?> সাগরের গ্যাস লুট: বহুজাতিক কনোকোফিলিপস এর সাথে চুক্তির আয়োজন « NCBD – National Committee of Bangladesh

Monday, May 23rd, 2011

সাগরের গ্যাস লুট: বহুজাতিক কনোকোফিলিপস এর সাথে চুক্তির আয়োজন

মহাজোট সরকার গত ৩ মে, ২০১১ গভীর সমুদ্রের ১০ ও ১১ নং ব্লকের ৮৫% এলাকা মার্কিন বহুজাতিক কনোকোফিলিপসের হাতে তুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে।(সূত্র:১) ভারতের সাথে বিরোধপূর্ণ এলাকার মধ্যে এই ব্লক দু’টি পড়ার কারণে সরকার ১৫% এলাকা ইজারার আওতার বাইরে রাখবে । এভাবে মার্কিন য্ক্তুরাষ্ট্রকে খুশী করা এবং একই সাথে ভারতকেও অসন্তুষ্ট না করার উপায় বের করেছে শাসক শ্রেণী। এর আগে গত ২১ ডিসেম্বর ২০১০ সালে উইকিলিকস এর বরাতে ফাস হওয়া মার্কিন বার্তার (রেফারেন্স আইডি: 09DHAKA741) ”গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য গ্যাস ব্লক ইজারা”(২,সি) অংশে দেখা যায়:

”গত ২৩ জুলাই এর এক মিটিং এর সময় জ্বালানি উপদেষ্টা কনোকোফিলিপসকে সাগরের দুটি বিরোধহীন গ্যাস ব্লক ইজারা দেয়ার সম্ভাবনার কথা রাষ্ট্রদূতকে জানান।…এরপর ঐ দিনই, আরো পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য ক্যাবিনেট থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠানো হয়।বাংলাদেশ, ভারত এবং বার্মার মধ্যে সমুদ্রসীমার ভাগাভাগি নিয়ে বিরোধ একটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু।প্রথমে কনোকোফিলিপস এর ৮টি গ্যাস ব্লকের আবেদন অনুমোদন করা হলেও প্রায় ১ বছর হতে চলল বিষয়টি স্থগিত আছে। কনোকোফিলিপস যে ৮টি ব্লকের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলো একে একে তার সবকটিই বুঝে নিতে চায় কিন্ত শুরুতে বিরোধবিহীন ব্লক দিয়েই কাজ শুরু করতে আগ্রহী।”

মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস মরিয়ার্টিকে দেয়া জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক ইলাহি চৌধুরি তথা শাসক শ্রেণীর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই মডেল পিএসসি-২০০৮ অনুসারে গভীর সমুদ্রের ১০ ও ১১ নম্বর ব্লকের বিরোধহীন ৮৫% অংশ মার্কিন বহুজাতিক কনোকো ফিলিপস এর হাতে তুলে দেয়ার আয়োজন করছে ক্ষমতাসিন মহাজোট সরকার।

জাতীয় স্বার্থ বিরোধী মডেল পিএসসি ২০০৮:

মডেল পিএসসি ২০০৮ এর আর্টিক্যালগুলো  পড়লে বোঝা শক্ত নয়, বহুজাতিক কোম্পানিকে সাগরের গ্যাস লুট করার সুযোগ দিতেই এই মডেল পিএসসি বা উৎপাদন অংশীদারিত্বের চুক্তি। এর আর্টিক্যাল ১৪.৩ অনুসারে বিদেশী কোম্পানি উত্তোলিত গ্যাসের সর্বোচ্চ ৫৫% পর্যন্ত গ্যাসকে কস্ট  রিকভারী গ্যাস হিসেবে ঘোষণা করতে পারবে। বাকি ৪৫% গ্যাস হলো প্রফিট গ্যাস যা আবার  কোম্পানি এবং পেট্রোবাংলার মাঝে সুনির্দিষ্ট চুক্তি অনুযায়ী দুই ভাগে বিভক্ত হবে। প্রফিট গ্যাস ঠিক কি অনুপাতে ভাগ হবে সে বিষয়ে এই মডেল পিএসসিতে সরাসরি বলা না থাকলেও আর্টিক্যাল ১৫.৫.৪ এ বলা আছে সম্পূর্ণ বাজারজাতযোগ্য গ্যাস বা টোটাল মার্কেটেবল গ্যাসের ২০% এর বেশী পেট্রোবাংলা দাবী করতে পারবে না অর্থাৎ স্পষ্টতই কমপক্ষে ৮০% গ্যাসের মালিকানা বহুজাতিক কোম্পানির হাতে তুলে দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে। আর্টিক্যাল ১৫.৫.১ এ পেট্রোবাংলার অনুমোদন সাপেক্ষে বাজারজাতযোগ্য গ্যাসকে বহুজাতিক কোম্পানি কর্তৃক  এলএনজি হিসেবে রপ্তানি করার বিধান রাখা হয়েছে।

