?> উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন ও এশিয়া এনার্জির অপতৎপরতা « NCBD – National Committee of Bangladesh

Friday, November 23rd, 2007

উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন ও এশিয়া এনার্জির অপতৎপরতা

[নিচের লেখাটি ২৩ নভেম্বর ২০০৭ তারিখে জাতীয় প্রেসক্লাবে আলোচনা সভায় পাঠ করা হয়। এ সভায় উপস্থিত ছিলেন খনি অঞ্চলের জনপ্রতিনিধিগণ এবং জাতীয় কমিটির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। সভায় সভাপতিত্ব করেন কমিটির আহ্বায়ক প্রকৌশলী শেখ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কমিটির সদস্য সচিব আনু মুহাম্মদ। আলোচনায় প্রদত্ত জনপ্রতিনিধিগণের বক্তব্য পরবর্তী অংশে তুলে ধরা হয়েছে।]

সাম্রাজ্যবাদের বহুজাতিক কোম্পানিগুলি সারা বিশ্বে কযেক শতাব্দী ধরে লুণ্ঠনযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিরোধ করলে গণহত্যা, সন্ত্রাস, গৃহযুদ্ধ ঘটাচ্ছে ও বাধিয়ে দিচ্ছে। মিথ্যা বিভ্রান্তির জালে সাধারণ জনগণকে অন্ধ করে রাখছে। আশু সমৃদ্ধি ও লাভের চিত্র দেখিয়ে ভবিষ্যতের ধ্বংস ও অভিশাপের চিত্র ঢেকে রাখছে।

দিনাজপুরের ফুলবাড়ী কয়লাখনি নিয়ে তাই ঘটছে। এখানে লুণ্ঠনের নায়ক বহুজাতিক কোম্পানি এশিয়া এনার্জি। কিন্তু এখানে একটু ভিন্নতা আছে। বিভিন্ন সময়ের কৃষক আন্দোলন ও সর্বশেষ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সংগ্রামী হিসেবে দীক্ষা নিয়েছে বাংলাদেশের জনগণ। তদুপরি এই এলাকার জনগণ বিশেষভাবে অধিকার সচেতন ও এদের শ্রেণী সংগ্রামের ঐতিহ্য আছে। কয়লা খনি হলে কী সর্বনাশ হবে তা উপলব্ধি করা মাত্র তারা ফুলে তেঁতে উঠে এবং ২০০৫ সালের জুন মাস থেকে তারা স্থানীয়ভাবে আন্দোলন শুরু করে। বিভিন্ন ধনিক শ্রেণীর প্রতিনিধিগণ ভোটের স্বার্থে তথা স্বীয় বৈষয়িক স্বার্থের কথা মাথায় রেখে স্বার্থহানিকর খনি প্রকল্প বিরোধী জনগণের ক্ষোভ ও আন্দোলন এর নেতৃত্ব দিতে থাকে ফুলবাড়ী রক্ষা কমিটির পতাকা তলে। এর মাধ্যমে তাদের আন্দোলন-প্রচার চালু রাখে।

