Tuesday, May 12th, 2009
প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ লুণ্ঠনরোধে জনগণের আন্দোলন চলবে
আমাদের মত দরিদ্র দুর্বল এবং দুর্নীতিপরায়ণ দেশে সাম্রাজ্যবাদ ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলি সে দেশের প্রাকৃতিক জ্বালানী ও অন্যান্য সম্পদ লুণ্ঠন ও পাচার করে তাদের নিরাপত্তা ও উন্নতির অগ্রগতি সাধন করে এবং লুণ্ঠিত দেশের জ্বালানী ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ধ্বংস করে। অবশ্য তারা বহুকাল ধরে তাদের লুণ্ঠনের সহযোগী দেশীয় ধনিক শ্রেণীর সৃষ্টি ও বিকাশ সাধন করে যায়। শ্রেণী বৈষম্যের জন্ম দিয়ে দেশীয় লুণ্ঠনকারী শোষক শ্রেণীর পুষ্টি বিধান করে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দানের মাধ্যমে যথা শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি রাষ্ট্রীয় সেবাখাত পঙ্গু করে শিক্ষা, চিকিৎসাসেবা ইত্যাদিকে পণ্যে রূপান্তরিত করে অর্থাৎ সব কিছু প্রাইভেট করার মাধ্যমে। এই ধনিক শ্রেণীর বিভিন্ন অংশ পালাবদল করে বিভিন্ন সময় দেশের শাসনভার গ্রহণ করে এবং সাম্রাজ্যবাদের লুণ্ঠনের জন্য দেশের জ্বালানী ও অন্যান্য সম্পদ লুণ্ঠনের এবং পাচারের জন্য দ্বার অবারিত ও উন্মুক্ত করে দেয় ও দেশে ভয়াবহ দুর্নীতি ও অপসংস্কৃতির জন্ম দেয়। আমাদের দেশেও সাম্রাজ্যবাদ ও দেশীয় ধনিক শ্রেণীর সরকারের সেই খেলা চলছে। স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সরকারের আমলে বিভিন্ন চুক্তির মাধ্যমে সম্পদ লুণ্ঠন ও পাচার হয়েছে ও আমাদের জীবনযাত্রা বিঘিœত হয়েছে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। সামান্য ব্যবসায়িক স্বার্থের সুবিধার বিনিময়ে টিফা, সোফা, হানা ইত্যাদি চুক্তি করার টোপ দিয়ে যাচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ।
২০০৬ সালে দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে বহুজাতিক কোম্পানি এশিয়া এনার্জিকে উন্মুক্ত খনন পদ্ধতির মাধ্যমে পরিবেশের ভয়াবহ সর্বনাশা চুক্তি করে মাত্র শতকরা ৬ ভাগ রয়্যালটির বিনিময়ে শতকরা ৯৪ ভাগ লুণ্ঠন ও পাচারের ব্যবস্থা পাকাপাকি করেছিল। জাতীয় কমিটির নেতৃত্বে প্রাণ বাজী রেখে জনগণের সংগ্রামের ফলে এই চুক্তি সফল করতে পারে নাই। তখনকার বিরোধী দলনেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ২৬ আগস্ট ২০০৬ এর গণঅভ্যূত্থানের কয়েকদিন পর ফুলবাড়ীতে দাড়িয়ে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা দেন যে উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি দেশের কোথাও করতে দেয়া হবে না। বর্তমানে ক্ষমতাসীন হয়ে তিনি তার প্রতিশ্র“তি থেকে সরে আসার জন্য কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন। স¤প্রতি তিনি উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে পরিবেশের ক্ষতি হবে কিনা তা নির্নয়ের জন্য এক্সপার্ট নিয়োগ করার নির্দেশ দিয়েছেন যাতে একান্ত অনুগত এক্সপার্ট এর মাধ্যমে সার্টিফিকেট জোগাড় করা যায় যে, পরিবেশের ক্ষতির পরিমাণ গ্রহণযোগ্যতার মাত্রা অতিক্রম করবে না এবং তারপর উন্মুক্ত খনি পদ্ধতি তথা কয়লা রপ্তানির পক্ষে চেষ্টা চালানো হবে। কি চাতুরী !