রপ্তানির বিধান প্রসঙ্গে:

মডেল পিএসসির সমর্থকদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পেট্রোবাংলা বিদেশী কোম্পানির কাছ থেকে গ্যাস কেনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেই কেবল তারা তৃতীয় পক্ষের কাছে/বিদেশে গ্যাস এলএনজি করে বিক্রি করতে পারবে। এ ব্যাখ্যার মধ্যে একটা বড় ফাঁকি আছে। প্রথম কথা হলো, যদি রপ্তানি না করাই পিএসসির উদ্দেশ্য থাকে তাহলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শর্ত দেয়ার দরকার কি, সরাসরি বললেই তো হয় যে রপ্তানি নিষিদ্ধ! দ্বিতীয়ত, পেট্রোবাংলা প্রথম দাবীদার ঠিকই কিন্তু তার জন্য মডেল পিএসসি’র আর্টিক্যাল ১৫.৫.৪ অনুসারে তাকে দুটি শর্ত পূরণ করতে হবে- এক) তাকে গ্যাস পরিবহন করতে পারতে হবে এবং দুই) উত্তোলিত গ্যাস ব্যাবহার করতে পারতে হবে।

এখন আবিস্কৃত গ্যাসের পরিমাণ দেখে বহুজাতিক কোম্পানি যদি এলএনজি প্ল্যান্ট স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয় এবং যদি বাংলাদেশ দৈনিক যে পরিমাণ গ্যাস ব্যাবহার করতে পারবে তার চেয়ে বেশী পরিমাণ গ্যাস উত্তোলন করতে শুরু করে(এটি তারা করতে পারবে কারণ এক বছরে সর্বোচ্চ উত্তোলন সীমা স্থলভাগের গ্যাসের ক্ষেত্রে ৭.৫% রাখা হলেও সমুদ্রের গ্যাসের ক্ষেত্রে ”প্রয়োজনে” এ সীমা বাড়ানোর সুযোগ রাখা হয়েছে) তাহলে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এবং অবদমিত শিল্পখাতে হঠাৎ অনেক বেশী পরিমাণে গ্যাস ব্যবহার করার ক্ষমতা না থাকা- এই  কারণে চু্ক্তি অনুসারে আমরা বাধ্য হবো বহুজাতিক কোম্পানিকে এলএনজি বানিয়ে গ্যাস বিদেশে রপ্তানি করার অনুমতি দিতে।

প্রশ্ন আসতে পারে দেশে নিশ্চিত বাজার থাকা স্বত্ত্বেও বহুজিক কোম্পানি কেন শুধু শুধু কোটি কোটি ডলার খরচ করে এলএনজি প্ল্যান্ট বানাতে যাবে? এর কারণ হলো গ্যাসের আন্তর্জাতিক মূল্য। আমরা আগেই দেখেছি চুক্তি মোতাবেক একদিকে বহুজাতিক কোম্পানির কাছ থেকে গ্যাস কিনলে আমাদের যেমন দেশীয় উৎপাদন খরচের তুলানায় ১০/১২ গুণ বেশী দাম দিতে হয়, তেমনি আরেকদিকে বহুজাতিক কোম্পানিকেও আর্ন্তজাতিক মূল্যের প্রায় এক তৃতীয়াংশ মুল্যে পেট্রবাংলার কাছে বিক্রয় করতে হয়। ফলে পেট্রোবাংলার কাছে বিক্রি করলে প্রতি হাজার কিউবিক ফিটে তার লাভ কম অর্থাৎ ”ক্ষতি” হচ্ছে ৭/৮ ডলার অর্থাৎ প্রতি টিসিএফ এ ”ক্ষতি” ৭/৮ বিলয়ন ডলার। স্রেফ এই ১ টিসিএফের ”ক্ষতি”র টাকাটুকু যদি সে বিনিয়োগ করে একবার এলএনজি প্লান্ট বানিয়ে ফেলতে পারে তাহলে পরবর্তীতে তাকে আর এই ”ক্ষতি”টুকু স্বীকার করতে হবে না( যদি ৪ টিসিএফ গ্যাস পাওয়া যায় তাহলে দেশীয় বাজারে বিক্রি করলে ২৮ থেকে ৩২ বিলিয়ন ডলার ”ক্ষতি” স্বীকার করতে হবে, কাজেই তার পক্ষে ৭/৮ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে চাওয়াটাই স্বাভাবিক হবে)- দেশীয় শিল্পের প্রয়োজনাতিরিক্ত গ্যাস উৎপাদন করলেই পেট্রোবাংলা বাধ্য হবে তাকে এলএনজি আকারে গ্যাস রপ্তানি করতে দিতে!