প্রায় তিন মাস পরে এশিয়া এনার্জি যখন জীবন-জীবিকা ও পরিবেশ-বিধ্বংসী ও সম্পদ পাচারমূলক প্রকল্প বাংলাদেশ সরকারকে দিয়ে গেলানো ও প্রকল্পের মাধ্যমে এলাকার জনসাধারণের কাল্পনিক সমৃদ্ধির প্রচার করে যাচ্ছিল তখন এইসব অপতৎপরতার বিরুদ্ধে জাতীয় পর্যায়ে আন্দোলন শুরু করল তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি, ২০০৫ সালের আগস্ট মাস থেকে। কমিটি এলাকার জনগণসহ সারা দেশবাসী আন্দোলন করে যায়। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট এশিয়া এনার্জির স্থানীয় অফিস ঘেরাও কর্মসূচী পালন করা হয় এবং সেটা শেষ হবার পর যখন সমবেত হাজার হাজার জনগণ ফিরে যাচ্ছিল তখন আচমকা বিডিআর-পুলিশ তাদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। ৩ জন নিহত হন, প্রায় ২০০ জন গুলিবিদ্ধ হন এবং তাদের মধ্যে একজন চিরতরে পঙ্গু হয়ে গিয়েছেন। জনগণের এই আন্দোলনের প্রবল চাপে সরকার আন্দোলনের দাবীগুলো পূর্ণাঙ্গভাবে মানতে বাধ্য হন। ২০০৬ সালের ৩০ আগস্ট দিনাজপুর জেলায় পার্বতীপুর উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি ও আন্দোলনরত উক্ত জাতীয় কমিটির নেতাদের সঙ্গে এক  বৈঠক হয় এবং সব দাবী মেনে নিয়ে সমঝোতা হয়। সমঝোতা স্মারকে সরকারের পক্ষে স্বাক্ষর করেন মিজানুর রহমান মিনু (একজন তৎকালীন সরকারী দলের সাংসদ ও মেয়র, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন) এবং তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।

সমঝোতা স্মারক তথা চুক্তি সম্পাদনের পর খালেদা জিয়া সরকার চুক্তি কার্যকর করার জন্য আন্তরিকভাবে উদ্যোগ নেয়া থেকে বিরত থাকে তবে কখনই চুক্তিকে অস্বীকার করেনি। কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে এটর্নী জেনারেল মত দিয়েছেন যে, তেল-গ্যাস কমিটি কোন স্বীকৃত, বৈধ, আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্বত্ত্বা নয়। অতএব এ ধরণের কমিটির সঙ্গে সরকারের চুক্তির কোন কার্যকারিতা নেই। কিন্তু বিচারপতি গোলাম রাব্বানী ৩০ আগস্ট ২০০৭ তারিখে ঢাকায় সাংবাদিক সম্মেলনে পঠিত ফুলবাড়ী  গণ আন্দোলন এবং সমঝোতা স্মারক সংক্রান্ত আইনী মতামত” প্রবন্ধে নিম্নলিখিত যুক্তি দিয়ে সরকারের কু-যুক্তি প্রত্যাখান করেন।

সমঝোতা স্মারকের প্রথম শর্তটিতে লেখা আছে যে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রাণহানির ঘটনায় শোক প্রকাশ করে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়েছে। এই শর্তটির আইনি দিক হচ্ছে ২৬ আগস্টের আন্দোলন ও আন্দোলনকারী জনগণের দাবী অযৌক্তিক ছিল না, যথার্থ ছিল। দ্বিতীয় শর্তটিতে(ক) থেকে (ছ) মোট সাতটি উপশর্ত আছে।

(ক)  এশিয়া এনার্জির সাথে সকল চুক্তি বাতিল করে এশিয়া এনার্জিকে বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহার করা হবে, বাংলাদেশের কোথাও উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা খনি হবে না ও অন্য পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনে জনগণের সম্মতি লাগবে।

(খ)  ২০০৬ সালের ২৬ আগস্টে গুলিতে নিহত প্রত্যেক পরিবারকে দুই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে।

(গ)  আহতদের ও ভাংচুরে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্য নয় লাখ টাকা বরাদ্দ করা হবে এবং স্থানীয় কয়েকজন সরকারি কর্মচারি ও জাতীয় কমিটির ফুলবাড়ী শাখার দুজন প্রতিনিধিদেরকে নিয়ে গঠিত কমিটি কর্তৃক ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে।

(ঘ)  গুলিতে নিহত ঘটনার তদন্তের জন্য অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে তার তদন্তের প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।

(ঙ)  হত্যা করে গুম করে লাশ উদ্ধার বিষয়ে উভয়ের পক্ষে এই উপশর্তে লিখিত ব্যক্তিদের নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হবে ও প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।

(চ)   নিহতদের নামে ফুলবাড়ী নতুন ব্রিজের পাশে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হবে।

