
Friday, July 18th, 2008
কয়লানীতি ও সমুদ্রের তেল, গ্যাস ইজারা নিয়ে অপতৎপরতা বিষয়ে সাংবাদিক সম্মেলন
[১৮ জুলাই ২০০৮ ইং তারিখে মুক্তি ভবনে জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ সভাপতিত্বে একটি সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কমিটির সদস্য সচিব আনু মুহাম্মদ। উক্ত সম্মেলনে কেন্দ্রীয় কমিটির সাথে স¤পৃক্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি এবং বিশেষজ্ঞগণ প্রবন্ধের উপর তাঁদের বক্তব্য প্রদান করেন। প্রবন্ধের বক্তব্য হুবহু নিচে তুলে দেয়া হলোঃ-]
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
শুভেচ্ছা নিবেন।
আপনারা নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে, তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি ছাড়াও দেশের শিক্ষক, সাংবাদিক, ভূতাত্ত্বিক, প্রকৌশলী, অর্থনীতিবিদ, শ্রমিক, কৃষক, ক্ষেতমজুর, নারী, শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশা ও সংগঠনের মানুষ দাবী জানিয়ে আসছেন যে, বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করবার জন্য, বিদ্যুৎসহ শিল্প স্থাপনার প্রয়োজন মেটানোর জন্য, দেশকে ক্রমান্বয়ে একটি বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়া ঠেকানোর জন্য এবং সর্বোপরি উন্নয়ন সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত করবার জন্য জনগণের সম্পদের উপর জনগণের কর্তৃত্ব নিশ্চিত করা ছাড়া কোন বিকল্প নেই। এই কারণে জনগণের বিভিন্ন অংশ থেকে আমরা বারবার দাবী জানিয়েছি অতীতের মতো জনগণকে অন্ধকারে রেখে, সম্পদ লুণ্ঠন বা পাচার কিংবা জীবন, সম্পদ ও পরিবেশ বিনষ্ট করবার মতো, নিজেদের সম্পদ বিদেশীদের হাতে তুলে দেবার মতো কোন চুক্তি করা যাবে না। জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির পথে ছড়ানো সব প্রতিবন্ধকতা দূর করে নিজেদের উৎপাদনশীল ভিত্তি সুদৃঢ় করতে হবে।
আপনারা জানেন যে, ৯০ দশকের বিভিন্ন সময়ে স্বাক্ষরিত তেল-গ্যাস নিয়ে বিভিন্ন পিএসসি চুক্তির কারণে গ্যাস সম্পদ এখন বাংলাদেশের মানুষের হাতছাড়া, বিদ্যুৎ উপৎপাদন সংকটগ্রস্ত, বাংলাদেশ বিভিন্ন মার্কিন-ইউরোপীয়-কানাডীয় কোম্পানির কাছে জিম্মি, সম্পদের অভাবের অজুহাতে যেখানে বিভিন্ন খাত দাঁড়াতেই পারছে না সেখানে এসব চুক্তির কারণে বাংলাদেশ এখন প্রতি বছর দেড় হাজার কোটি টাকা ভর্তুকির শিকার যা আরও ক্রমবর্ধমান। এখানেই শেষ নয়, এসব চুক্তির কারণেই সীমিত গ্যাস সম্পদের এই দেশে বহু হাজার কোটির টাকার গ্যাস সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে যার কোন ক্ষতিপূরণ আমরা এখনো পাইনি।
জাতীয় কমিটির নেতৃত্বে জনগণ প্রতিরোধ তৈরি না করলে, যদি এসব তেল কোম্পানি-কনসালট্যান্ট-আমলা আর দূতাবাসের ইচ্ছামতো সবকিছু চলতে পারতো তাহলে ক্ষতি আরও ভয়ানক হতো। রপ্তানির নামে গ্যাস পাচার হতো তাদের পরিকল্পনা মতো, আর তার তুল্য পরিমাণ তেল আমদানি করতে এখন ব্যয় হতো অতিরিক্ত আরও প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। এরকম সর্বনাশা প্রকল্প যারা বাস্তবায়ন করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল সেইসব তেল কোম্পানি-কনসালট্যান্ট-আমলা-বিদেশী দূতাবাস এখনও প্রবল প্রতাপে নতুন নতুন লুণ্ঠন ও পাচারের প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে ব্যস্ত। তারাই এখন কয়লা সম্পদসহ সমুদ্রের তেল গ্যাস সম্পদের উপর দখল নিশ্চিত করবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। এই অনির্বাচিত সরকার যেখানে ডিসেম্বরে নির্বাচন করতে বারবার দৃঢ়সংকল্প প্রকাশ করছে সেখানে এই কয়েক মাস অপেক্ষা করতেও তারা নারাজ। সেজন্য জনগণকে না জানিয়ে এই সরকার একইরকম সর্বনাশা পিএসসি মডেলের ভিত্তিতে রপ্তানিমুখি চুক্তি করে তেল গ্যাস সম্পদ তুলে দিতে চাচ্ছে মার্কিন ও আইরিশ দুটো কোম্পানির হাতে।