আরেকটা বিষয় হলো, পেট্রোবাংলার চাহিদা মেটানোর পরই কেবল তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রি করতে পারার এই কথা চুক্তিতে থাকলেই যে তা মেনে চলা হবে তারও কোন নিশ্চয়তা নেই, বহুজাতিক সান্তোসকে তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রির অনুমোদনের চুক্তি তো সে ইশারাই দিচ্ছে।

বিনিয়োগের পুঁজি ও প্রযুক্তির অভাব প্রসঙ্গে:

আমাদের জাতীয় সম্পদের উপর ৮০% বিদেশী মালিকানা এবং সেই সাথে রপ্তানির সুযোগ দিয়ে পিএসসি চুক্তি করার অযুহাত হিসেবে সরকারি ভাবে যে প্রসঙ্গটি উত্থাপন করা হচ্ছে তা হলো বিশাল বিনিয়োগের জন্য আমাদের পর্যাপ্ত পুঁজি নাই এবং নিজেরা তোলার মত দক্ষতাও আমাদের দেশীয় কোম্পানিগুলোর নাই। সুতরাং যে কোন মূল্যে, এই গ্যাস সংকটের সময়ে ৮০ ভাগ মালিকানা এবং বিদেশী রপ্তানির সুযোগ দিয়ে হলেও ঐসব বহুজাতিক কোম্পানিকে দিয়েই গ্যাস উত্তোলন করতে হবে। এই যে পুঁজি ও দক্ষতার অভাবের অযুহাতটি দেয়া হচ্ছে এটা কিন্তু নতুন নয়, এই অযুহাতটা বেশ ঐতিহাসিক, যখনই কোন গণবিরোধী প্রকল্প বিদেশীদের হাতে তুলে দেয়া হয়, তখনই কিন্তু যুক্তিটি হাজির করা হয়। এখন সমুদ্রের গ্যাসের ক্ষেত্রে যুক্তিটি দেয়া হচ্ছে, এর আগে কিন্তু স্থলভাগের গ্যাস ব্লক ইজারা দেয়ার অযুহাত হিসেবেও এই একই যুক্তি দেয়া হয়েছে। অথচ আজ আমরা জানি, বাপেক্স পুরোনো জীর্ণ ড্রিলিং/রিগিং যন্ত্রপাতি নিয়েও দক্ষতা ও যোগ্যতার অর্থে কোন অংশেই বিদেশী কোম্পানিগুলোর তুলনায় কম নয়- দেশী/বিদেশী কোম্পানির মিলিতভাবে সাফল্যের অনুপাত যেখানে ৩:১, সেখানে দেশীয় কোম্পানির সাফল্যের অনুপাত ২.২৫:১ (১৮ টি অনুসন্ধান কূপ খনন করে ৮ টি গ্যাস ক্ষেত্র আবিস্কার১০, বাপেক্স বহুজাতিক টাল্লোকে ২-উ সিসমিক সার্ভে থেকে শুরু করে ভাঙ্গুরায় এমনকি কূপ ড্রিলিং (ওয়ার্কওভার)ও করে দিয়েছে।(সূত্র: ২) আর পুঁজির অভাবের কথা বলে বাপেক্সকে সময় মতো ড্রিলিং রিগ কেনার ৮০ কোটি টাকা দেয়া না হলেও ২৫ টাকার গ্যাস ২৫০ টাকা করে বছর বছর বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়ার টাকার অভাব হয় না। কাজেই পুঁজি কিংবা দক্ষতার অভাব মূল প্রশ্ন নয়, মূল প্রশ্ন হলো শাসক শ্রেণী কার স্বার্থ দেখছে – জনগণের না বহুজাতিকের- সেটা। জনগণের স্বার্থের কথা মাথায় থাকলে তো বাপেক্সকে কবেই আপগ্রেড করার পরিকল্পনা নেয়ার কথা। আবার এতদিন করা হয়নি বলে যে এখন আর করা সম্ভব নয় ব্যাপারটি কিন্তু তাও নয়। সেক্ষেত্রে তো কোনদিনই আমরা নিজেরা গ্যাস তুলতে পারব না, ফলে চিরকালই জাতীয় সম্পদ বহুজাতিকের হাতে তুলে দিতে হবে। আর অনশোরের মত অফশোরেরও গ্যাস তোলার প্রযুক্তি ও দক্ষতা তো শুরু থেকেই কারো থাকে না, এটা অর্জন করতে হয়। অনশোরে বা স্থলভাগে আজকে বাপেক্সের যে দক্ষতা সেটাও তো অর্জন-ই করতে হয়েছে, তাই না? মালয়শিয়ার পেট্রোনাস, ভেনিজুয়েলার পিডিভিএসএ এদের কারোরই কোন অফশোরে দক্ষতা ছিল না কিন্তু রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতায় উপযুক্ত প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি আমদানি ও ট্রেনিং এর মাধ্যমে তারা সেটা অর্জন করেছে। তাহলে আমাদের না পারার তো কোন কারণ দেখছি না!

