?> বাজেট ২০২০-২১ ও সরকারি তৎপরতা বিষয়ে জাতীয় কমিটির সাংবাদিক সম্মেলনে পঠিত বক্তব্য « NCBD – National Committee of Bangladesh

Sunday, June 14th, 2020

বাজেট ২০২০-২১ ও সরকারি তৎপরতা বিষয়ে জাতীয় কমিটির সাংবাদিক সম্মেলনে পঠিত বক্তব্য

রামপাল ও রূপপুরসহ স্বাস্থ্যঝুঁকিপূর্ণ এবং প্রাণবিনাশী প্রকল্প বন্ধ কর।
বিষাক্ত প্রকল্প নয়, সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ও খাদ্য নিরাপত্তা চাই।

বাজেট ২০২০-২১ ও সরকারি তৎপরতা বিষয়ে জাতীয় কমিটির সাংবাদিক সম্মেলন

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
করোনা বিপর্যয়কালে আপনাদের সবাইকে জাতীয় কমিটির পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাই।
গত ১১ জুন বর্তমান সরকারের অর্থমন্ত্রী আগামী অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেছেন। এবিষয়ে বিশেষত জ্বালানী ও বিদ্যুৎ খাত এবং সরকারের উন্নয়ন দৃষ্টিভঙ্গী ও অগ্রাধিকার নিয়ে আমাদের বক্তব্য আপনাদের মাধ্যমে দেশবাসীকে জানানোর জন্য আজ আপনাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছি।

আমরা গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, করোনা ভাইরাস বা কোভিট-১৯ এর আক্রমণে যখন সারা বিশ্বই দিশেহারা, যখন বাংলাদেশের মানুষ চিকিৎসা, খাদ্য ও নিরাপত্তা সংকটে বিপর্যস্ত তখনও সরকার আগের তথাকথিত ‘উন্নয়ন’ ধারা অব্যাহত রেখেই বাজেট (২০২০-২১) পেশ করেছেন। সরকার যখন ‘উন্নয়নের মহাসড়কে’ দেশকে নিয়ে যাবার দাবি করছেন তখন আমরা দেখছি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার ভয়াবহ দুরবস্থা, ডাক্তার নার্সের অভাব, সরঞ্জাম নেই, বাজেট নেই, পর্যাপ্ত শয্যা নেই, অক্সিজেন ব্যবস্থা মহাদুর্র্বল, আইসিইউ হাতেগোণা। বিনা চিকিৎসায় জানা অজানা সংখ্যায় মানুষ মরছে। সুরক্ষার অভাবে ডাক্তার নার্সসহ সুরক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা আক্রান্ত হচ্ছেন, মারা যাচ্ছেন। আর সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাবে, জরুরীভিত্তিতে করোনা সংকটে কর্মহীন কয়েক কোটি মানুষকে খাদ্য যোগান না দেয়ায়, অনাহারে-অর্ধাহারে রয়েছে অসংখ্য মানুষ, লকডাউন অকার্যকর হয়ে পড়ছে।

করোনা ভাইরাসের বৈশ্বিক সংকট স্পষ্ট করেছে যে, স্বাস্থ্যসেবা এবং খাদ্য নিরাপত্তাই হতে হবে উন্নয়নের প্রধান ভিত্তি। স্বাস্থ্যসেবা কোনোভাবে বেচাকেনার বা ব্যক্তিগত মুনাফার বিষয় হতে পারে না। স্বাস্থ্যসেবা প্রতিটি নাগরিকের অধিকার, রাষ্ট্রের দায়িত্ব সর্বজনের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। কিন্তু এই বাজেটে রাষ্ট্রের এই দায়িত্বের কোনো প্রতিফলন নেই। উল্টো মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি আরও বৃদ্ধির বিভিন্ন প্রকল্পকেই অগ্রাধিকারভুক্ত প্রকল্প হিসেবে সরকার অব্যাহত রেখেছে।