(ছ)  এশিয়া এনার্জির চিহ্নিত দালালদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ সুপার ব্যবস্থা নিবেন এবং আন্দোলনের সাথে সংশি¬ষ্টদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত অভিযোগ ও মামলা প্রত্যাহার করা হবে ও নতুন কোন মামলা করা হবে না।

উপরোক্ত চুক্তিটির অংশবিশেষ সরকার পালন করেছে সেগুলো হচ্ছে এশিয়া এনার্জি তাদের ফুলবাড়ীসহ চারটি থানার শাখা প্রত্যাহার করে নিয়েছে কিন্তু কোম্পানির অফিস যেখানে ছিল সেখানে এখনও আছে। ঢাকায় কোম্পানি নানা চক্রান্তে লিপ্ত আছে। স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য বরাদ্দকৃত জেলা কর্তৃপক্ষের কাছে চার লাখ টাকা জমা আছে, কিন্তু সেটা নির্মাণের এখন পর্যন্ত উদ্যোগ নেই এবং আন্দোলনের  সঙ্গে সংশি¬ষ্টদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত অভিযোগ ও মোকদ্দমা প্রত্যাহার করা হয়েছে, কিন্তু দালালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। দেখা যাচ্ছে, সরকারের স্থানীয় প্রশাসন সমঝোতা স্মারকের কয়েকটি শর্ত পালন করেছে। যার ফলে সমঝোতা স্মারকের এক পক্ষ যে সরকার এটা স্বীকৃত সত্য হয়ে গিয়েছে। বিষয়টি আর কোন সাপেক্ষ সত্য কিংবা মিথ্যা নয়। কন্ট্রাক্ট অ্যাক্ট বা চুক্তি আইনের নীতিমালার একটি হচ্ছে চুক্তিপত্রের কোনো এক পক্ষ যদি চুক্তির কোনো শর্ত পালন করে থাকে তবে সে চুক্তিটি আইনত: কার্যকর হয়ে গিয়েছে এবং তার বাকী শর্তগুলোও তখন সে পালন করতে বাধ্য।

বর্তমান অবস্থা:

বর্তমান সরকার ধনিক শ্রেণীর রাজনৈতিক সঙ্কট উত্থিত একটি ভিন্নধর্মী কর্মতৎপর সরকার। শ্রেণীগতভাবে এই সরকারও ধনিক শ্রেণীর ও সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থরক্ষাকারী সরকার।

এই সরকার কোন বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে নির্বাচিত বড় বড় দুর্নীতিবাজ ধরা হচ্ছে যারা জনগণের কাছে সুবিদিত। কিন্তু তাদের চেয়ে বহুগুণে বৃহৎকায় বহুজাতিক কোম্পানী যারা আমাদের দেশের হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ লুণ্ঠন করে যাচ্ছে, অতীতেও করেছে এবং দেশীয় ধনিক শ্রেণীর ব্যবসাজীবী আমলা, বুদ্ধিজীবী যারা সামান্য লাভের বিনিময়ে দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলী দিয়ে বহুজাতিক কোম্পানির লুণ্ঠনের সুযোগ করে দিচ্ছে এইসব বিশ্বাসঘাতক অপরাধীদের পাকড়ার করার ব্যাপারে কোন উদ্যোগ দৃষ্ট হয়না।

