ব্যবহারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় « NCBD – National Committee of Bangladesh

Wednesday, February 17th, 2010

বাংলাদেশের সমুদ্র ও সমুদ্র বন্দর-১: ভারতের বন্দর ব্যবহার নিছক ব্যবহারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়

গত দশ বছরে চট্টগ্রাম বন্দর এবং সেইসঙ্গে গভীর সমুদ্র বন্দর প্রসঙ্গ বিভিন্নভাবে আলোচনা ও বিতর্কে এসেছে। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক কয়েকটি সংস্থা বিশেষত বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক নানাভাবে বন্দর সম্পর্কিত সরকারি তৎপরতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। মার্কিন দূতাবাসসহ কয়েকটি দূতাবাসকেও বিভিন্ন সময় সরব ও সক্রিয় দেখা গেছে। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থার ঋণ, ঋণের টাকায় পালিত ঊর্ধ্বমূল্যের কনসালট্যান্টদের পরিচালিত বিভিন্ন প্রকল্প সরকারি অনেক নীতিনির্ধারণের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। এসব সংস্থার নিয়মিত সহযোগী দেশী বিশেষজ্ঞ, আন্তর্জাতিক সংস্থা, বিদেশি দূতাবাস, সরকারের মন্ত্রী, আমলা এবং প্রকল্পের সম্ভাব্য সুবিধাভোগী ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর মধ্যে সবদেশে অতএব সবসময়ই ঐকমত্য দেখা যায়। কিন্তু এই ঐকমত্য সবসময় জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায় না। এ বিষয়ে জনগণের মধ্য থেকে ভিন্নমত এমনকি প্রতিরোধ সৃষ্টি হয়েছে তখনই যখন এ সম্পর্কিত তথ্য কোনো না কোনোভাবে জনগণের মধ্যে গেছে। কেননা অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো বন্দর বিষয়ে অনেক কার্যক্রম, চুক্তি বা পদক্ষেপেও গোপনীয়তা রাখার বরাবর চেষ্টা আছে। কিন্তু তা সবসময় ফলপ্রসূ হয় না বলেই রক্ষা।

পৃথিবীর সব দেশে সমুদ্র বন্দর নেই। বহু দেশ আছে যেগুলো একাধিক দেশ দ্বারা সমুদ্র থেকে বিচ্ছিন্ন। এই দেশগুলোকে বলা হয় ভূমিবদ্ধ দেশ। সমুদ্র বন্দরে যেতে হলে তাদের অন্য একাধিক দেশের প্রয়োজনীয় অনুমতি ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাবলীর অপেক্ষা করতে হয়। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মধ্যে নেপাল ও ভূটান এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বাংলাদেশের মংলা বন্দর ব্যবহারের জন্য নেপাল ও ভুটান বিভিন্ন সময়ে আগ্রহ প্রকাশ করলেও ভারত ট্রানজিট না দেয়ায় তারা এখনো এই বন্দর ব্যবহার করতে সমর্থ হয়নি।

সমুদ্র বন্দর থাকায় বাংলাদেশ অন্য অনেক দেশের চাইতে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে কেবল বন্দরের জন্যই নয়, সমুদ্রের জন্যও। বাংলাদেশের দক্ষিণ দিক সমুদ্রে উন্মুক্ত এবং এরই দুই প্রান্তে আছে দুটো সমুদ্রবন্দর। উন্মুক্ত সমুদ্র আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও পরিবহনের জন্য অনেক সুবিধাজনক। আর এই সমুদ্র জানা ও অজানা অনেক সম্পদেরও আধার। বঙ্গোপসাগরে বিপুল তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ আছে বলে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত, বৃহৎ তেল-গ্যাস কোম্পানি বা বহুজাতিক সংস্থার আগ্রহ সেটাই প্রমাণ করে। উন্মুক্ত থাকায়, সমুদ্রের সীমা অনুযায়ী, সেখানে বাংলাদেশের স্থলসীমার প্রায় দ্বিগুণ অঞ্চল বাংলাদেশের প্রাপ্য। কিন্তু এই সমুদ্রসীমা নিয়ে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ বড় ধরনের বিপদে পতিত। প্রাপ্য সমুদ্রসীমার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ দাবি করছে ভারত ও মিয়ানমার।