অন্যদিকে ফুলবাড়ীর মানুষের রক্তমাখা হাত নিয়ে, কিছু দালাল সহযোগে, জনগণ ও বিশেষজ্ঞ কমিটি প্রত্যাখ্যাত এশিয়া এনার্জি এখনও বাংলাদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাংলাদেশের কয়লা দেখিয়ে বাণিজ্য করছে এশিয়া এনার্জি আর তার সহযোগী ইউবিএস, পলো রিসোর্স, রাব ক্যাপিটাল এর মতো কুখ্যাত তহবিল সংস্থা। এশিয়া এনার্জি বা গ্লোবাল কোল ম্যানেজমেন্ট এখনও উত্তরবঙ্গ জুড়ে তাদের দালালদের মাধ্যমে নানা অপতৎপরতায় লিপ্ত। তারা এসব অঞ্চলে ঘুষ, দুর্নীতি ছড়িয়ে একটা দালাল গোষ্ঠী তৈরি করতে চেষ্টা করছে যারা একদিকে অপপ্রচার ভয়ভীতি প্রদর্শনে লিপ্ত আছে অন্যদিকে প্রশাসন ব্যবহার করে একের পর এক ফুলবাড়ী গণঅভ্যুত্থানের নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা ও পুলিশী হয়রানির অপচেষ্টা করছে।
কিছুদিন আগে প্রথমে জাতীয় কমিটির ফুলবাড়ী থানা শাখার প্রাক্তন সদস্য সচিব নুরুজ্জামানের বিরুদ্ধে ও পরে থানা শাখার আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম জুয়েল ও পাশাপাশি কর্মী বাবুর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। এছাড়া আরও নেতা কর্মীর বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক তৎপরতায় লিপ্ত আছে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন। আমরা বহুবার সরকারকে জানিয়েছি যে, যেখানে বিশেষজ্ঞ কমিটি ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্প বাতিল করেছে, যেখানে জনগণ জীবন দিয়ে এই প্রকল্প ও কোম্পানিকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন, যেখানে একটি নির্বাচিত সরকার জনগণের সাথে চুক্তি করে তা বাতিলের অঙ্গীকার করেছে সেখানে “দুর্নীতিবিরোধী” বলে পরিচয়দানকারী এই সরকার কেন এশিয়া এনার্জির দুর্নীতি, মিথ্যাচার ও সন্ত্রাস ছড়ানোর তৎপরতায় সহযোগিতা করছে? কীভাবে এই কোম্পানি এখনও বাংলাদেশের কয়লা দেখিয়ে লন্ডন মার্কেটে শত হাজার কোটি টাকা লুট করতে পারছে?
জনগণের অসাধারণ অভ্যুত্থানের মুখে তাদের ঐক্যবদ্ধ রায়ের কাছে নত হয়ে তৎকালীন সরকার যে চুক্তি করেছিল সেটাই ফুলবাড়ী চুক্তি। বাংলাদেশের কোন সরকারের যদি জনগণের প্রতি ন্যূনতম দায়বোধ থাকে, যদি জনস্বার্থ ও জাতীয় স্বার্থের প্রতি ন্যূনতম অঙ্গীকার থাকে, গণতন্ত্রের ব্যাপারে ন্যুনতম সদিচ্ছা থাকে তাহলে ফুলবাড়ী চুক্তি বাস্তবায়ন হবে তার ন্যূনতম স্বাক্ষর। আপনারা জানেন যে, ফুলবাড়ী চুক্তির মূল দিকগুলো হলোঃ ভূতাত্ত্বিক গঠন, মাটি, পানি, কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা এবং জনবসতি ও জীবিকা বিবেচনা করে বাংলাদেশে উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করা, মানুষ মাটি পানি কৃষি বিধ্বংসী এবং জাতীয় অর্থনীতির জন্য হুমকিস্বরূপ ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্প বাতিল ও এশিয়া এনার্জিকে বহিষ্কার এবং এশিয়া এনার্জির দালালদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ। পরবর্তী সময়ে সরকার গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটিও যাবতীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা করে উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি এবং ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্প না গ্রহণ করবার পক্ষে মত দিয়েছিলেন।