এশিয়া এনার্জির অপতপরতাঃ

মাত্র ৫/৬ বছর আগে এশিয়া এনার্জি ফুলবাড়ী খনি এলাকার শুধু জরিপ কাজের চুক্তি পায়। জরিপ কাজ শেষ করার পর পরই তাদের প্রকল্প এলাকা ত্যাগ করে চলে যাবার কথা কিন্তু তারা তা না করে তাদের অফিস পূর্ণ শক্তিতে চালু রেখে তাদের প্রস্তাবিত উন্মুক্ত মুখ খনন পদ্ধতির স্বপক্ষে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের প্রচার এই মর্মে যে, প্রস্তাবিত প্রকল্প স্থানীয় জনগণের জীবন-জীবিকার দুর্ভোগ সৃষ্টি করবেনা বরং উন্নততর জীবনের বহু ধরনের স্বাদ উপহার দেবে। তখন (২০০৫ সাল) থেকেই স্থানীয় জনগণ এশিয়া এনার্জি অফিসের কার্যক্রম, প্রচার প্রচারণার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে যায়। এই ক্ষোভের মহাবিষ্ফোরণ ঘটে ২৬ আগস্ট ২০০৬ তারিখ গণবিক্ষোভে। বস্তুতঃ ৩০ আগস্ট ২০০৬ সমঝোতা স্মারকের একটি বড় শর্ত হচ্ছে এশিয়া এনার্জিকে ফুলবাড়ী তথা বাংলাদেশ থেকে উৎখাত করা।

গণঅভুত্থান উত্তর তপরতাঃ

এশিয়া এনার্জি এখন তাদের প্রত্যাখানযোগ্য প্রকল্পকে সমৃদ্ধিজনক প্রকল্প হিসাবে চিত্রিত করার জন্য ব্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছে। তার একটি হচ্ছে Ñ জাতীয় ও স্থানীয় সংবাদপত্রে পূর্ণপৃষ্ঠাব্যাপী বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সংবাদপত্র মালিকদের উৎকোচ প্রদান করেছে। এছাড়া স্থানীয় প্রভাবশালীদের নানা ধরনের সুবিধা প্রদান করা হয় তথা উৎকোচ প্রদানের ক্লাবে বিভিন্ন ক্ষুদ্র সভায় আপ্যায়ন করে তাদের পক্ষে টানছে।

বর্তমান সরকারের জ্বালানী উপদেষ্টা তপন চৌধুরী এশিয়া এনার্জির পিঠ চাপড়ে বলেছেন ‘আপনারা যদি ফুলবাড়ী এলাকার জনগণের মন জয় করতে পারেন তবে সরকারের পক্ষে আপনাদের সঙ্গে চুক্তি করার পথ সুগম হবে’।

এইভাবে সরকারের কাছ থেকে ‘লাই’ (আবদারী প্রশয়) পেয়ে তারা পূর্বের তুলনায় শতগুণ শক্তি নিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছে, বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। তারা সংবাদিকদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। তাদের জার্মানির হাম্মাচ কয়লাখনি ঘুরিয়ে এনেছে। জার্মানির ক্ষেত্র যে আমাদের দেশের ক্ষেত্র থেকে এত ভিন্ন যে, একদেশে যা সম্ভব অন্য দেশে তা অসম্ভব হলে অবাক হবার কিছু নেই। কিন্তু জার্মান ভ্রমণের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে এদেশেও উন্মুক্তমুখ খনন পদ্ধতি প্রয়োগ করার যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে চাচ্ছে।

কয়েক মাস আগের দালাল রূপান্তর ক্রিয়ার অংশ হিসাবে স্থানীয় সাংবাদিকদের নিয়ে সাভারে এক অডিটরিয়ামে কয়েকদিন ট্রেনিং এর মাধ্যমে এশিয়া এনার্জির পক্ষে বিভ্রান্তির যুক্তি শেখানো হয়েছে।

বর্তমানে যে বিশেষজ্ঞ কমিটি ড. আব্দুল মতিন পাটোয়ারীর নেতৃত্বে কয়লা নীতি চূড়ান্ত করার পথে তাদের সুপারিশ এশিয়া এনার্জির সপক্ষে আনার জন্য গুরুতরভাবে লবিং করে যাচ্ছে।

আইনের রক্ষাকর্তা হয়ে নিজেরাই বে-আইনী কাজঃ

সরকার ৩০ আগস্ট ২০০৬ এর সমঝোতা স্মারক এ আমাদের কমিটির বোনাফাইড নিয়ে অসঙ্গতভাবে প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু এশিয়া এনার্জি যাদের প্রকৃতই বোনাফাইড একেবারে অনুপস্থিত তাদের এদেশে অবস্থান ও প্রচারণা নিয়ে সরকারের কোন মাথা ব্যাথা নেই। শুধু এশিয়া এনার্জির বে-আইনী কাজে নীরব সমর্থন নয় উৎসাহ দান করা হচ্ছে।