বন্দরের সুবিধা বাংলাদেশ ইতোমধ্যে অনেকখানি পাচ্ছে, বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্যের যে সমৃদ্ধি তা এই বন্দর সুবিধা না থাকলে সম্ভব হতো না। কিন্তু এই সুবিধা ব্যবহারের আরো অনেক সুযোগ আছে। মংলা বন্দর এখনো প্রায় অব্যবহৃত। চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মদক্ষতা ও কর্মসুযোগ সম্প্রসারণের অনেক সম্ভাবনা আছে। সুতরাং কেউ যদি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর ও মংলা বন্দরের উন্নয়ন বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আরও সচল করবে তাতে ভিন্নমত পোষণ করার কোনো কারণ নেই। ভারতকে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার করতে দেওয়ার কারণ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অনেকেই এই দাবি করছেন।

বাংলাদেশ ও ভারতের দুই প্রধানমন্ত্রীর যৌথ ঘোষণায় ভারতকে বন্দর সুবিধা দেওয়া প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আজকের দিনে তো দরজা আটকে বসে থাকতে পারি না। সব ঘরে তো কাঁটা মেরে বসে থাকতে পারি না। আমাদের দুটি সম্পদ আছে- চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর। নেপাল ও ভূটানও যাতে এসব বন্দর ব্যবহার করতে পারে, সে ব্যবস্থাও নেওয়া হবে। ভারতও বাংলাদেশকে নেপাল ও ভুটানে ট্রানজিট দিচ্ছে। পারস্পরিক স্বার্থ অক্ষুণ্ণ এবং দেশের স্বার্থ সমুন্নত রেখেই এটা করা হবে। …তাছাড়া প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আমরা তো ভারতের সঙ্গে ঝগড়া করতে পারি না।’ (প্রথম আলো, ১৪ জানুয়ারি ২০১০)।

এই যৌথ ঘোষণা ও সমঝোতা সম্পর্কে সংবাদপত্রে বলা হয়েছে, ‘সড়ক ও রেলপথে ভারত থেকে পণ্য আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করতে দেবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর নেপাল ও ভুটানকেও ব্যবহার করতে দিতে আগ্রহী। দুই প্রধানমন্ত্রীর আলোচনায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, প্রস্তাবিত আখাউড়া-আগরতলা রেললাইন স্থাপন ভারতীয় অর্থায়নে হবে। দুই দেশের রেললাইনের সংযোগ কীভাবে করা যায়, তা ঠিক করবে দুই দেশের রেল কর্মকর্তাদের একটি যৌথ দল।…বাংলাদেশ আশুগঞ্জকে ভারতের জন্য এবং ভারত শিলঘাটকে বাংলাদেশের জন্য ‘পোর্টকল’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। অর্থাৎ নৌপথে পণ্য এনে স্থল কিংবা রেলপথে বাংলাদেশ ও ভারত পণ্য পরিবহনের সুবিধা পাবে। এ ক্ষেত্রে চিঠি আদান-প্রদানের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ নৌ-বাণিজ্য ও ট্রানজিট (আইডব্লিউটি) প্রোটোকলটি সংশোধন করবে। আশুগঞ্জ থেকে ভারি পণ্য পরিবহন (ওডিসি) একবার কিংবা স্থায়ীভাবে পরিবহনের ক্ষেত্রে অবকাঠামো উন্নয়ন ও তার সম্ভাব্য ব্যয় একটি যৌথ দল যাচাই করে দেখবে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় টাকা দেবে ভারত। দুই দেশের সরকার এ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে রাজি হয়েছে। দুই দেশের ঠিকাদাররা এ কাজটি করতে পারবেন।…নেপালে বাংলাদেশের ট্রানজিটের জন্য রোহানপুর-সিংগাবাদ ব্রডগেজ রুটটি চালু হবে। বৈঠকে বাংলাদেশ রাধিকাপুর-বিরল রুটটি ব্রডগেজে উন্নীত করতে চায়। একইসঙ্গে ভুটানে বাংলাদেশের রেল ট্রানজিট দেওয়ার ব্যাপারেও অনুরোধ করেছে বাংলাদেশ। (প্রথম আলো, বুধবার, ১৩ জানুয়ারি ২০১০)।

বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দরে বিভিন্ন দেশের জাহাজ আসে, সেই হিসেবে ভারতের জাহাজও এমনিতেই সেখানে আসতে পারে। নেপাল ও ভুটানের কথা ভিন্ন। কারণ নেপাল ও ভুটান যদি বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার করতে চায় তাহলে অবশ্যই তাদের এই বন্দর পর্যন্ত দ্রব্যসামগ্রী নিয়ে আসার এবং এই বন্দর থেকে দ্রব্যসামগ্রী নিজ দেশ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার জন্য ভারতের আইনগত অনুমতি, প্রশাসনিক বিধিব্যবস্থা এবং অবকাঠামোগত সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এর আগে বিভিন্ন সময় ভারত নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ সুবিধা দেওয়ার প্রশ্নে অনুমতি দিলেও প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও অবকাঠামোগত সুবিধা না দেওয়ায় তা কার্যকর হয়নি।

অন্য যে কোনো দেশের জাহাজের মতোই ভারতের জাহাজ এমনিতেই সমুদ্রপথে বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দরে আসতে পারে কিন্তু তাহলে বন্দর ব্যবহারে ভারতকে আলাদা করে অনুমতি দেওয়ার প্রশ্ন উঠছে কেন? প্রশ্ন উঠছে এই কারণে যে, ভারতের এই বন্দর ব্যবহার নিছক বন্দর ব্যবহারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, ভারত এই বন্দর ব্যবহার করতে আগ্রহী তার পণ্যসামগ্রী ভারত থেকে এনে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর হয়ে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে তার দেশের অন্য প্রান্তে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তার অর্থ হচ্ছে, ভারতের বন্দর ব্যবহার অন্য কোনো দেশের মতো নয়, নেপাল বা ভুটানের মতোও নয়। ভারতের বন্দর ব্যবহার ট্রানজিট সুবিধার সঙ্গে সম্পর্কিত। এই সিদ্ধান্ত নিলে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর হয়ে উঠবে- এই কথাটি অনেকেই বলছেন। এ কথাটি আগেও আমরা শুনেছি। সিঙ্গাপুরের অর্থনীতি ও বন্দর নিয়েও অতএব এখানে আলোচনা দরকার।

সমুদ্র এবং সমুদ্র বন্দর নিয়ে বাংলাদেশ কোন দিকে যাচ্ছে তা শুধু এই যৌথ ঘোষণা বা সিদ্ধান্ত দিয়ে বোঝা যাবে না। গত দশ বছরে বন্দর নিয়ে উন্নয়ন চিন্তা, বহুজাতিক পুঁজির পক্ষে আন্তর্জাতিক সংস্থার নানা নীতিমালা, সমুদ্র কেন্দ্র করে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের গতিবিধি ইত্যাদির বিশ্লেষণ করলে হয়তো এই গতিপথ আন্দাজ করা যাবে। এই বন্দর নিয়ে বড় এক আন্দোলন তৈরি হয়েছিল দশ বছর আগে। যুক্তরাষ্ট্রের এক কোম্পানির কাছে ইজারা দেওয়ার জন্য সরকার ও সব ‘উন্নয়ন’ সহযোগীরা উন্মাদ হয়ে উঠেছিল। সেসময় তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটিকে লংমার্চ করতে হয়েছিল। সেই পর্বটিও আমাদের বিশেষভাবে মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করতে হবে।