ইতোপূর্বে ২০০১ সালে বিবিয়ানা কূপ থেকে, এই পর্যন্ত আবিষ্কৃত মজুদের প্রায় এক চতুর্থাংশ পরিমাণ গ্যাস নাম মাত্র মূলে ভারতে পাচার করার জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু জাতীয় কমিটির লংমার্চ ও জনগণের আন্দোলনের চাপে তৎকালীন খালেদা জিয়ার সরকার এই লুণ্ঠন ও পাচার থেকে বিরত থাকেন। কয়েক বছর পর এলেন ভারতের টাটা কোম্পানি যারা ৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের মূলা ভুলিয়ে গ্যাসকে পণ্যে রূপান্তরিত করে গ্যাস লুণ্ঠন ও পাচারের উদ্যোগ নেন। জাতীয় কমিটির আন্দোলনের ফলে টাটার ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়।
২০০২ সালের চট্টগ্রাম বন্দরকে পঙ্গু বা ধ্বংস করে বন্দরের অদূরে ভাটিতে একটি প্রাইভেট কন্টেইনার পোর্ট স্থাপনের জন্য বহুজাতিক কোম্পানি স্টিভিডোর সার্ভিসেস অব আমেরিকা নামে বহুজাতিক কোম্পানিকে নিয়োগের জন্য সরকার উদ্যোগ নেন ও মার্কিন রাষ্ট্রদূত এই চুক্তির জন্য অবিরাম চাপ দিতে থাকেন। চট্টগ্রামের সুশীল সমাজে এই প্রকল্পে মাহাত্ম্য ব্যাখ্যা করে সমর্থন আদায়ের জন্য পৌন:পৌনিক চেষ্টা করতে থাকেন। আমাদের জাতীয় কমিটির উদ্যোগে লংমার্চ ও জনগণের আন্দোলনের ফলে এই চক্রান্ত ব্যর্থ হয়। এই চক্রান্তের মধ্যে পোর্টে জেটির এক অংশে আমেরিকানদের একটি নৌ-সেনা ঘাটি স্থাপনের চক্রান্ত ও অন্তর্ভূক্ত।
সর্বশেষে বর্তমান সরকারের আমলে কয়েকটি লুণ্ঠনের ঘটনা ইতিমধ্যে ঘটে গেছে যথা (১) পেট্রোবাংলাকে একটি নির্দিষ্ট দরে গ্যাস সরবরাহ চুক্তি থাকা সত্ত্বেও কন্ট্রাক্টর বহুজাতিক কোম্পানি কেয়ার্নকে তৃতীয় যে কোন পক্ষের কাছে (বর্তমান গ্যাস সংকটের সুযোগে) বহুগুণ বেশী দামে বিক্রয় করে আকাশচুম্বি মুনাফার সুযোগ দেয়া হয়েছে। (২) বহুজাতিক কোম্পানি শেভনকে ১২ ও ১৩ নম্বর ব্লকে বিনা প্রতিযোগিতায় বিরাট এলাকায় সাইজমিক জরীপ করার কাজ দেয়া হয়েছে, দুই দফায়, যা বিধি অনুসারে দেশে জাতীয় সংস্থা বাপেক্সকে দেবার কথা। (৩) সুনির্দিষ্ট বিধি লংঘন করে বিনা প্রতিযোগিতায় শেভরনকে ৫৫.৭ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে চালু গ্যাস পাইপ লাইনের চাপ বাড়ানোর জন্য কম্প্রেসার যন্ত্র সরবরাহ ও স্থাপনার কাজ দেয়া হয়েছে।
এবার সাগর তলের তেল-গ্যাস সম্পদ লুণ্ঠন ও পাচারের ষড়যন্ত্রের কথা বলি। বিগত অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সাম্রাজ্যবাদ ড. তামিম নামে এক অনুগত উপদেষ্টাকে নিয়োগের ব্যবস্থা করে অতি তাড়াতাড়ি সাগরের তেল-গ্যাস লুণ্ঠন ও পাচারের জন্য মডেল পিএসসি- ২০০৮ প্রণয়ন করে। সাগর এলাকা ২৮টি ব্লকে ভাগ করে ২০০৮ ফেব্র“য়ারিতে দরপত্র আহ্বান এবং তিন মাস পরে দরপত্র গ্রহণ করে। এত তাড়াতাড়ি করা হয় সেনা সমর্থিত অবৈধ সরকারের আমলে জনমতের তোয়াক্কা না করে এই জনস্বার্থ বিরোধী