?> মডেল পি.এস. সি-২০০৮: ‘‘সহজ পাঠের’’ জটিলতা! « NCBD – National Committee of Bangladesh

Friday, June 24th, 2011

মডেল পি.এস. সি-২০০৮: ‘‘সহজ পাঠের’’ জটিলতা!

ভুমিকা

কেউ কেউ ধারনা করেন যে গ্যাসক্ষেত্র বিদেশী কোম্পানীকে গ্যাস আবিষ্কার উত্তোলনের জন্য প্রদান করা, বর্গাদার কর্তৃক বর্গাচাষীকে জমি ভাড়া দেয়ার মতোই অনুরূপ একটি বিষয়। কয়েকটি কারণে এই তুলনাটি এক্ষেত্রে একটু সাবধানে আমাদের গ্রহণ করতে হবে। কারণগুলি নিম্নরূপ-

ক) প্রথমতঃ এই বিশেষ ক্ষেত্রে বর্গাদার হচ্ছে খুবই দুর্বল এবং গরীব এবং বর্গাচাষী হচ্ছে প্রবল প্রতাপান্বিত এক শক্তি। গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদন-বণ্টন চুক্তিকে ‘সহজ পাঠের’ খাতিরে যদি আমরা বর্গার সঙ্গে তুলনাও করি মনে রাখতে হবে তা হচ্ছে অর্থনীতির ভাষায় একটি বিপরীত বর্গার (Inverse Sharecropping) দৃষ্টান্ত। এখানে গ্যাসক্ষেত্রটি বর্গা দিচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ বাংলাদেশ এবং বর্গা নিচ্ছেন প্রবল প্রতাপান্বিত বহুজাতিক কোম্পানী কনকোফিলিপস। এখানে ক্ষমতার অসমতা এবং অপ্রতিসম তথ্যের (Information Asymmetry) প্রতিকূলতা বিদ্যমান।

খ) দ্বিতীয়তঃ গ্যাস ক্ষেত্রের ইজারায় ইজারাদারের ঝুঁকির পরিমান বেশী হওয়াই স্বাভাবিক বলে মনে হয়। কারণ এমন হতে পারে যে পুরো অভিযান চালানোর পর কোন গ্যাসই পাওয়া গেল না। অথবা যতটুকু গ্যাস পাওয়া গেল তা বাণিজ্যিক উত্তোলনের জন্য উপযোগী নয় (অর্থাৎ তুলতে যা খরচ বিক্রি করে তত দাম নাও পাওয়া যেতে পারে )। তখন ইজারাদারের পুরো Investment মাঠে মারা যাবে। আমাদের অবশ্য তখন কোন ক্ষতিও নাই, লাভও নাই। আর গ্যাস আবিষ্কৃত হলে Investment-টি লাভজনক হবে কি না তার সবটাই আবার নির্ভর করবে খরচ কত হচ্ছে এবং কি দামে কতটুকু গ্যাস বিক্রি হচ্ছে তার উপর। আবিষ্কৃত গ্যাসে ইজারাদারের শেয়ার কতটুকু থাকছে সেটাও গুরুত্তপুর্ন নির্ধরক বিষয়। তবে যদি গ্যাসক্ষেত্রের মালিকের গ্যাস প্রাপ্তির সম্ভাবনা সম্পর্কে সঠিক তথ্য জ্ঞান না থাকে, পক্ষান্তরে ইজারাদার কোম্পানীটি যদি নিশ্চিত তথ্যের অধিকারী হয় তাহলে এই তথ্য অপ্রতিসমতার কারণে ইজারাদার ইজারামালিককে নানা মিথ্যা ঝুঁকির কথা বলে নিজের জন্য অনেক বেশী শেয়ার দাবী করতে পারেন। একইভাবে  বেশী দামে  বিক্রির স্বাধীনতাও চাইতে পারেন। সাধারন বর্গায় বা ইজারায় এধরনের সমস্যা নেই।

গ) বর্গা যেমন নগদ সন জমায় হতে পারে আবার অর্ধেক-অর্ধেক বা তেভাগা চুক্তিতেও হতে পারে। কিন্তু উৎপাদন-বণ্টন চুক্তিতে প্রথমে ইজারাদারকে তার খরচ মিটিয়ে দিতে হয়, পরবর্তীতে প্রফিট-গ্যাসের শেয়ার ভাগাভাগি করে নিতে হয়। এক্ষেত্রে ইজারাদার খরচ বেশী দেখিয়ে আবিষ্কৃত গ্যাসের প্রায় পুরোটাই নিয়ে নিতে পারেন। তখন প্রফিট-গ্যাস অবশিষ্ট থাকবে সামান্য এবং তার বড় অংশ ইজারা মালিক পেলেও সামগ্রিক ভাবে তার অংশ সামান্যই থেকে যাবে! তদুপরি কষ্ট-রিকভারির জন্য শেয়ার কতটুকু হবে বা প্রফিট গ্যাসের শেয়ারই বা কতটুকু হবে তা মূলত: নির্ভর করবে ইজারাদার ইজারাপ্রদানকারীর পারস্পরিক দর  কষাকষির ক্ষমতার উপর। যদি ইজারাদার শক্তিশালী হয় তাহলে সে মোট গ্যাসের সিংহভাগের অধিকারী হবে এবং ইজারামালিককে হয়তো মোট গ্যাসের বা মোট বিক্রয়লব্ধ অর্থের নগণ্য অংশ পেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। তখন তার অংশ মোট গ্যাসের তিন ভাগের এক ভাগও নাও হতে পারে।  নগদ টাকায় বা বিক্রয়লব্ধ অর্থের ভাগ-ভাটোয়ারার ভিত্তিতে যদি চুক্তি হয় তাহলে আরেকটি খুবই সংবেদনশীল প্রশ্ন  এসে যাবে তা হচ্ছে গ্যাস কোথায়, কার কাছে এবং কি দামে বিক্রি করা হবে-তার উপরই নির্ভর করবে মোট প্রাপ্ত অর্থ এবং সেটার থেকে কে কতটুকু নিবেন সেটা নির্ভর করবে ভাগ-বাটোয়ারার পূর্বনির্ধারিত সুনির্দিষ্ট চুক্তির উপর এবং আবিষ্কৃত উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের পরিমানের উপর। এক্ষেত্রে বিক্রেতা সর্বদাই চাইবেন সর্বেচ্চ পরিমানে এবং সর্বোচ্চ  দামে গ্যাস বিক্রি করতে কারন তাতে তার পুঁজি মুনাফা সবচেয়ে দ্রুত উঠে আসবে।