করোনার আগে থেকেই উন্নয়নের নামে বিভিন্ন ক্ষতিকর ও অপ্রয়োজনীয় দূষণকারী প্রকল্পের কারণে সারাদেশে দূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এই করোনাকালেও এর কোনো বিরতি ঘটেনি। ঢাকার বাতাস এখন বিশ্বে সবচাইতে বেশি দূষণের রেকর্ড করেছে; দেশজুড়ে বন উজাড়, নদী, পানি ও বায়ু দূষণ বেড়ে যাওয়ায় শ্বাসকষ্ট, কিডনী-ফুসফুস-হৃদযন্ত্র জটিলতা সহ নানা অসুখ বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমেছে মানুষের। এর সমাধানের পথে না গিয়ে সরকার উল্টো বিপুল উৎসাহে ব্যাপক জটিল অসুস্থতা তৈরির কয়লা আর পারমাণবিক প্রকল্প করছে একের পর এক, যার ভয়ংকর পরিণতি চিন্তা করাও কঠিন। প্রাথমিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ক্ষমার অযোগ্য ব্যর্থতা থাকলেও আরও বহুগুণ বর্জ্যসৃষ্টিকারী কয়লা ও পারমাণবিক কেন্দ্র ভিত্তিক ‘উন্নয়নের’ পথে যেতে সরকারের অতি উৎসাহ দেশ মানুষ প্রাণ প্রকৃতির জন্য ভয়াবহ হুমকিস্বরূপ। এগুলো দীর্ঘমেয়াদে দেশের জন্য শুধু আর্থিক বোঝাই সৃষ্টি করবে না, প্রাণ প্রকৃতি বিনাশ করে দেশ ও জননিরাপত্তাকে আরও বিপর্যস্তও করবে, মানুষ ব্যাপক স্বাস্থ্যঝুঁকি ও দুর্যোগের মধ্যে পতিত হবে। বাংলাদেশে দূষণ বৃদ্ধির হার এবং ধনী বৃদ্ধির হার বিশ্বে রেকর্ড করেছে এবং তা পরস্পর সম্পর্কিত।

সুলভ পরিবেশ বান্ধব পথে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব
অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট বক্তৃতায় গর্বের সঙ্গে বলেছেন যে, পায়রা, মহেশখালী ও মাতারবাড়ীতে বিদ্যুতের হাব বানানো হবে, যা প্রধানত কয়লা ভিত্তিক। আরও বলেছেন যে, রামপাল, পায়রা ও মাতারবাড়ীতে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ চলছে পূর্ণোদ্যমে। মহেশখালীতে ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ করা হচ্ছে। রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজও চলছে। অথচ আইলা, সিডর, বুলবুলের পর সাম্প্রতিক আমফান আবারও দেখিয়েছে বাংলাদেশ রক্ষায় সুন্দরবন কতোটা গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা পালন করে। আর উন্নয়নের কথা বলে সরকার শুধু সুন্দরবন বিনাশী রামপাল প্রকল্প অব্যাহত রাখেনি আরও তিন শতাধিক, সুন্দরবন ও উপক’লীয় অঞ্চলের জন্য বিপজ্জনক প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে।

শিক্ষা ও গবেষণা খাতসহ জাতীয় সক্ষমতা বিকাশে গুরুত্ব না দেবার ধারাবাহিকতা এই বাজেটেও অব্যাহত রাখা হয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের মতো একটি ভয়াবহ প্রকল্পের জন্য উচ্চ বরাদ্দকে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে দেখিয়ে প্রতারণামূলক ভ’মিকা গ্রহণ করেছে সরকার। আমরা জানি, ২০১০ সালে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রাথমিক খরচ ধরা হয়েছিল ৩২ হাজার কোটি টাকা। গত ৯ বছরে এই খরচ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১ লক্ষ ২৫ হাজার কোটি টাকা, ক্রমে তা আরও বাড়ছে।

বাংলাদেশে এইসব ব্যয়বহুল প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন তুললেই বলা হয় উন্নয়নের জন্যে বিদ্যুৎ অপরিহার্য, সস্তা বলে কয়লা এবং পারমাণবিক বিদ্যুতের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু আমরা জাতীয় কমিটির পক্ষ থেকে কয়েক বছরের গবেষণালব্ধ ফল নিয়ে ২০১৭ সালে বিকল্প মহাপরিকল্পনার খসড়া উপস্থিত করেছি। কম ব্যয়ে পরিবেশ সম্মতভাবে দেশের সকলের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ যে সম্ভব সেটাই আমরা তথ্য প্রমাণ সহ দেখিয়েছি। দেখিয়েছি যে, এর জন্য রামপাল রূপপুরের মতো ধ্বংস প্রকল্পের কোনো প্রয়োজন নেই। বিশ্বের বহু সংস্থার গবেষণায় এর পক্ষে যুক্তি পাওয়া যায়।