আর পুঁজির অভাব? অফশোর ড্রিলিং করতে কত টাকা লাগে? মায়ানমারের ময়াত্তামা অফশোর (ইয়াদানা গ্যাস প্রজেক্ট) ড্রিলিং এর জন্য ব্যয় হয়েছে ১.২ বিলিয়ন ডলার এবং তানিন থারিই অফ শোর(ইয়াতাগুন গ্যাস প্রজেক্ট) ড্রিলিং এর জন্য ব্যয়ের পরিমান প্রায় ৭০০ মিলিয়ন ডলার (সূত্র ৩) – গড়ে যদি ১ বিলিয়ন ডলার করে ধরি তাহলে বাংলাদেশের টাকায় ব্যয় হলো প্রায় ৭০০০ কোটি টাকা। কিন্তু এই টাকাটা একবারে লাগবে না- গ্যাস আবিষ্কার ও উত্তোলনের জন্য ৭ বছর সময় লাগলে প্রতিবছর লাগবে ১ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ প্রতি বছর বিদেশী কোম্পানির কাছ থেকে গ্যাস কেনার জন্য এবং বিদ্যুৎ কোম্পানির কাছ থেকে অতি উচ্চ মূল্যের বিদ্যুৎ কেনার জন্য ভর্তুকি দেয় হলো ৪ হাজার কোটি টাকার  মতো। (সূত্র: ৪) ট্যাক্স, ভ্যাট, লভ্যাংশ সবকিছু মিলিয়ে প্রতি বছর পেট্রোবাংলা ও তার অঙ্গ সংস্থাগুলো সরকারকে  গড়ে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা প্রদান করে।(সূত্র: ৫) চুক্তি বাতিল করে দেশীয় কোম্পানির  মাধ্যমে গ্যাস তোলা হলে এই ভর্তুকির টাকা কিংবা সরকারি কোষাগারে জমা দেয়া টাকার একটা অংশ থেকেই আমরা গভীর সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলনের খরচটা পেয়ে যাব। তাছাড়া প্রয়োজনে দেশী-বিদেশী উৎস থেকে লেভি, ঋণ, শেয়ার, বন্ড ইত্যাদির মাধ্যমেও পুঁজি সংগ্রহ করা সম্ভব।