চুক্তি করে ফেলার জন্য। যা হোক ৯টি ব্লকের দরপত্র পাওয়া যায় তার ভিত্তিতে ২০০৮ এর অক্টোবর মাসে ২টি বহুজাতিক কোম্পানিকে নির্বাচন করা হয় এবং তাদের কাজ দেবার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপর ঐ উপদেষ্টা পৌন:পৌনিক ভাবে চাপ দিতে থাকে কিন্তু জাতীয় কমিটির প্রতিবাদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কাজ দিতে সাহস পাননি। কিন্তু জনগণের বিরাট অংশের ভোটে নির্বাচিত হয়ে বর্তমান সরকার ড. তামিমের ভয়কে সম্পূর্ণ হাস্যকর প্রমাণ করে অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রণীত ভয়ঙ্কর জনস্বার্থবিরোধী চুক্তি সম্পাদনের জন্য তাদের নির্বাচিত দুটি বহুজাতিক কোম্পানি যথা আমেরিকার কনোকো ফিলিপস, আইরিশ কোম্পানি তাল্লোকে যথাক্রমে ১০, ১১ ও ৫নং ব্লকের চুক্তি সম্পাদনের স¤প্রতি আদেশ দিয়েছেন এই অক্টোবর মাসেই তা হয়ে যাবে আমরা রুখতে না পারলে। এই চুক্তি অনুযায়ী আমরা সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ গ্যাস পাবো, তবে কন্ট্রাক্টরের ৮০ শতাংশ একটি নির্দিষ্ট দরে আমাদের কেনার অধিকার থাকবে। এই শর্ত একটি বিরাট চাতুরী এবং নিষ্ঠুর রসিকতা। কারণ, এই গ্যাস আমাদের দেওয়া হবে দেড়শ মাইল দূরে গভীর সুমদ্রের কূপে। সেখান থেকে উপকূলে পরিবহন করার জন্য কন্ট্রাক্টরের কোন বাধ্যবাধকতা নেই এবং আমাদের পক্ষে এই পরিবহন আমাদের আর্থিক বা কারিগরি সামর্থের বাইরে।
প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে, চুক্তিতে আছে- সমুদ্রকূপ থেকে উপকূল পর্যন্ত কন্ট্রাক্টর (আমাদের ব্যয়ে) পরিবহণ করে দিতে পারে তাদের মর্জি হলে, বলা আছে Contractor has the right to construct and operate one or more pipelines …………… at Contractor’s option. অর্থাৎ কন্ট্রাক্টরের কোনই বাধ্যবাধকতা নেই। সবাই জানেন যে, কোন কন্ট্রাক্টরের কাজ হচ্ছে কাজ করে দেওয়া। কাজ করার বা না করার অধিকার সংরক্ষণ করা নয়। এ ধরণের দাম্ভিক শর্ত চুক্তিতে আরও আছে। তাতে মনে হয়, মডেল পিএসসি ২০০৮ এর ড্রাফট ড. তামিম করেননি, তার হয়ে করে দিয়েছেন চুক্তি প্রত্যাশী কোন বহুজাতিক কোম্পানি।
অতএব অনিবার্যভারে শতভাগ তেল-গ্যাস তরলায়িত করে বহুজাতিক কোম্পানি সমুদ্র কূপ থেকেই পাচার করতে পারবে। আমরা শুধুই পাবো আমাদের অংশের অর্থাৎ সর্বোচ্চ ২০ শতাংশের মূল্য, তেল-গ্যাস কিছুই পাবো না। এটা সহজবোধ্য যে, মডেল পিএসসি-২০০৮ একটি প্রতারণামূলক চুক্তি যার মাধ্যমে শতভাগ তেল-গ্যাস লুণ্ঠন ও পাচার হয়ে যাবে। চুক্তি অনুসারে কনোকো ফিলিপসকে গ্যাস উত্তোলনের জন্য ১২ বছর সময় দেয়া হয়েছে আর তাল্লোকে দেয়া হয়েছে ১১ বছর। আমরা যদি পরিবহন করে কূলে আনতে পারতাম তা ও বর্তমান গ্যাস বিদ্যুৎ সংকট নিরসনে কাজে লাগত না। প্রধানমন্ত্রী বলে চলেছেন সমুদ্রের তেল-গ্যাস উত্তোলন