জনগণের করণীয়ঃ

আমাদের আন্দালনের ভিত্তি অত্যন্ত শক্তিশালী। আমাদের ব্যাপকভাবে পুস্তিকাসহ নানা প্রচার মাধ্যম ব্যবহার করে এশিয়া এনার্জির বিভ্রান্তিকর প্রচারণা থেকে জনগণকে সুরক্ষিত করতে হবে। জরুরী অবস্থা অন্তে গণআন্দোলনের জন্য পরিকল্পনা করে রাখতে হবে।

উন্মক্ত খনন পদ্ধতি ও এশিয়া এনার্জির অপতপরতা বিষয়ে জনপ্রতিনিধিদের বক্তব্য

‘মানুষের দাম নাই, কয়লার দাম আছে, এটা আমরা কোনদিনও মানব না’Ñ প্রেস ক্লাবে উপস্থিত অতিথি ও সাংবাদিকদের সামনে এই প্রত্যয় ব্যক্ত করেন ফুলবাড়ী এলাকার বিশিষ্ট সংগঠক জয়প্রকাশ গুপ্ত। গত ২৩ নভেম্বর, ২০০৭ জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত ফুলবাড়ী আন্দোলনের প্রতিনিধি ও নেতৃবৃন্দের কণ্ঠে এলাকার অধিবাসীর আকাঙ্ক্ষা ও লড়াই এর যে চিত্র ফুটে উঠেছিল তা যেন এই একটি বক্তব্যের মধ্যেই বিম্বিত। ‘উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি ও এশিয়া এনার্জির অপতৎপরতা’ শীর্ষক এই আলোচনাটির আয়োজন করে তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি। কমিটির আমন্ত্রণে ফুলবাড়ী থেকে আসা প্রতিনিধিদের মাঝে যেমন ছিলেন আন্দোলনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ, তেমনি ছিলেন তৃণমূল থেকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত আদিবাসী নারী-পুরুষ, রিক্সা-ভ্যানচালক, নির্মাণ শ্রমিক, কয়লা খনির শ্রমিক, কলেজের শিক্ষকসহ ২৬শে আগস্টের সহিংসতার চিহ্ন বহন করে বেঁচে থাকা মাঠ পর্যায়ের কর্মী। প্রতিনিধিদের সম্মিলিত বক্তব্যে প্রতিধ্বনিত হয় উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন, কয়লা রপ্তানি ও বহুজাতিক পুঁজির বিরুদ্ধে সুদঢ় প্রত্যয়।

‘যে জমিতে ১ বছরে ১০০ মণ ধান হয় সেখানে কেন জমি নষ্ট করে সরকার উন্মুক্ত পদ্ধতি করার পক্ষে নমনীয় আমরা জানি না।’ Ñ বলেন কলেজ শিক্ষক সমিতির প্রতিনিধি শাহ মোঃ ইলিয়াসুর রহমান। একই উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেন নির্মাণ শ্রমিক মোঃ আলাউদ্দিন। বলেন, আমরা কেয়ামত পর্যন্ত যে ফসল পাব সেটা ৩০ বছরের প্রকল্পের জন্য কেন ধ্বংস করব? বাস্তভিটা ও ফসলী জমি হারানোর এই দুঃশ্চিন্তার পাশাপাশি আরও উঠে আসে পরিবেশ বিষয়ক সচেতনতা ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও বহুজাতিক কোম্পানির ষড়যন্ত্রমূলক ক্রিয়াকলাপের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ। জাতীয় কৃষক ও ক্ষেতমজুর সমিতির সংগঠক শিকদার এই দিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, আমার বেকার যুবককে কাঁচা টাকা, মদ ধরিয়ে, সহজ সরল কৃষককে মেয়ের বিয়ের না দেয়ার গ্লানির সুযোগ নিয়ে এশিয়া এনার্জি অপতৎপরতা চালায়। উল্লেখ্য, এই সম্মেলনটির আয়োজন করা হয় এমন একটি সময়ে যখন আন্দোলনের এক বছরেরও বেশী পরে নতুন করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমে এশিয়া এনার্জি ও তার দোসরদের নানা ধরণের অপতৎপরতা লক্ষ্য করা যায়।

ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত খনন পদ্ধতির পরিবেশগত, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে ফুলবাড়ীবাসীর সংঘবদ্ধ লড়াই এবং সরকারী ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দুর্নীতির শিকার এই এলাকার জনগণের মনের কথা সহজ ভাষায় তুলে ধরেন সায়েমা বেগম নামের একজন নারী সংগঠক। তিনি বলেন,  আমরা খনি চাই এ কথা কে বলেছে? এই ব্যাটা ‘দালাল’, যে বলেছে যে কিছু লোককে খুশী করলেই খনি করা যাবে। …..বাংলাদেশের সম্পদ বাংলাদেশেই তুলব। আশা করি এশিয়া এনার্জিকে দেশ থেকে অতি তাড়াতাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা সরকার আমাদের করে দেবে। আরও অনেকের মতো কমলচন্দ্র সাহারও দৃঢ় অঙ্গীকার Ñ ‘মায়ের ইজ্জতকে রক্ষা করতে গিয়ে যদি শেষ রক্তও দিতে হয়, আমরা দোকান-কর্মচারী পরিষদ সেই কর্তব্য পালন করব।’ মিছিলে গুলিবর্ষণে আহত প্রদীপ সরকারের মন্তব্য Ñ ‘এশিয়া এনার্জিকে দেশছাড়া করতে আমরা রক্ত দিয়েছি। আরও দিব। যতদিন তারা বিতাড়িত না হয় ততদিন আমাদের সংগ্রাম চলবেই।’

এশিয়া এনার্জি ও স্থানীয় দালালদের বিভিন্ন অপতৎপরতার প্রতিবাদে মুখর ছিলেন আদিবাসী প্রতিনিধিরাও। জাতিগত পার্থক্যের অজুহাতে তাঁদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গী ও প্রচারের নিন্দা করে রামাই সরেন বলেন, ‘দালালরা আদিবাসীদের নাম ভাঙিয়ে অপতৎপরতা চালাচ্ছে। আদিবাসীরা কম বোঝে এইটা ঠিক না। তারা নাকি দালালদের সমর্থন জানিয়েছে। তারা কখনো এত মূর্খের মতো কাজ করবে না।’ আদিবাসী নারী শ্রীমতি মূর্মূর কণ্ঠে ছিল তারই প্রমাণ যিনি স্পষ্টই বলেন, ‘আমরা ফুলবাড়ী কয়লা খনি চাই না। আমাদের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ। আমাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই চলে গেলে আমরা কোথায় যাব?’

এবারেই প্রথমবারের মতো ফুলবাড়ী আন্দোলনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে শরীক হন ফুলবাড়ীর অদূরে অবস্থিত বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি আন্দোলনরত শ্রমিকগণ। বড়পুকুরিয়া খনিতে বেতন বৃদ্ধি, বোনাস আদায়, স্বাস্থ্যসেবা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও সর্বোপরি দুর্নীতি বন্ধের দাবীর সাথে সাথে তাঁরা ফুলবাড়ী ও বড়পুকুরিয়াতে সম্ভাব্য উন্মুক্ত খনন করার বিরুদ্ধেও সোচ্চার মতবাদ ব্যক্ত করেন। ফুলবাড়ীর জনগণের সাথে একাত্মতা  ঘোষণা করে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি শ্রমিক অধিকার আন্দোলন-এর এক নেতা বলেন, ‘প্রয়োজনে আমাদের লাশ পড়ে যাবে কিন্তু কোন কয়লা আমরা দেব না।… কোন বিদেশী  কোম্পানীকেই আমরা ‘ওপেন পিট’ করতে দেব না।’ অতি স¤প্রতি সরকারের কাছে পেশকৃত খসড়া কয়লানীতিতে বড়পুকুরিয়াতে পরীক্ষামূলকভাবে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খনন করবার যে সুপারিশ রয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রতিবাদ নিঃসন্দেহে আন্দোলনে একটি নতুন মাত্রা যোগ করবে।