এই সতর্কতাসূচক উপপাদ্যগুলি মনে রেখে আমরা যদি মডেল পিএসসি ২০০৮ চুক্তিটির ব্যবচ্ছেদ করি তাহলে আমাদের সম্ভাব্য বাস্তব অবস্থাটা কি দাঁড়াচ্ছে?

বাস্তব সম্ভাব্য অবস্থা ?

আমাদের আলোচ্য চুক্তিতে ভাগাভাগির ধরনটিই এমন যে মোট গ্যাসের ৫৫ শতাংশ বিদেশী বিনিয়োগকারীকে দিতে হবে তার “কষ্ট রিকভারী” গ্যাস হিসাবে। বাকি যে ৪৫% গ্যাস থাকবে সেটাই বিভিন্ন অনুপাতে কনকোফিলিপ আমাদের মধ্যে ভাগাভাগি হবে। এই অনুপাতগুলি হচ্ছে দরকষাকষির বিষয় এবং তা চুড়ান্ত করা হয় ফাইনাল চুক্তি স্বাক্ষরের মুহূর্তে। সেটা এখনো পর্য়ন্ত চুক্তির গোপনিয়তার কথা বলে জনগণকে জানানো হয়নি! একটি সাধারন অনুমান হচ্ছে যে তা অর্ধেক-অর্ধেক ভাগ হবে। তাহলে কিন্তু আমরা সবমিলিয়ে পাবো মোট গ্যাসের মাত্র ২২.৫০% আর কনকোফিলিপ পাবে ৭৭.৫০%। ”সহজ  পাঠের” লেখক অবশ্য (দেখুন তামিম, গ্যাস পাদন অংশীদারি চুক্তির সহজ পাঠদৈনিক প্রথম আলো, ২২ শে ফে: ২০১১) দাবী করেছেন যে গভীর সমুদ্রের গ্যাসের ক্ষেত্রে এই অংশটি প্রতিদিনের উৎপাদন মাত্রা অনুযায়ী নিধারিত হবে এবং তার সর্বোচ্চ পরিমানটি প্রফিট গ্যাসের ৭৫ শতাংশ এবং  সর্বনিম্ন  পরিমানটি ৫০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। অর্থাৎ সামগ্রীকভাবে এই চুক্তির মাধ্যমে মোট গ্যাসের (কষ্ট রিকভারি গ্যাস+ প্রফিট গ্যাস ) সর্বনিম্ন ২২.৫০ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ ৩৩.৭৫ শতাংশ গ্যাস বাংলাদেশ) পেতে পারে। পক্ষান্তরে Cost recovery এবং নিজস্ব প্রফিট হিসাবে কনোকো ফিলিপস সর্বোচ্চ ৭৭.৫০ শতাংশ থেকে ৬৬.২৫ শতাংশ পাবে। এখানে আমরা অবশ্য ধরে নিয়েছি ৫৫% গ্যাসের দ্বারা কষ্ট রিকভারি কমপ্লিট হয়ে যাবে। যদি তা না হয় তাহলে আমাদের গ্যাসের শেয়ার এরপরেও আরো কমবে। আর যদি আরো কম গ্যাসেই কষ্ট-রিকভারি হয়ে যায় (অর্থাৎ পেট্রোবাংলা যদি সর্বোচ্চ দেশপ্রেম নিয়ে কষ্ট মনিটর করে) তাহলে হযতো শেয়ার বাড়বে। কিন্তু তামিম সাহেব যদি রপ্তানীর সুযোগ সংক্রান্ত ধারাবলিও এখানে পাশাপাশি তুলে ধরতেন তাহলে পুর্ণাঙ্গ সত্য প্রকাশ পেত। তখন দেখা যেত ভাগ-বাটোয়ারার পুর্বনির্ধারিত সম্ভাব্য অনুপাতটি হচ্ছে ৮০.২০।