গত ২ জুন জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল রিনিউবল এনার্জি এজেন্সির (আইআরইএনএ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সৌর ও বায়ুর মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের খরচ প্রতিবছর ১৩ শতাংশ করে কমছে। গত ১০ বছরে সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় ৮২ শতাংশ আর বায়ুবিদ্যুতের ৩৯ শতাংশ কমেছে। ফলে নতুন যেসব কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে, তার উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে নতুন নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে খরচ কম।’ রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, ‘২০১০ সালে ইউনিট–প্রতি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে খরচ পড়ত ৪ হাজার ৬৯৫ ডলার। সেটি ২০১৯ সালে এসে মাত্র ৯৯৫ ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে। আর স্থলভাগে বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ২০১০ সালে খরচ ছিল ইউনিট–প্রতি ১ হাজার ৮৪৯ ডলার, যা এখন ১ হাজার ৪৭৩ ডলারে দাঁড়িয়েছে।’ (প্রথম আলো, ৮ জুন, ২০২০) প্রকৃতপক্ষে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যগত ঝুঁকির বিষয়টি ধরলে কয়লা ও পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ব্যয় সব সময়ই অনেক বেশি ছিল। আর এখন দেখা যাচ্ছে, এসব ঝুঁকি বাদ দিয়ে শুধু আর্থিক উৎপাদন ব্যয় ধরলেও নবায়নযোগ্য জ্বালানির দাম অনেক কম, প্রযুক্তিগত বিকাশের মধ্য দিয়ে যা ক্রমাগত কমছে।

গ্যাস বিদ্যুতের দামবৃদ্ধি কেন?
বাংলাদেশে পরিবেশ ও জনজীবনের জন্যে মারাত্মক হুমকিস্বরূপ বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো নির্মাণে প্রতিবছর বাজেটে বিপুল পরিমাণ বরাদ্দ থাকলেও দেশের গ্যাস সম্পদ অনুসন্ধানে জাতীয় সক্ষমতা বিকাশে এবং তা কার্যকর করায় রাষ্ট্রীয় বরাদ্দ খুবই অপ্রতুল এবং নীতিমালা বৈরী।

দক্ষতা প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও গত ১০ বছরে জাতীয় সংস্থা বাপেক্সকে বসিয়ে রেখে দুই থেকে আড়াই গুণ বেশি দামে বিদেশি কোম্পানিকে দিয়ে কূপ খনন করানো হয়েছে। গ্যাস অনুসন্ধানে জাতীয় সংস্থার কার্যক্রমে বন্ধ্যাত্ব সৃষ্টি করে গ্যাস সংকটের অজুহাতে এলএনজি আমদানি করছে সরকার। বর্তমানে দৈনিক ৬০ কোটি ঘনফুট এলএনজি আমদানির পেছনে বছরে ব্যয় হয় ১৮ হাজার কোটি টাকা।

অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, দেশে এখন ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা আছে, এর দুদিন পর ১৩ জুন পিডিবির ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা গেছে সর্বশেষ সর্বোচ্চ প্রকৃত বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে ১০ হাজার মেগাওয়াট। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, চাহিদা না থাকায় রেন্টাল কেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে বিপুল পরিমাণ ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হচ্ছে, গত বছরে যার পরিমাণ ছিলো ৯ হাজার কোটি টাকা। উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ থাকা সত্ত্বেও ভারত থেকে এখন বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে ১১৬০ মেগাওয়াট। অন্যদিকে প্রাণবিনাশী প্রকল্পগুলোকে অগ্রাধিকার প্রকল্প বানানো হয়েছ