আলোচনাকালে আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের কণ্ঠে যেমন ছিল লড়াই চালিয়ে যাবার অঙ্গীকার। তেমনই ছিলো ফুলবাড়ী ও ঐ এলাকার অধিবাসীর বাস্তবতা পর্যালোচনা করার জন্য সকলের প্রতি দৃপ্ত আহ্বান। ফুলবাড়ীতে জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক সৈয়দ সাইফুল ইসলাম জুয়েল ও বিশিষ্ট নেতা আমিনুল ইসলাম বাবলু দুজনেই ফুলবাড়ীর মানুষের সাথে কথা বলা ও ফুলবাড়ীর সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করতে সরকার ও সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান জানান। অন্যথায় আন্দোলন আরও সুসংগঠিত ও তীব্র আকার ধারণ করবে এই হুঁশিয়ারিও বিভিন্ন বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে উঠে। বিরামপুরের সংগঠক রফিকুল ইসলাম সরকার জানান, ‘আমরা আগের চাইতে অনেক সুসংগঠিত। ফুলবাড়ীর মানুষ লাঠি হাতে জেগে আছে’। উপস্থিত সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের উদ্দেশ্য করে আব্দুল মজিদ বলেন, ‘আপনারা কৃষকদের সাথে কথা বলেন। পয়সা নিয়ে দেশের সাথে বেঈমানী করবেন না’। মধ্যপাড়ার সংগঠক ও নেতা হাফিজারের বক্তব্যও এক্ষেত্রে স্পষ্ট Ñ  ‘এদেশের মানুষ তার নিজের সম্পদ চিনতে ভুল করে না। আজকে যদি কোন সরকার আমার দেশের সম্পদ কোন বেনিয়াদের হাতে দিয়ে দেয় তা রক্ষা করার অধিকার আমাদের আছে।’ খয়েরবাড়ী ইউনিয়ন থেকে আসা আবু তাহের-এর হুশিয়ারী: ‘শুধু এশিয়া এনার্জি কেন, আমরা সব ‘এনার্জিকে’ উদ্দেশ্য করে বলছি, আর কোন ২৬শে আগস্ট যেন না হয়।’

এই একই চেতনায় উদ্দীপ্ত বক্তব্য রাখেন কনফারেন্সে উপস্থিত সকলেই। এই দলে যেসব সংগঠন উপস্থিত ছিলো সেগুলো হলো Ñ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, ফুলবাড়ী কম্যান্ড কাউন্সিল, বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি শ্রমিক অধিকার আন্দোলন, ফুলবাড়ী ব্যবসায়ী সমিতি, জাতীয় আদিবাসী সমিতি, আদিবাসী ইউনিয়ন, ফুলবাড়ী কুলি শ্রমিক ইউনিয়ন, ফুলবাড়ী নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়ন, কলেজ শিক্ষক সমিতি, জাতীয় কৃষক ক্ষেতমজুর সমিতি, ফুলবাড়ী দোকান কর্মচারী ইউনিয়ন, ফুলবাড়ী থানা রিক্সা-ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়ন ও খানপুর ইউনিয়ন পরিষদ। এর সাথে আরও উপস্থিত ছিলেন ২৬ শে আগস্টের বাংলাদেশ রাইফেলস এর গুলিতে গুরুতর আহত প্রদীপ সরকার এবং জাতীয় কমিটির ফুলবাড়ীর শাখার আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবসহ খয়ের বাড়ী, খানপুর, বিরামপুর, পার্বতীপুর, রতনপুর, হাকিমপুর ও ফুলবাড়ীর বিভিন্ন স্তরের নেতা ও কর্মী।