কথা ধরে নেয়া যেতে পারে যে বঙ্গোপসাগরের যে ব্লকগুলি জরীপের জন্য ইজারা দেওয়া হয়েছে সেগুলিতে গ্যাস বা তেল প্রাপ্তির শতকরা পঞ্চাশভাগের বেশি সম্ভাবনা না থাকলে এতগুলি কোম্পানী (৬-৮টি) এই ইজারায় অংশগ্রহণ করতেন না। লাভের উজ্জ্বল সম্ভাবনা আছে বলেই তারা এসেছেন। অতএব গ্যাস অথবা তেল হয়তো পাওয়া যাবে! আমাদের দিক থেকে সবচেয়ে ভাল হোত যদি উপযুক্ত তথ্য ভিত্তিক জ্ঞানের ভিত্তিতে বাংলাদেশ সরকার স্বয়ং বা পিপিপি’র অধীনে বেসরকারী-সরকারী খাত মিলে এই জরীপের কাজটা আমরা নিজেরাই সম্পন্ন করতে পারতাম। সে জন্য যেটুকু অর্থ প্রযুক্তি লাগতো তা নিজেরাই যদি সংগ্রহ করতে পারতাম তাহলে তা সম্ভব হোত এবং সেই চেষ্টাটাই আমাদের সর্বাগ্রে করতে হোত। তাহলে আবিষ্কৃত পুরো গ্যাসটাই আমাদের ইচ্ছামতো আমরা ব্যবহার করতে পারতাম এবং কাউকেই সেই জন্য কোন বাড়তি মুনাফা আমাদের দিতে হোত না। জরীপের জন্য প্রাইভেট পার্টনার অথবা ব্যাংকগুলির কনসোর্টিয়ামকে তাদের বিনিয়োগের বা তহবিলের জন্য কিছু মুনাফা এবং সুদ দিতে হলেও সেটা জাতীয় আয় বৃদ্ধিতেই সহায়ক হোত। তাতে আরেকটা বড় লাভ হোত সেটা হচ্ছে পঞ্চাশ বছরের জন্য জ্বালানী রিজার্ভ রাখার যে প্রতিশ্রুতি বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী অতীতে দিয়েছিলেন এবং দিয়ে তার ভাষায় তিনি ২০০১ সালের নির্বাচনে জিততে ব্যর্থ হন সেরকম একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ নীতিকে আমরা অনায়াসেই বাস্তবায়িত করতে পারতাম। যেহেতু পুরো গ্যাসটা প্রথম থেকেই জাতীয় মালিকানায় থাকতো সুতরাং  জ্বালানি নিরাপত্তা ক্ষুন্ন করে কোন গ্যাস রপ্তানি করা অসম্ভব হোত। এই অর্থে যে রপ্তানীর কোন বাধ্য-বাধকতা আমাদের উপরে থাকতো না কারণ দেশীয় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংককে টাকাতেই খরচ/সুদ মুনাফা প্রদান করা যেত। গ্যাস রপ্তানী করে ডলার উপার্জন করে ডলারে তাদের পাওনা মেটানোর প্রয়োজন হোত না। ধরা যাক এই সর্বোত্তম রাস্তাটি আমরা এখন গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছি কারণ আমাদের যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত নেই, যথেষ্ট প্রযুক্তি নেই বা সংগ্রহ করাও সম্ভব নয় এবং যথেষ্ট বিনিয়োগযোগ্য তহবিল নেই। যদি এগুলি সব সত্যও হয়ে থাকে তার পরেও আমরা ভেবে দেখতে পারতাম যে স্থলভাগের যেসব এলাকা থেকে গ্যাস বর্তমানে উত্তোলিত হচ্ছে এবং যে সব গ্যাসক্ষেত্র জরীপের জন্য নির্ধারিত হয়ে আছে-সেগুলিতে আগে গ্যাস উৎপাদন সর্বোচ্চ করা সম্ভব কি না। যদি দেখা যায় পুরনো গ্যাসক্ষেত্রগুলোর Work over করে এবং সুনেত্রসহ সদ্য আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে গ্যাস উত্তোলনের ব্যবস্থা করে গ্যাস আরো সস্তাতেও পাওয়া যায় এবং রপ্তানীর ঝুঁকিও থাকে না বা বিদেশীদের ডেকে আনতে হয় না তাহলে আপাততঃ সমুদ্র নিয়ে মাথা ঘামানো স্থগিতও রাখতে পারতাম। ইতোমধ্যে আমাদের জ্ঞান, অর্থনৈতিক ক্ষমতা এবং প্রযুক্তিগত ক্ষমতা আরো বৃদ্ধি পেত এবং তখন স্বউদ্যোগে আমরা আমাদের সমুদ্রের গ্যাস অনুসন্ধানে তৎপর হতে পারতাম। এটা অবশ্য নির্ভর করবে গ্যাস চাহিদা কতখানি তীব্র Critical  স্তরে রয়েছে তার উপর। কথা ঠিক যে বর্তমান যা গ্যাস চাহিদা তার ৭৫ শতাংশের বেশী গ্যাস এখন দেশের ভেতরে উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না এবং কাতার থেকে তিন-চার গুণ দাম দিয়ে আমরা LNG গ্যাস আমদানীর কথা ভাবতে শুরু করেছি। কথাও কেউ বলতে পারেন যে ভারত মায়ানমার যেহেতু সমুদ্রবক্ষে গ্যাস অনুসন্ধান শুরু করে দিয়েছে, সুতরাং আর দেরী করা চলে না। ধরা যাক এই শেষ দুটি যুক্তির ভিত্তিতে স্থির করা হোল যে আমাদের চাহিদা জরুরীভাবে মেটানোর জন্য এবং তিনগুণ দাম দিয়ে LNG  গ্যাস আমদানীর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমরা তড়িঘড়ি করে কনকো ফিলিপসের সঙ্গে একটা চুক্তি করেছি যেটার ভিত্তি হচ্ছে  website-এ প্রকাশিত মডেল পিএসসি-২০০৮। এখন আমাদের দেখতে হবে এই চুক্তির বিধানগুলি কি আমাদের উল্লিখিত স্বার্থ ও যুক্তিগুলো বিবেচনায় নিতে সক্ষম হয়েছে? বিচারের সুবিধার্থে আমি আমাদের যুক্তির বা বিচারের মানদণ্ডগুলি এখানে পুনরায় উল্লেখ করতে চাই-

(ক) আবিষ্কৃত গ্যাস/তেল ক্ষেত্রের উপর এবং আহরিত গ্যাস তেলের উপর বাংলাদেশের জনগণের মালিকানা সংরক্ষিত হয়েছে কি?