যদি বলা হয় প্রযুক্তি ও দক্ষতা ভালোভাবে অর্জন করতে তো ৫/৭ বছর সময় লাগবে, তাহলে ততদিন চলবে কি করে? এখানে বলা দরকার, প্রথমত, স্থলভাগের গ্যাস দিয়ে বর্তমানের যে ঘাটতি আছে তা মেটানো সম্ভব যদি বিদেশী কোম্পানির লাভ-লোকসানের বিবেচনা থেকে বের হওয়া যায়, যদি বাপেক্স আবিস্কৃত সুনেত্র গ্যাস ক্ষেত্র থেকে জাতীয় সংস্থার মাধ্যমেই গ্যাস উত্তোলন শুরু করা যায় এবং যদি যে সব কূপ স্রেফ কয়েকশো কোটি টাকার অভাবে অনুসন্ধান ও উত্তোলন করা যাচ্ছে না, গেলেও পাইপ লাইনের জন্য বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে না, সেগুলোর জন্য সময় মত অর্থ বরাদ্দ করা হয়। তারপরও যদি ঘাটতি থাকে তাহলে খুব সহজেই, দক্ষতা অর্জনের মধ্যবর্তী সময়টুকু পেট্রোবাংলা সাবকন্ট্রাক্টর দিয়ে সম্পূর্ণ দেশীয় মালিকানায় সমুদ্রের গ্যাস উত্তোলন করতে পারে। যেসব বিদেশী কোম্পানিকে দিয়ে গ্যাস তোলানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে তারাও কিন্তু একই ভাবে কাজ করে। যেমন: আমাদের সমুদ্রসীমার ঠিক পাশেই মায়ানমারের SHWE গ্যাস ফিল্ডে দক্ষিণ কোরিয়ার DAEWOO মূলত নিম্নলিখিত কন্ট্রাক্টর কোম্পানিগুলো দিয়ে কাজ চালাচ্ছে (সূত্র ৬)-

১) সেমি-সাবমারজিবল রিগ এর জন্য চিনের চায়না ওয়েল ফিল্ড সার্ভিস লিমিটেড কোম্পানি;

২) হেলিকপ্টারের জন্য নিউজিল্যান্ডের হেলিকপ্টার এনজেড নামের কোম্পানি;

৩) অফশোর সাপোর্ট ভ্যাসেল এর জন্য সিংগাপুর-হংকং এর সোয়ার পেসিফিক অফশোর নামের কোম্পানি;

৪) সার্ভে জাহাজের জন্য সিংগাপুর-সুইডেনের ভাইকিং ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি;

তাহলে পেট্রোবাংলার অনশোরে যে দক্ষতা সেটা ব্যবহার করে আর কিছু না হোক অফশোরে এই সব সাব-কন্ট্রাক্টর কোম্পানির সুপারভিশন কেন করতে পারবে না?

লুটেরা উন্নয়ন দর্শন:

এই যে সাগর লুটের আয়োজন সম্পন্ন করে এনেছে শাসক শ্রেণী, সাগরের গ্যাস ইজারার নামে আসলে দেশের ভাবিষ্যৎ, জাতীয় সম্পদ ও জ্বালানী নিরাপত্তাকেই ইজারা দিতে চাচ্ছে তার পেছনে ম.তামিম বা তৌফিক ইলাহি চৌধুরীদের কারসাজি থাকলেও মূল কিন্তু আরো গোড়ায়- বুর্জোয়া শাসকদের উন্নয়ন দর্শনেই নিহিত। যে উন্নয়ন দর্শনে বাজার উদারীকরণ, বেসরকারীকরণ, প্রবৃদ্ধি, বিদেশী বিনিয়োগ ইত্যাদির দোহাই পেড়ে জনগণের স্বার্থকে জবাই করে গুটিকয়েকের জন্য সোনার ডিম সংগ্রহ করা হয়, সে উন্নয়ন দর্শনের যুক্তিতে গ্যাস রপ্তানির সিদ্ধান্তটা খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। আরে বাবা, গ্যাস যদি রপ্তানির সুযোগ না দাও তাহলে কি বিদেশী বিনিয়োগ আসবে? আর বিদেশী বিনিয়োগ যদি না আসে, যদি বহুজাতিক দক্ষতা নিয়োজিত না হয়, তাহলে কি আমরা কোনদিনও আমাদের গ্যাস উত্তোলন করতে পারবো, এখন তো তাও ২০% পাচ্ছি, তখন তো সাগরের নীচে পচবে সে গ্যাস! — এই উন্নয়ন দর্শনটাই ভ্রান্ত, এই উন্নয়ন দর্শন লুটপাটের বাস্তবতা তৈরী করে, এটাকে চ্যালেঞ্জ করা দরকার। বলা দরকার, পুঁজির অভাবের কথা বলে শাসক শ্রেণী বহুজাতিক কে ডেকে আনছে কিন্তু বাস্তবে তো জনগণের টাকা থেকেই সেই বহুজাতিকের বাড়তি পুঁজির যোগান দিচ্ছে। বছরে মাত্র কয়েকশ’ কোটি টাকার অভাবে যেখানে বাপেক্স অত্যন্ত দক্ষ ও সক্ষম একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করতে পারছে না সেখানে ডেকে আনা বহুজাতিক কে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। আর দক্ষতার কথা? আমরা দেখেছি বহুজাতিকেরা নিজেদের অভিজ্ঞ ও পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতির মালিক বলে দাবি করলেও বাস্তবে তারাও যন্ত্রপাতি ও টেকনিশিয়ানদের ভাড়া করে এনে কাজ করায়। সেই কাজটুকুও যে মুনাফাবাজির কারণে তারা ঠিক ঠাক সম্পন্ন করতে পারে না তার নজির– বহুজাতিক অক্সিডেন্টাল আর নাইকো মিলে মাগুরছড়া আর টেংরাটিলার  বিপুল পরিমাণ গ্যাস নষ্ট করা, আন্তর্জাতিক বাজারে যার দর এখন প্রায় ৩০-৩৫ হাজার কোটি টাকার মতো। কই আমাদের বাপেক্স তো এরকম কিছু ঘটায়নি!

