Thursday, March 1st, 2007
জাতীয় স্বার্থবিরোধী কয়লানীতি প্রণয়ন করা চলবে না, জনগণের স্বার্থে জ্বালানী নীতি প্রণয়ন করুন
সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জ্বালানী উপদেষ্টা গত সরকারের সময় প্রণীত কয়লানীতি এই মার্চ মাসের মধ্যেই চূড়ান্ত করতে যাচ্ছেন। আমরা এই খবরে বিস্মিত ও উদ্বিগ্ন। যেখানে বর্তমান সরকার দুর্নীতি ও অনিয়ম দূর করবার অঙ্গীকার প্রকাশ করছেন সেখানে দুর্নীতি ও অনিয়মের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জ্বালানী সম্পদ বিদেশী কোম্পানির হাতে তুলে দেয়ার নীতি বহাল রাখা স্ববিরোধী ও জাতীয় স্বার্থের জন্য হুমকিস্বরূপ। গত সরকারের জ্বালানী উপদেষ্টা এই কয়লানীতির উপর ভর করেই ধ্বংসাত্মক ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, বর্তমান জ্বালানী উপদেষ্টাও একই সুরে কথা বলছেন। জাতীয় স্বার্থ বিরোধী দুষ্টনীতি বহাল রেখে দুর্নীতি কিভাবে দূর করা সম্ভব সেটাই আমাদের প্রশ্ন।
এই নীতি প্রণয়নের জন্য সাবেক সরকার দায়িত্ব দিয়েছিলেন “ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ফ্যাসিলিটেশন সেন্টার”কে। জ্বালানি বিশেষায়িত জ্ঞান যার বিষয় নয়, উন্নয়ন পরিকল্পনা যার অগ্রাধিকার নয়, ব্যক্তিগত ও প্রধানত বিদেশী ব্যবসায়িক দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা যার প্রধান কাজ সেই সংস্থাকে কয়লা নীতি প্রণয়নের দায়িত্ব দিয়েছিলেন সাবেক সরকার। সাবেক সরকারের নীতিগত অবস্থান তাই কয়লা নীতি করবার আগেই পাওয়া গেছে, তা হলো, কয়লা সম্পদকে বিদেশী ব্যবসায়িক মালিকানায় হস্তান্তর, জনগণের সম্পত্তি ব্যক্তিগতকরণ এবং তার ধারাবাহিকতায় কয়লা সম্পদ বিদেশে পাচারকে বৈধতা দান। সেকারণে বাংলাদেশে কয়লা সম্পদের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহারের জন্য দক্ষ জনশক্তি ও উপযোগী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কোন ভিশন এই কয়লা নীতিতে নেই। আছে বাংলাদেশের ‘অক্ষমতা’ আর ‘অনভিজ্ঞতা’কে অজুহাত করে বিদেশী কোম্পানির হাতে দেশের সব সম্পদ দিয়ে দেয়ার নীতি।
কয়লানীতির এই দলিলের মধ্যেই তাই টাটাকে বড়পুকুরিয়া এবং এশিয়া এনার্জিকে ফুলবাড়ীর ইজারাপ্রাপ্ত দেখিয়ে প্রাক্কলন করা হয়েছে। এই নীতির কেন্দ্রীয় মনোযোগ যেহেতু, ‘আভ্যন্তরীণ বাজার সীমিত’ সেহেতু, ‘বিনিয়োগকারীদের বৃহৎ বিনিয়োগের টাকা তুলবার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ রপ্তানির অনুমতি দিতে হবে’। আমাদের প্রশ্ন অভ্যন্তরীণ চাহিদা যদি সীমিতই থাকে তাহলে এত ধ্বংসযজ্ঞ করে কয়লা উত্তোলন কেন করতে হবে? নীতিতে বলা হয়েছে ‘দীর্ঘমেয়াদে দেশের জ্বালানী নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে সর্বোচ্চ পরিমাণ কয়লা উত্তোলনের মাধ্যমে’-এর একমাত্র পথ উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন। সর্বোচ্চ পরিমাণ কয়লা উত্তোলন করলে, তার দেশীয় চাহিদা যেহেতু সীমিত, কাজেই রপ্তানি করতেই হবে। তার মানে এই নীতি অনুযায়ী, নিজেদের প্রয়োজন না থাকলেও মানুষের পরিবেশ-অর্থনীতি ধ্বংস করে বেশী বেশী কয়লা উত্তোলন করে তা দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিলেই জ্বালানী নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে!
আমরা মনে করি, কয়লাসহ জ্বালানী সম্পদের দীর্ঘকালীন মজুত রাখা আর তার সর্বোত্তম ব্যবহারের জন্য দেশে সক্ষমতা তৈরির ওপরেই দেশের জ্বালানী নিরাপত্তা নির্ভর করে। সামান্য রয়্যালটির বিনিময়ে সবকিছু ছারখার করে নিজেদের খনিজ সম্পদ পাচার করে দেয়া কোম্পানি বা কতিপয় ব্যক্তির বড় লাভের ব্যাপার হলেও দেশের জন্য সেটি ভয়ঙ্কর পরিণতি ডেকে আনতে বাধ্য। এই নীতি এরকম প্রকল্পকেই বৈধতা দেবার লক্ষ্যে প্রণয়ন করেছিলেন সাবেক সরকার। আমরা আশা করি এরকম জাতীয় স্বার্থবিরোধী ও ধ্বংসাত্মক নীতি বাতিল করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশের জনগণের শতকরা ১০০ ভাগ মালিকানা রেখে খনিজ সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের জন্য যথোপযুক্ত জ্বালানী নীতি প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।