(খ) কনকো ফিলিপকে উৎপাদন খরচ বাবদ আহরিত গ্যাসের-তেলের কত অংশ দিতে হতে পারে এবং মুনাফা বাবদ কত অংশ দিতে হতে পারে। এসব দেয়ার পর বাংলাদেশের প্রাপ্য অংশটি কত দাঁড়ায় এবং সেটার মাত্রা গ্রহণযোগ্য কি?

(গ) গ্যাসের দাম কত নির্ধারিত হবে। তা কি বর্তমান দামের তিনগুণেরও বেশী হবে অর্থাৎ LNG আমদানী করতে যে দাম দিতে হয় তার চেয়ে বেশী হবে? তাহলে গ্যাস তোলার ঝামেলায় না গিয়ে গ্যাস LNG রূপে আমদানীই কি শ্রেয় নয়?

(ঘ) গ্যাস কার কাছে বিক্রী হবে এবং কোথায় তা ব্যবহৃত হবে? আমি না কিনতে পারলে সেটা কি বাইরে রপ্তানী হয়ে যাবে না? আমি কি যথাযত দামে সবটা গ্যাস কিনে দেশেই ব্যবহার করে জ্বালানী নিরাপত্তা রক্ষা করতে সক্ষম হব?

চুক্তির খুঁটি-নাটি ফাঁক-ফোকরে বিশ্লেষণ

এখন আমরা উপরোক্ত প্রশ্ন বা মানদদণ্ডগুলিকে সামনে রেখে পিএসসি মডেল চুক্তি ২০০৮-এর বিশ্লেষণ করবো। বর্তমান চুক্তির অধীনে আছে যে যদি গ্যাস বা তেল আবিষ্কার হয় এবং তখন যদি তা বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক বলে প্রমাণিত না হয় তাহলে পেট্রোবাংলাকে তা বিনামূল্যে অফার করা হবে। নিজ খরচে পেট্রোবাংলা তা উত্তোলন ব্যবহারোপযোগী করে ব্যবহার করতে পারবে অথবা জ্বালিয়ে দিতে পারবেন। [দেখুন চুক্তির ১৫.১, ১৫.২ ও ১৫.৩ ধারা। এখানে এই কথাটিই] টেনিকাল ভাষায় লেখা আছে।] এখানে অবশ্য আরো বলা হয়েছে যে যদি গ্যাসের বদলে তেল গ্যাস উভয়ই পাওয়া যায় তাহলে তেল উত্তোলনের জন্য যেটুকু গ্যাস প্রয়োজন হবে আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী ইজারাদার সেটুকু গ্যাস বিনামূল্যে ব্যবহারের অধিকার পাবে।]

এটি হচ্ছে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক একটি অবস্থা যেখানে কিছুই আমরা পাচ্ছি না। ওরাও কিছুই পাচ্ছেন না। তবে যদি গ্যাসের বদলে তেল পাওয়া যায় তখন কি হবে সেটি আরেকটি আলোচনার বিষয় এবং তার বিশ্লেষণের যাত্রাবিন্দুটি এখানে উল্লেখিত হোল।

এর পরের উল্লেখযোগ্য ধারাটি হচ্ছে ১৫.৪ ধারা। এখানে বলা হয়েছে ইজারাদার স্বীকৃত রিজার্ভার ম্যানেজমেন্ট নীতি অনুসারে প্রতি গ্যাস ক্ষেত্রের প্রমাণিত মজুদের শতকরা সাড়ে সাত ভাগ (৭.৫) গ্যাস উত্তোলন করতে পারবে। এই ধারাটি আমাদের পক্ষে কারণ যত কম করে গ্যাস তোলা হবে তত বেশিদিন গ্যাস ক্ষেত্রটি জীবিত থাকবে। আমাদের জ্বালানী নিরাপত্তার জন্য কম করে বেশি দিন যাবত গ্যাস ভোগ করাটাই শ্রেয়। বিপরীত ক্রমে যদি ২৫% বা ততোধিক গ্যাস তোলার সুযোগ খুলে দেওয়া হোত তাহলে মাত্র চার বছরে গ্যাস ক্ষেত্রগুলি নিঃশেষিত হয়ে যেত এবং তখন এত বেশী গ্যাস উত্তোলিত হোত যে আমাদের ভোগ চাহিদা মিটিয়ে বাকি উদ্বৃত্ত গ্যাস বিদেশে রপ্তানীর বাধ্য-বাধকতা চলে আসতো। পারে অবশ্য আবার অনেক দামে গ্যাস আমদানির বাধ্য-বাধকতাও চলে আসতো। আর এটা বিদেশীদের জন্য লাভজনক হোত কারণ অল্প সময়ে তারা তাদের বিনিয়োগ খরচ তুলে নিতে সক্ষম হতেন। পর্যন্তই যদি সমস্ত কথা শেষ হয়ে যেত তাহলে কোন কথাই আর ছিল না। মডেল পি.এস.সি-২০০৮-এর ১৫.৪ ধারায় এই কথাগুলি লেখার পরেই একটি তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যে নিম্নোক্ত কথাগুলি জুড়ে দেওয়া হয়েছে। বি : দ্র : অফশোর ব্লকের ক্ষেত্রে পেট্রোবাংলার সম্মতিক্রমে শতকরা সাড়ে সাত ভাগের চেয়েও বেশী গ্যাস উত্তোলন করা যাবে] শুভংকরের ফাঁকটা তাই অফশোর গ্যাসের জন্য এই জায়গায় রেখে দেয়া হোল। চূড়ান্ত চুক্তিতে ধারাটি আরো শিথিল করা হলে তখন সুযোগ থাকবে বেশী উৎপাদনের এবং সেই সূত্রে অনিবার্য রপ্তানীর সুযোগ! যদিও তা আন্তর্জাতিক রিজার্ভয়ের ম্যানেজমেন্টের নীতির পরিপন্থী বলে চুক্তিতেই তা আমরা বাধ্যতামূলকভাবে না করে দিতে পারতাম। তবু এই ছাড় কেন?