এই রকম একটা বাস্তবতায় নিম্নোক্ত দাবীগুলো বাস্তবায়ন করা জরুরী-

১) ৮০% মালিকানা এবং রপ্তানির বিধান রেখে কনোকো ফিলিপস এবং টাল্লোকে গ্যাস ব্লক ইজারা দেয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে।

২) বহুজাতিক সান্তোসকে পেট্রোবাংলাকে পাশ কাটিয়ে তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রির অনুমোদন বাতিল করতে হবে।

৩) গ্যাস/কয়লা ইত্যাদি রপ্তানি নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে।

৪) মডেল পিএসসি ২০০৮ সহ ইতিপূর্বে সম্পাদিত সকল গণবিরোধী পিএসসি চুক্তি বাতিল করতে হবে।

৫) বাপেক্স সহ সকল দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে আরও দক্ষ ও শক্তিশালী করার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে যেন স্থলভাগের মতো গভীর সমুদ্রেও দেশীয় কোম্পানিগুলো নিজেরাই তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন কার্য চালাতে পারে। মধ্যবর্তী সময়টুকুতে একটি বা দুটি ব্লক থেকে কাজ চালানোর মতো গ্যাস উত্তোলনের জন্য বাপেক্সের কর্তৃত্ত্বাধীনে দেশী-বিদেশী কন্ট্রাক্টর ও যন্ত্রপাতি ভাড়া করা যেতে পারে।

আসুন তেল-গ্যাস-বিদুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতৃত্বে বিবিয়ানা কিংবা ফুলবাড়ির মতো এবারও জাতীয় সম্পদ লুটপাট প্রতিহত করি, শ্লোগান তুলি: তেল-গ্যাস-বন্দর/ইজারা দেয়া চলবে না, আমার দেশের গ্যাস-কয়লা/আমার দেশেই রাখব।

কল্লোল মোস্তফা

২২ মে, ২০১১।

তথ্য সূত্র:

১) দ্য ডেইলি সান, ৮ মে, ২০১১

http://www.daily-sun.com/?view=details&type=daily_sun_news&pub_no=209&cat_id=1&menu_id=1&news_type_id=1&index=0

২) বাপেক্স: GEOPHYSICAL DIVISION AT A GLANCE

http://www.bapex.com.bd/geophysicaldivn.html

৩) Country Report for Myanmar Presented by U Kyaw Nyein Managing Director Myanma Oil and Gas Enterprise

৪) অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, ১০ জুলাই ২০০৯ তারিখে সাপ্তাহিক আয়োজিত ‘তেল-গ্যাস রপ্তানি: উৎপাদন বন্টন চুক্তি ও জনস্বার্থ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক।

৫) পেট্রোবাংলার বার্ষিক রিপোর্ট, ২০০৮

http://www.petrobangla.org.bd/annual%20report%202008.pdf

৬) Shwe Gas Movement এর ওয়েবাসাইট

http://www.shwe.org/about-shwe