বিশেষজ্ঞ কমিটির এই রিপোর্ট গোপন রেখে এবং ফুলবাড়ী চুক্তি অগ্রাহ্য করে এশিয়া এনার্জির স্বার্থ রক্ষার্থে সরকারের ভেতরে ও বাইরে বিভিন্ন মহল এখনও তৎপর আছে। ব্রিটিশ হাইকমিশন যে এশিয়া এনার্জির লবিস্ট হিসেবে কাজ করতে দায়িত্বপ্রাপ্ত সেটি আমরা ব্রিটিশ পার্লামেন্টের তথ্য বিবরণী থেকেই জানি। এছাড়া এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, ভারত অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন গোষ্ঠী এবং বেশ কিছু কনসালট্যান্ট একই কাজে নিয়োজিত আছে। এদের অপতৎপরতায় কয়লা নীতির মধ্যে আবারও উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি নিয়ে আসার চেষ্টা হচ্ছে এবং আরও চেষ্টা হচ্ছে (খনি বাংলা করবার কথা বলা হলেও তার সহযোগী হিসেবে) বিদেশী কোম্পানির দখলদারিত্বের সুযোগ রাখার। দেশে বিদেশে এশিয়া এনার্জি ও তার সহযোগীদের তৎপরতার থেকে মনে হয় তারা তাদের দালাল-লবিস্টদের উপর ভরসা করে এখনও সুযোগ সন্ধানে ওৎ পেতে আছে।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
আমরা আজকের সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে সরকার ও দেশী বিদেশী সব মহলের কাছে এই গণরায়ই আবার স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করতে চাই যে, উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি বা বাংলাদেশের কয়লা সম্পদের উপর এশিয়া এনার্জি টাটা বা অন্য কোন বিদেশী কোম্পানির দখলদারিত্ব কোনভাবেই জনগণ গ্রহণ করবে না। ফুলবাড়ী চুক্তির ধারবাহিকতায় এশিয়া এনার্জিকে অবিলম্বে দেশ থেকে বহিষ্কার করতে হবে। তার সাথে বিভিন্ন পর্যায়ের সক্রিয় তার দেশী বিদেশী দালালদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
একইসঙ্গে আমরা আরও জানাতে চাই যে, জনগণের সম্মতি ব্যতিত বাংলাদেশের জনগণের সম্পত্তি তেল গ্যাস ইজারা দেবার কোন এখতিয়ার এই সরকারের নেই। সমুদ্রসীমা অরক্ষিত রেখে, সে বিষয়ে কোন কাজ না করে, সমুদ্রে তেল গ্যাস বিদেশী কোম্পানির হাতে তুলে দেবার সব তৎপরতা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
সমুদ্রসীমা নির্দিষ্ট না করায় এখন ভারত বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় তেল গ্যাস অনুসন্ধানসহ অনুপ্রবেশ করবার ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছে। ভারতীয় সরকারের কাছে নতজানু নীতির কারণে ভারত ট্রানজিট সুবিধাও দাবী করছে আমরা যার তীব্র নিন্দা জানাই। বাংলাদেশের ভূ বা সমুদ্রসীমায় ভারতের এসব তৎপরতা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
কিছু অর্থ বা সুবিধা বা প্রলোভনের বিনিময়ে বাংলাদেশের জনগণের সম্পদ, জীবন-জীবিকা, জ্বালানী নিরাপত্তা, খাদ্য নিরাপত্তা এবং সর্বোপরি উন্নয়ন ক্ষমতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে এশিয়া এনার্জিসহ বিভিন্ন বিদেশী কোম্পানির দালাল হিসেবে যারা এখনও বিভিন্ন পর্যায়ে অপতৎপরতা চালাচ্ছেন তাদেরকে অবিলম্বে এই অপতৎপরতা বন্ধের আবেদন জানাচ্ছি। না হলে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের এই দালালদের তালিকা জনগণের কাছে প্রকাশ করা হবে।
জাতীয় সম্পদ নিয়ে সরকারের ভেতরে ও বাইরে যে অপতৎপরতা চলছে তা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে আমরা বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ বিশেষজ্ঞ ও জনগণকে নিয়ে আন্দোলনে যেতে বাধ্য হবো। জাতীয় সম্পদ রক্ষায় সারাদেশব্যাপী আমাদের নতুন পর্যায়ের জনসংযোগ কর্মসূচি শুরু হবে আগামী ২৬ জুলাই। প্রথম পর্বে লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গোবিন্দগঞ্জ, রংপুর ও গাইবান্ধায় ২৬-৩০ জুলাই সভা সমাবেশ ও মতবিনিময় কর্মসূচি নেয়া হবে। এর মধ্যে সরকার জনগণের পক্ষে পরিস্কার অবস্থান ঘোষণা না করলে ৩১ জুলাই সকালে ঢাকার মুক্তাঙ্গনে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।
জনগণের সম্পদের উপর জনগণের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বাংলাদেশের মানুষ জীবন দিয়েছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। তাদেরকে পরাজিত করবার সাধ্য কারও নাই।
আপনাদের অনেক ধন্যবাদ।