এবার আমরা দৃষ্টি দেব সবচেয়ে বিতর্কিত এবং সবচেয়ে গুরুত্তপুর্ণ ধারাটির দিকে ১৫.৫.১ ধারায় খুবই জটিল ভাবে বলা হচ্ছে,

১৫.৫.৪, ১৫.৫.৫, ১৫.৬ ধারায় বর্ণিত হিসাবনুসারে কন্ট্রাক্টর চুক্তিকৃত এলাকায় উপাদিত যে কোন পরিমান মার্কেটবল গ্যাস এল. এন. জি রপ্তানীর অধিকার পাবে। রপ্তানিতব্য প্রাকৃতিক গ্যাসের পরিমান নিম্নরূপ হবে-

(ক) কন্ট্রাক্টর-এর কষ্ট রিকভারি গ্যাস।

(খ) কন্ট্রাক্টর-এর প্রফিট গ্যাস

(গ) পেট্রোবাংলার প্রফিট গ্যাস অথবা যে ক্ষেত্রে প্রযোজ্য সে ক্ষেত্রে ১৫.৫.৪ ধারা বর্ণিত শর্তে প্রাপ্ত পেট্রোবাংলার সীমিত প্রফিট গ্যাস।

এই ধারার ২টি অংশ। প্রথম অংশে রয়েছে কতকগুলি শর্তের কথা-১৫.৫.৪, ১৫.৫.৫ এবং ১৫.৬। এই শর্তগুলি যদি কনোকো ফিলিপ পূরণ করতে পারে তাহলে LNG রূপে সকল গ্যাসই অর্থাৎ ১০০ শতাংশ গ্যাসই সে রপ্তানী করতে পারবে!

আমরা সকলেই যেটা সর্বদা Bottom Line হিসাবে বলে এসেছি এবং প্রধানমন্ত্রীও যার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তা হচ্ছে জ্বালানী নিরাপত্তা বজায় রাখতে হবে। অর্থাৎ ২০৫০ সাল পর্যন্ত গ্যাস-কয়লা-তেলের মজুদ রেখে তারপরেও যদি বাড়তি অনবায়নযোগ্য জ্বালানী থাকে একমাত্র তখনই তা রপ্তানীর কথা ভাবা যেতে পারে। কোন অবস্থাতেই কোন চুক্তিতে এমন সুযোগ থাকা উচিত হবে না যাতে এই জ্বালানী নিরাপত্তার লক্ষ্য বিপর্যস্ত হয়। অর্থাৎ কখনোই আমাদের চাহিদা পূরণ না করে বাইরে অনবায়নযোগ্য জ্বালানী রপ্তানী করবো না। এবং আমাদের এই চাহিদার হিসাবটা করতে হবে ২০৫০ সাল পর্যন্ত গতিশীল প্রণালীতে। বর্তমান প্রেক্ষিতে আমরা জানি যে ২০০৯ সালের জুলাই মাসে আমাদের মোট গ্যাস উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ১৯৪৫ মিলিয়ন ঘনফুট সে ক্ষেত্রে দৈনিক চাহিদা ছিল ২১৮০ মিলিয়ন ঘনফুট, অর্থাৎ দৈনিক মোট রেজিস্টার্ড ঘাটতি ছিল ২৩৫ মি: ঘনফুট বা মোট উৎপাদন ক্ষমতার ১২ শতাংশ। আর এর সঙ্গে যদি পটেনশিয়াল শিল্প কারখানার চাহিদাগুলিও যোগ করা হয় তাহলে ২০০৯ সালের জুলাই মাসেই আমাদের গ্যাস ঘাটতি ছিল মোট উৎপাদন ক্ষমতার প্রায় ২০ শতাংশ। [মোঃ নুরুল ইসলাম, তেল গ্যাস কয়লা রপ্তানি নিষিদ্ধ করে আইন পাস করা উচিত, সাপ্তাহিক, ১০ই জুলাই, ২০০৯ দ্র:] সুতরাং সব মিলিয়ে কোন চুক্তিতে কোনভাবেই শতকরা একশত ভাগ LNG রূপে গ্যাস রপ্তানীর সুযোগ রাখা উচিত হবে না। কিন্তু এই ২০০৮-এর পি. এস. সি-তে সুযোগ রয়েছে। এটাই আমাদের অভিযোগ। এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে দু’ধরনের পাল্টা বক্তব্য রয়েছে-

ক) যদি ৫-৬ ট্রিলিয়ন গ্যাস আবিষ্কৃত না হয় তাহলে  LNG plant করাটাই লাভজনক হবে না। সে জন্যই ১৯৯৭-এর পরে সাধিত সব PSCতেই LNG formG গ্যাস রপ্তানীর সুযোগ থাকলেও সুযোগ কোন বহুজাতিক কোম্পানী আজ পর্যন্ত ব্যবহার করেনি। এবারো এই সুযোগটি তাত্ত্বিক সুযোগ মাত্র, ব্যবহারিক সুযোগ এটা নয়।