না করা হলে দেশের উন্নয়ন হবে কীভাবে। প্রধানমন্ত্রী এই সত্য লুকাচ্ছেন যে, এই তেল-গ্যাস আমাদের জন্য নয় বহুজাতিক কোম্পানির জন্য। তা আবার আমাদের রিজার্ভ নিঃশেষ করে। প্রধানমন্ত্রীর অভয়বানী একটি ভাওতামাত্র। সরকারের ভাওতাবাজির আরেকটি প্রমাণ এই যে, একদিকে জাতীয় কমিটির সঙ্গে আলোচনা করার জন্য ডাকা হচ্ছে অন্যদিকে বহুজাতিক কোম্পানিদ্বয়ের সঙ্গে অতিদ্রুত চুক্তি করার জন্যে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে।
এই চুক্তির কারণে আমরা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে অপরাধী হয়ে যাবো। আরেকটি বড় ষড়যন্ত্র হচ্ছে আমাদের ন্যায্য সমুদ্রসীমার উপর আমাদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন প্রতিবেশী দেশ এই ৩টি ব্লকের কোন অংশের আপত্তি জানালে আমরা কোন বিরোধে জড়াবো না। ভদ্রভাবে অনাপত্তি অংশেই দখল রাখব। সম্ভবত আমেরিকা ও ভারতীয় আধিপত্যবাদের চাপে সরকার এই সুশীল নীতি গ্রহণ করেছে যাতে আমাদের ৩টি ব্লকে আমেরিকান ও আইরিশ কোম্পানি দখল নেবার এবং পার্শ্ববর্তী সকল ব্লকে আমেরিকার বন্ধু ভারতীয় কোম্পানি বা আমেরিকান কোম্পানি বসে যাবে। ফলে বঙ্গোপসাগর তেল-গ্যাস অনুসন্ধান উত্তোলনের নামে মার্কিন নৌ-বহরের ঘাটি হয়ে যেতে পারে।
আমাদের দাবী: বর্তমান মডেল পিএসসি ২০০৮ বাতিল করা হোক। এই মডেলের ভিত্তিতে দুটি বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন থেকে বিরত থাকা, বা হয়ে গেলে তা বাতিল করা হোক। এই চুক্তির পক্ষে বা বিপক্ষে জনমত যাচাইয়ের জন্যে দেশব্যাপী গণভোট অনুষ্ঠান করা হোক ও এই গণভোটের ফলাফল জানার আগে চুক্তি সম্পাদন ক্রিয়া স্থগিত করা হোক। নতুন মডেল পিএসসি এর মাধ্যমে সমুদ্রবক্ষের তেল-গ্যাস উত্তোলনের জন্যে জরুরী উদ্যোগ নেয়া হোক। সেই নতুল মডেলে থাকবে, তেল-গ্যাসের উপর বাংলাদেশের শতভাগ মালিকানার শর্ত। কন্ট্রাক্টর অনুসন্ধান, বিফলতার ঝুঁকি গ্রহণ, উত্তোলন, পরিবহন সবকিছু করতে বাধ্য থাকবে ও তদনুসারে তাদের সকল ব্যয় ও ঝুঁকি-সংস্থান ও ন্যায্য মুনাফা স্থির করে মোট দর দেবেন। স্বচ্ছ ও প্রতিযোগিতার মাধ্যমে টেন্ডারে যে দাতার দর সর্বাপেক্ষা অনুকুলে থাকবে তার দর গ্রহণ করা হবে।
আমাদের দাবীর মধ্যে আরও আছে: ফুলবাড়ি ৬ দফা চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন। জাতীয় প্রতিস্ঠান বাপেক্স ও পেট্টোবাংলাকে দুর্নীতিমুক্ত করে কারিগরি ও আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
মতিন পাটোয়ারী কৃত কয়লা নীতি রিপোর্ট কোন সংশোধন ব্যতিরেকে অবিলম্বে অনুমোদন ও গ্রহণ করে করে জরুরী ভিত্তিতে সুড়ঙ্গ পদ্ধতিতে অর্থাৎ পানি, মানুষসহ পরিবেশের ন্যুনতম ক্ষতির বিনিময়ে কয়লা উত্তোলন করে দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদন (৪ বছরের মধ্যেই যা সম্ভব)।