গ্যাস অনুসন্ধানে গুরুত্ব না দেয়ায়, রাষ্ট্রীয় কমদামে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে গ্যাস সরবরাহ না করে বেশি ব্যয়বহুল বিভিন্ন বেসরকারি বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীদের গ্যাস সরবরাহের কারণে এবং অযৌক্তিকভাবে রেন্টাল কুইক রেন্টাল ব্যবসায়ীদের ভর্তুকি দেবার কারণে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। সরকার তার মহাপরিকল্পনা (পিএসএমপি ২০১৬) অনুযায়ী জাতীয় সংস্থার মাধ্যমে দেশের গ্যাস অনুসন্ধান সম্প্রসারণ না করে এলএনজি ও কয়লা আমদানির পথ ধরেছে, দেশ বিনাশী ব্যয়বহুল পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে যাচ্ছে, ব্যয়বহুল কুইকরেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সাথে আত্মঘাতী চুক্তি অব্যাহত রেখেছে। জাতীয় সক্ষমতা বিপর্যস্ত করে সরকার একদিকে সাগরের গ্যাস রপ্তানির বিধান রেখে পিএসসি ২০১৯-এর মাধ্যমে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করছে, অন্যদিকে গ্যাস সঙ্কটের অজুহাতে প্রাণবিনাশী বিভিন্ন প্রকল্পের উদ্যোগ নিচ্ছে। কমদামে পরিবেশসম্মতভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিকল্প মহাপরিকল্পনা উপস্থিত করা সত্ত্বেও তাতে কান না দিয়ে সরকার বিদ্যুৎ খাতকে ক্রমাগত কিছু দেশি বিদেশি গোষ্ঠীর অনিয়ন্ত্রিত মুনাফার খাতে পরিণত করছে। তাদের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়েই বারবার বাড়ানো হচ্ছে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম।

৪৫ হাজার কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করে জাতীয় উন্নয়নে কাজে লাগানো সম্ভব
আজ মাগুড়ছড়া দিবস। ১৯৯৭ সালের এই দিনে সিলেটের ১৪ নম্বর ব্লকের সুরমা বেসিনে মাগুড়ছড়ায় ভয়ংকর বিস্ফোরণ হয়। মাগুড়ছড়া বিস্ফোরণে তদন্ত কমিটির রক্ষণশীল হিসাবেও গ্যাসসম্পদের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২৪৫ বিলিয়ন ঘনফুট। এছাড়া পরিবেশ এর যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা দীর্ঘমেয়াদের এবং পুরোটা পরিমাপযোগ্য নয়। ১৯৯৯ সালে ইউনোক্যাল নামে আরেকটি মার্কিন কোম্পানির সাথে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের ব্যবসা কার্যক্রম বিনিময় করে অক্সিডেন্টাল চলে যায়। মাগুড়ছড়ার ক্ষতিপূরণের বিষয়ে কোন ফয়সালা না করেই সরকার তাদের এই বিনিময় সম্পাদন করতে দেয়। পরবর্তীকালে ইউনোক্যাল-এর ব্যবসা গ্রহণ করেছে আরেকটি মার্কিন কোম্পানি শেভরন। এখন এই কোম্পানির কাছ থেকেই আমাদের পাওনা আদায় করতে হবে।

টেংরাটিলা নামে পরিচিত ছাতক গ্যাসফিল্ডে ২০০৫ সালে ৭ জানুয়ারি ও ২৪ জুন পরপর দুটো বিস্ফোরণ ঘটে। কানাডীয় কোম্পানি নাইকোর অদক্ষতা ও দায়িত্বহীনতার জন্যই এই ভয়ংকর ঘটনা ঘটে। পুরো গ্যাসক্ষেত্র নষ্ট হলে পেট্রোবাংলার প্রতিবেদন মতে তার পরিমাণ ৩০৫.৫ বিসিএফ আর বাপেক্স-নাইকো’র রিপোর্ট মতে ২৬৮ বিসিএফ।