খ) আর যদি ৫-৬ ট্রিলিয়ন গ্যাস পাওয়াই যায় তাহলেও LNG Plant করার আগে তাদেরকে ১৫.৫.৪ এবং ১৫.৫.৫ এবং ১৫.৬ শর্ত পূরণ করতে হবে এবং সেটা পূরণ করতে পারবে না বলেই গ্যাস রপ্তানী অসম্ভব হয়ে যাবে।

প্রথম যুক্তিটি অজ্ঞানের খড়-কুটো ধরে শেষ মুহূর্তে নিজেকে বাঁচানোর একটা কৌঁশল। না জেনে অনুমান করাটা যে বৈধ নয়-এই কথাটা এখানে ভুলে যাওয়া হয়েছে। বিশাল গ্যাস ভান্ডার আবিস্কার হবে না এটাই বা তারা জানলেন কিভাবে? আর যদি কমই হয় তাহলে খরচ মিটবে কি? খরচ মিটিয়ে কতটুকুই বা আমাদের থাকবে- সে প্রশ্ন তো থেকেই যাচ্ছে সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে রপ্তানি ঠেকানোর জন্য এখন আমাদেরকে কম গ্যাসের প্রত্যাশার দোহাই দিতে হচ্ছে!

দ্বিতীয় যুক্তিটি বুঝতে হলে LNG রপ্তানীর সুযোগ সংক্রান্ত ধারাটি এবং তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শর্তগুলিতে কি লেখা আছে তা আমাদের সতর্কতার সঙ্গে বিচার করে দেখতে হবে। শর্তগুলি কি রপ্তানীর বিরুদ্ধে Binding Constraint না কি সেগুলি লঙ্ঘনের সুযোগ সেগুলির মধ্যেই বিদ্যমান রয়েছে-সেটি বিচার করা দরকার।

১৫.৫.৪ ধারার প্রাসঙ্গিক গুরুত্বপূর্ণ অংশটিতে বলা হয়েছে, যে ক্ষেত্রে পেট্রোবাংলা স্থানীয় চাহিদা মিটাতে প্রয়োজনীয় পরিবহন ব্যবস্থা (পাইপ লাইন) স্থাপন করতে পারবে সেক্ষেত্রে পেট্রোবাংলা তার অংশের প্রোফিট গ্যাস রাখার অধিকার প্রাপ্ত হবে, তবে তা কোন মতেই মোট মার্কেটেবল গ্যাস (অর্থা মোট উপাদিত গ্যাস = কষ্ট রিকভারি গ্যাস + কনকো ফিলিপের প্রফিট গ্যাস + পেট্রোবাংলার প্রফিট গ্যাস) এর ২০%-এর বেশী হবে না। প্রতি মাসে পেট্রোবাংলা যে পরিমান গ্যাস স্থানীয় ব্যবহারের জন্য রাখতে চায় কন্ট্রাক্টরকে এল. এন. জি রপ্তানী চুক্তির আগে জানাতে হবে এবং প্রতিমাসে সংরক্ষিত চুক্তির পূর্ণমেয়াদকাল পর্যন্ত বলবত থাকবে। পেট্রোবাংলার অনুরোধে ১১তম বছরের শুরু থেকে উপরে বর্ণিত সংরক্ষিত গ্যাসের পরিমান শতকরা ২০ ভাগ থেকে বৃদ্ধি করে ৩০ ভাগ পর্যনত্ম করা যাবে।

সুতরাং কথা খুব পরিষ্কার। এখানে কনকো ফিলিপ অনেকটা মালিকের মতোই আমাদেরকে জিজ্ঞেস করছে, কতটা গ্যাস আপনি স্থানীয় ব্যবহারের জন্য রাখতে চান?’ আমার চাহিদা যাই থাকুক না কেন, ভবিষ্যত জ্বালানী নিরাপত্তা যতই বিঘ্নিত হোক না কেন-প্রথম ১০ বছর আশি ভাগ গ্যাস রপ্তানী করার অধিকার কনোকো ফিলিপকে পরিষ্কারভাবে দিয়ে দেয়া হয়েছে। অতএব ১৫.৫.৪ শর্তটি গ্যাস রপ্তানীর বিরুদ্ধে নয়, বরং রপ্তানীর পদ্ধতিটির সুনির্দিষ্টায়নের একটি ধারা। সান্ত্বনা পুরস্কার রাখা হচ্ছে ১১তম বছরে এসে ৩০% গ্যাস স্থানীয় ব্যবহারের জন্য প্রাপ্তি এবং এর পরও যদি গ্যাস উৎপাদন অব্যাহত থাকে তাহলেও ৩০%-এর বেশী স্থানীয় ব্যবহারের জন্য কখনোই পাওয়া যাবে না। তা সে যতই আমাদের প্রয়োজন থাকুক না কেন। এর ফলে এমন অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে যখন আমরা একই সঙ্গে LNG formG রপ্তানী করবো কম দামে এবং অপেক্ষাকৃত বেশী দামে LNG গ্যাস আমদানী করবো  বিদেশ থেকে। যদি সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ দিয়েও আমাদের অভাব না মিটে তাহলে সেটাই আমাদের করতে হবে। তবে পেট্রোবাংলা যদি পাইপ লাইনের খরচ দিয়ে স্থলভাগে নিজেরা গ্যাসটা আনতে না পারে তাহলে শতকরা ২০ ভাগ রাখার অধিকারও পেট্রোবাংলার থাকবে না, ৩০ শতাংশ তো দূর-অস্ত।

১৫.৫.৫ উপশর্তে বলা হয়েছে, এল. এন. জি. রপ্তানীমূল্য বা রপ্তানী মূল্যের ফর্মূলা পেট্রোবাংলা কর্তৃক অনুমোদনের আগে কন্ট্রাক্টর এল. এন. জি. রপ্তানীর কোন চুক্তি করবে না কেউ কেউ বলেন এই তো মোক্ষম যুক্তি, আমরা যদি রপ্তানী মূল্যের ফর্মূলায় এক মত না হই তাহলে তো রপ্তানী আটকে যাচ্ছে। কিন্তু ১৫.৫.৫ উপধারায় এর পর পরই আরো লেখা হয়েছে-

কন্ট্রাক্টর যদি দেখাতে পারে যে, এল.এন.জি রপ্তানীর মূল্য বা মূল্য নির্ধারণী ফর্মূলা ন্যায্য, তাহলে পেট্রোবাংলা তার অনুমোদন আটকে রাখবে না। যে ভৌগলিক এলাকায় রপ্তানী করা হবে তার নাম প্রকৃতি এবং রপ্তানীর স্থান থেকে বাজার পর্যনত্ম পরিবহন ব্যয় পেট্রোবাংলার কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে।

তাহলে শেষ পর্যন্ত কি দাঁড়াল? কনোকো ফিলিপস যদি আন্তর্জাতিক বাজার দরে (ধরুন ১৩ ডলারে!) এল.এন.জি গ্যাস ভারতকে রপ্তানীর প্রস্তাব দেয় তাহলে কি পেট্রোবাংলা ঐ প্রস্তাবকে ‘অন্যায্য দাম’ বা ‘ভারত আমাদের শত্রু দেশ অতএব তাকে রপ্তানী করা যাবে না’ এরকম যুক্তি প্রয়োগ করে রপ্তানী ঠেকাতে পারবে? যদি না পারা যায় তাহলে ঐ শর্ত থাকলেই কি, না থাকলেই কি!

১৫.৬ নং উপশর্তটি বা শেষ উপশর্তটি নিয়েই যত জটিলতা। এর রয়েছে তিনটি উপশর্ত। প্রথম শর্তে বলা হয়েছে, কন্ট্রাক্টর তার প্রাপ্য কষ্ট রিকভারি গ্যাস এবং প্রফিট গ্যাস বিক্রয়ের জন্য পেট্রোবাংলাকে প্রথম প্রস্তাব দেবে। পেট্রোবাংলা সে প্রস্তাব গ্রহণ করবে অথবা তার এফিলিয়েটেড কোম্পানি উক্ত গ্যাস ক্রয় করবে। চুক্তিভুক্ত এলাকার বাইরেও যদি অতিরিক্ত গ্যাস মজুদ আবিস্কৃত হয় সে ক্ষেত্রেও পাদন এলাকা থেকে গ্যাস সরবরাহের বাধ্য-বাধকতা হ্রাস পাবে না। ডেভেলাপমেন্ট প্লান অনুমোদনের সময় গ্যাস ক্রয় এবং বিক্রয়ের জন্য চুক্তির শর্তসমূহ ১৫.৭ ধারায় বর্ণিত আর্থিক হিসাব অনুসারে প্রনয়ণ করতে হবে।

১৫.৬ এর (বি) উপধারায় আরো বলা হয়েছে মূল্যায়ন প্রতিবেদন দাখিলের ৬ মাসের মধ্যে পেট্রোবাংলা যদি গ্যাস ক্রয়ের নিশ্চিত প্রতিশ্রুতি দিতে সক্ষম না হয় তাহলে কনোকো ফিলিপস বাংলাদেশের ভেতরে যে কোনো তৃতীয় পক্ষকে গ্যাস বিক্রী করতে পারবে এবং পেট্রোবাংলা শুধু তা মানলেই চলবে না তাকে সেই বিক্রীর ব্যাপারে সাহায্যও করতে হবে।

১৫.৬ (সি) তে আরো স্পষ্ট ভাবে বলা হয়েছে, কন্ট্রাক্টর তার প্রাপ্য অংশের গ্যাস পেট্রোবাংলার কাছে বিক্রির প্রস্তা দিবে। পেট্রোবাংলা যদি ক্রয় করতে A¯^xKvi করে সে ক্ষেত্রে কন্ট্রাক্টর গ্যাস দেশের অভ্যন্তরে তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রী করতে পারবে।

এই ১৫.৬ উপধারার এবিসি শর্তগুলো তখনই গ্যাসের আভ্যন্তরীণ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারবে যখন পেট্রোবাংলা এই বৃহৎ আইওসি’র সঙ্গে গ্যাস বিক্রির আর্থিক শর্তটি তথা দাম নির্ধারণে প্রথমে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারে এবং ঐ দামে তা নিজে কিনতে রাজী হয়। অধ্যাপক নুরুল ইসলাম বলেছেন, চুক্তির ১৫.৭ ধারায় দাম নির্ধারণের যেসব পদ্ধতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা ব্যবহার করে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন দাম এখনই হিসাব করা সম্ভব। নিম্নোক্ত তালিকায় তা তুলে ধরা হলো-

পশ্চিম এলাকায়,সমুদ্র এলাকা (ক)এবংসমুদ্র এলাকা (খ)তে পিএসসি-২০০৮ অনুসারে গ্যাস এবং তার দাম (পেট্রোবাংলার জন্য প্রযোজ্য)

গ্যাসের দাম তেলের দাম ($ / টন) পশ্চিম এলাকায় গ্যাসের দাম সমুদ্র এলাকা (ক) তে দাম সমুদ্র এলাকা (খ) তে দাম
সর্বনিম্ন ৭০ ১.৫১ ১.৫ ১.৬
র্বোচ্চ ১৮০ ৪.১৫ ৩.৮৯ ৪.১