গড় হিসাব বিবেচনা করলে মাগুড়ছড়া ও ছাতক টেংরাটিলার বিস্ফোরণগুলোতে বাংলাদেশের এখন পর্যন্ত প্রমাণিত সর্বমোট গ্যাস মজুতের মধ্যে কমপক্ষে প্রায় ৫৫০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ধ্বংস হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর, স্বাধীন বিশেষজ্ঞ দল, পেট্রোবাংলা এবং অর্থনীতি সমিতির হিসাব ও সমীক্ষা পর্যালোচনা করে আমরা দেখেছি, মাগুড়ছড়া ও টেংরাটিলায় গ্যাস সম্পদের ক্ষতির হিসাবে মার্কিন ও কানাডার কোম্পানির কাছে আমাদের পাওনা দাঁড়ায় কমপক্ষে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। আমরা যদি দীর্ঘমেয়াদে জীববৈচিত্র বিপর্যয়সহ পরিবেশ ও মানবিক ক্ষতি বিবেচনা করি, যদি এই গ্যাস সম্পদের অভাবে বর্তমান বিদ্যুৎ ব্যবস্থার ব্যয়বৃদ্ধি যোগ করি তাহলে ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেক বাড়বে। উল্লেখ্য যে, যে পরিমাণ গ্যাস এই দুটো ক্ষেত্রে নষ্ট হয়েছে তা দিয়ে প্রায় দুই বছরে সারাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব ছিল।

আমাদের দাবি
উপরের সংক্ষিপ্ত বিচার বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে বাজেট বরাদ্দসহ সরকারি নীতিমালায় পরিবর্তন আনার জন্য আমাদের দাবি নিম্নরূপ:
* রামপাল, রূপপুর, মাতারবাড়ী, বাঁশখালী, মহেশখালী, পায়রা, বরগুণাসহ স্বাস্থ্যঝুঁকিপূর্ণ ও প্রাণবিনাশী ব্যয়বহুল প্রকল্প বন্ধ করে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ও খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে।
* সারাদেশে সুলভে সার্বক্ষণিক গ্যাস ও বিদ্যুৎ নিশ্চিত করতে জাতীয় কমিটির প্রস্তাবিত খসড়া মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবার জন্য সরকারি নীতিমালা পুনর্বিন্যাস করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ দিতে হবে। খনিজসম্পদ রপ্তানি নিষিদ্ধ আইন করে শতভাগ সম্পদ দেশের কাজে লাগাতে হবে। যেখানে দাম কমানো সম্ভব সেখানে অযৌক্তিকভাবে গ্যাস ও বিদ্যুতের দামবৃদ্ধি চলবে না।
* শেভ্রন ও নাইকোর কাছ থেকে কমপক্ষে ৪৫ হাজার কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের অর্থ আদায় করে তা এই খাতে জাতীয় সক্ষমতা ও প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশে ব্যয় করতে হবে।
* দুর্নীতি লুটপাটের ‘দায়মুক্তি আইন’ বাতিল করতে হবে। জ্বালানী ও বিদ্যুৎ খাতে ভয়াবহ অনিয়ম, দুর্নীতি ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী তৎপরতা নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করে অপরাধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্তসহ বিচারের সম্মুখীন করতে হবে।
* ফুলবাড়ী, বিরামপুর, নবাবগঞ্জ, পার্বতীপুর-বড়পুকুরিয়াসহ উত্তরবঙ্গ ধ্বংস করে উন্মুক্ত খনির চক্রান্ত বন্ধ এবং অবিলম্বে ফুলবাড়ী নেতৃবৃন্দের নামে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।
* জাতীয় সক্ষমতা বিকাশের পথে সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করে জাতীয় সংস্থার মাধ্যমে স্থলভাগ ও সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন করতে হবে। সর্বজন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খনি প্রকৌশলী, ভূতত্ত্ববিদ, বিশেষজ্ঞ তৈরির জন্য নতুন বিভাগ খোলা, পুরনো বিভাগগুলো শক্তিশালী করা এবং প্রয়োজনীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জন্য পৃথকভাবে অর্থ বরাদ্দ করতে হবে।

জাতীয় কমিটির উপরোক্ত দাবিসমূহ পূরণে করোনাকালে জুনমাস জুড়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় অনলাইন ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে সভা সমাবেশ করা হবে। এই দাবির পক্ষে আগামী ৪ জুলাই শনিবার বাংলাদেশ ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের প্রবাসীদের নিয়ে অনলাইন বৈশ্বিক সংহতি সভা অনুষ্ঠিত হবে। সেই সভা থেকে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।

তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি
১৪ জুন ২০২০