 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই দামে গ্যাস বিক্রির জন্য কনোকো ফিলিপ কি আগ্রহী হবে? এখানে কষ্ট বিকভারি ও প্রফিট গ্যাসের মোট পরিমাণ যাই হোক না কেন, কনোকো ফিলিপের জন্য যেটা প্রধান বিবেচ্য সেটা হচ্ছে দ্রুত পুঁজির টাকাটা উদ্ধার করে নেওয়া। যেহেতু তৃতীয় পক্ষের কাছে বা এলএনজিতে গ্যাস বিক্রি করতে পারলে তিন গুণ বেশি দাম পাওয়া যাবে এবং সেখানে লাভের হার অনেক বেশি হবে সেহেতু কনোকো ফিলিপের প্রচেষ্টা হবে তিন গুণ দামে রপ্তানী করা বা নিদেনপক্ষে দেশের ভেতরে সর্বোচ্চ দরদাতাকে বিক্রি করা। এমনও হতে পারে যে টাটা এখানে রপ্তানীমুখী যে বিনিয়োগ করতে ইচ্ছুক ছিলেন এবং যার জন্য সে ২০ বছর ব্যাপী নিশ্চিত গ্যাস বা কয়লা সরবরাহের চুক্তি করতে চেয়েছিল সেই সম্ভাবনারই প্রথম  পদক্ষেপে পরিণত হবে এই গ্যাস আহরণ চুক্তি। সুতরাং দেখা যাচ্ছে উপশর্তগুলি রপ্তানীর বিরুদ্ধে Binding Constraint নয়। আমরা কি এখনই চুক্তিতে যা যা লেখা আছে তা মেনে চলার জন্য  তথাকথিত ‘সভ্য-ভদ্র-নির্লোভ’ বহুজাতিক I.O.C.-¸wj‡K বাধ্য করতে পারছি? তবে একথা ঠিক এখন পর্যন্ত তাদের ইচ্ছা সত্বেও তারা গ্যাস রপ্তানী করতে সক্ষম হয়নি। কিন্তু সেটা ছিল স্থলভাগে এবং পাইপের মাধ্যমে পাঠানো গ্যাসের ইস্যু, ফলে বোধগম্য কারনেই এখানে জনপ্রতিরোধের শক্তি ছিল অনেক বেশী। পেট্রোবাংলা কিন্তু প্রতিরোধ তো দুরের কথা বরং যখন I.O.C. রপ্তানী করতে ব্যর্থ হোল তখন চুক্তির বাইরে গিয়ে তাদেরকে বেশী দামে তৃতীয় পক্ষের কাছে বেশী দামে গ্যাস বিক্রির সুযোগ করে দিয়েছিল। ভবিষ্যতেও যদি  পেট্রোবাংলার একই প্রবণতা অব্যাহত থাকে তাহলে চুক্তিতে রয়ে যাওয়া এসব ফাঁক-ফোকরের কি ভয়াবহ পরিনতি হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।

উপসংহার :

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে দেশের গুরত্তপূর্ণ প্রয়োজন স্থগিত রাখার ঝুঁকি নিযে কেন আমরা এলএনজি রূপে ১০০ ভাগ গ্যাস রপ্তানীর এই সুযোগটি চুক্তিতে রেখে দিচ্ছি। যদি জ্বালানী নিরাপত্তা আমাদের আদর্শ হয় তাহলে এখনো কেন ৫০ বছর পর্যন্ত অনবায়নযোগ্য জ্বালানী রপ্তানী স্থগিত শীর্ষক প্রস্তাবিত আইনটি সংসদে আলোচিত হয়ে গৃহীত হচ্ছে না? কেন সমপ্রতি অনুমোদিত ২০০৯-১২ সালের জন্য প্রণীত রপ্তানী নীতিতে এই প্রথমবারের মতো রপ্তানী নিষিদ্ধ পণ্যের তালিকা থেকে বিশেষ ভাবে এলএনজি গ্যাসকে বাদ রাখা হলো। রপ্তানী নীতি ২০০৯-১২-র পরিশিষ্টঐক এর ৮.১ (ক) ধারায় রপ্তানী নিষিদ্ধ পণ্যের তালিকার নীচেই লেখা হয়েছে:

সকল পেট্রোলিযাম এবং পেট্রোলিয়াম জাত পাদন, তবে প্রাকৃতিক গ্যাস জাত দ্রব্য ছাড়া (যেমন, ফার্নেস অয়েল, লুব্রিকান্ট অয়েল, বিটুমিন, কনডেনসেট, এমটিটি, এমএস)।তারপরেই আবার লেখা হয়েছে, অবশ্য এই নিষেধাজ্ঞা পাদন বণ্টন চুক্তির অধীনে বিদেশি বিনিয়োগকারী সংস্থাসমূহের অংশ পেট্রোলিয়া বা এলএনজি রপ্তানীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।

এসব কিছু কিসের আলামত? আলামত একটাই। তা হচ্ছে আমাদের গ্যাস রপ্তানীর সুযোগ এখন আমরা খোলা রেখে দিচ্ছি। পরে তা বাস্তবায়িত করবো বা দেখাবো যে করতে বাধ্য হলাম।

(২৪ জুন ২০১১ সকাল সাড়ে ১০টায় মুক্তি ভবনের প্রগতি সম্মেলন কক্ষে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ বিদ্যু-বন্দর ক্ষা জাতীয় কমিটি আয়োজিত  ‘কনোকো ফিলিপস এর সাথে বঙ্গোপসাগরের তেল-গ্যাস চুক্তি কেন জাতীয় স্বার্থবিরোধীশীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠানে পঠিত বক্তব্য।)