Monday, August 11th, 2008
বাংলাদেশের গ্যাস ও জ্বালানী নীতি এবং ধাতব খনিজ বালি সম্পদ : বর্তমান প্রেক্ষাপট- ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীবৃন্দ
বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ চলছে। কোথাও সশস্ত্র যুদ্ধ, কোথাও বা কূটনৈতিক আবার কোথাও অবরোধের। বিশ্বজুড়ে চলা এসব যুদ্ধের প্রধান কারণ হচ্ছে জ্বালানী তেল এবং খনিজ সম্পদ। কোথাও কোথাও এ যুদ্ধের থাবা এতটাই নগ্ন যে জনপদের পর জনপদ মানুষ মেরে সম্পদ লুণ্ঠন করা হচ্ছে। এরই বড় নিদর্শন ইরাক ও আফগানিস্তান।
আবার কিছু দেশ তাদের শক্তিশালী খনিজ সম্পদ নীতির কারণে তারা যেমন সম্পদ রক্ষা এবং নিজেদের জাতীয় স্বার্থে সম্পূর্ণরূপে ব্যবহার করতে পারছে তেমনি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও চাঙ্গা রেখেছে। যেমন-ভেনিজুয়েলা, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া।
অপরদিকে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায় সেটা দেখতে গেলে আমরা দেখতে পাই যে, একদিকে তুলনামূলকভাবে বিশাল জনগোষ্ঠীর সীমিত সম্পদ অন্যদিকে সরকারের জ্বালানী নীতির দুর্বলতার কারণে অর্থনৈতিক অবস্থা দিন দিন পঙ্গু হতে চলেছে।
বাংলাদেশের বর্তমান খনিজ সম্পদের আহরণ ও বিকাশকে এখানে তিন ভাগে আলোচনা করা হয়েছে।
গ্যাসঃ বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদ হলো গ্যাস। বর্তমান সময়ের সকল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এই সম্পদের উপর নির্ভরশীল। দেশের মোট বিদ্যুৎ চাহিদার শতকরা ৭০ ভাগ উৎপাদিত হয় গ্যাস দ্বারা। সার, সিমেন্টসহ সকল শিল্পের প্রধান শক্তির উৎস এটি। কিন্তু এ সম্পদ আমাদের সীমিত পরিমাণে রয়েছে।
বর্তমান সময়ের সরকারি হিসাব মতে বর্তমানে মজুদ গ্যাস ১৪.৮৪ টিসিএফ, যা দ্বারা ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশের জ্বালানী চাহিদা মেটানো সম্ভব। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে এ হিসাবের মধ্যে মাগুরছড়া এবং টেংরাটিলা গ্যাসের মজুদও ধরা হয়েছে। সুতরাং আমাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় স্থান হলো বঙ্গোপসাগর। সরকার ইতোমধ্যে সাগরকে ১৮টি ব্লকে ভাগ করে ৯টি ব্লক বিদেশী কোম্পানির কাছে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য হস্তান্তর করেছে। এখানে গ্যাস পাওয়া গেলে জ্বালানী সমস্যা আরো কয়েক বছরের জন্য সামাল দেওয়া যাবে।
তবে গ্যাস নিয়ে আরো আলোচনার আগে আমাদের একটু পিছন ফিরে দেখা দরকার। ১৯৯৭ সালে ইউনিক্যাল কোম্পানি মাগুরছড়াতে এবং ২০০৫ সালে নাইকো ছাতক গ্যাসক্ষেত্রে বিস্ফোরণ ঘটায় শুধুমাত্র তাদের অদক্ষতার কারণে। যার ফলে বাংলাদেশ চিরতরে হারায় দুটি গ্যাসক্ষেত্র এবং আর্থিকভাবে বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হয়। বহুজাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানির জালিয়াতির আর একটি উদাহরণ হলো সমুদ্র বক্ষের এক মাত্র গ্যাসক্ষেত্র সাঙ্গু। এই ক্ষেত্রটি ১৯৯৮ সালে আবিষ্কার করে শেল ও কেয়ার্ন এনার্জি কোম্পানি। সে সময় তারা উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মজুদ দেখিয়ে ছিলো ৮৪৮ বিসিএফ। যা থেকে ২০ বছর ধরে গ্যাস উত্তোলন সম্ভব। কিন্তু ১০ বছর যেতে না যেতেই ৪৪০ বিসিএফ গ্যাস উত্তোলন করতেই গ্যাসক্ষেত্রটি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। আর বছর দুই পরই ক্ষেত্রটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে হতে পারে।
তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে শেল ও কেয়ার্ন এনার্জি কোম্পানি কি বেশী লাভের আশায় সরকার এবং পেট্রোবাংলার সাথে জালিয়াতি করেছে?
কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, বারবার বিপুল পরিমাণে জাতীয় সম্পদের ক্ষতি হওয়া সত্ত্বেও আমাদের নীতি নির্ধারকদের সুমতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বরং দেশীয় প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী না করে বারবার বিদেশী বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে বিনিয়োগে আগ্রহী করা হচ্ছে। যেমন দেশীয় কোম্পানি বাপেক্স যেখানে প্রতি ইউনিট গ্যাস বিক্রি করে পায় ৭ টাকার মতো সেখানে আইওসি পায় ২৫০ টাকা যার কারণে তুলনামূলকভাবে ছোট গ্যাসক্ষেত্রগুলো যেখানে বাপেক্স এর জন্য অলাভজনক সেখানে আইওসি এর কাছে সেগুলো লাভজনক গ্যাসক্ষেত্র।
সা¤প্রতিক সময়ে আরও একটি দুঃখজনক ঘটনা দেখা যাচ্ছে যে, তিতাস গ্যাস ক্ষেত্রের বিভিন্ন কূপের মধ্যে ফাটলের কারণে আশেপাশের এলাকায় গ্যাসের উদ্গিরণ ঘটছে Ñ যা শীঘ্রই বন্ধ করা না হলে বড় আকারের ব্লো-আউটের ঘটনার সৃষ্টি হতে পারে। এতে সর্ববৃহৎ এই গ্যাসক্ষেত্রের মৃত্যুই ডেকে আনবে না সেই সঙ্গে আমাদের গ্যাস সম্পদের মেরুদণ্ডও ভেঙ্গে দেবে। কিন্তু আমাদের সরকার এটির জন্য তড়িৎ কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না যা হতাশাব্যঞ্জক।
কয়লা: আমাদের জ্বালানী নিরাপত্তার অন্যতম সম্পদ এখন কয়লা। আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত পাঁচটি কয়লা বেসিন আবিষ্কৃত হয়েছে। এর মধ্যে সর্ববৃহৎটি জামালগঞ্জে। যা কারিগরি ও আর্থিকভাবে লাভজনক নয়। বাকি চারটি বেসিনে মোট কয়লার পরিমাণ ১০২০ মিলিয়ন টন।
বড়পুকুরিয়া কয়লা ক্ষেত্র থেকে পেট্রোবাংলার তত্ত্বাবধানে বিদেশী কারিগরি সহায়তায় কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে। যার বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ১ মিলিয়ন টন। এর অধিকাংশ কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে ব্যবহার হচ্ছে। বাকি কয়লা দেশের অভ্যন্তরীণ জ্বালানী চাহিদা মেটাচ্ছে। যদিও তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য।
সা¤প্রতিক সময়ে ফুলবাড়ী কয়লা বেসিনে কয়লা উত্তোলন প্রসঙ্গে সরকারি নীতি নির্ধারকদের দুর্বলতা, বহুজাতিক কোম্পানির মোটা অংশের লভ্যাংশ পাওয়ার তৎপরতা, সচেতন দেশবাসীর আন্দোলন এ ধরণের অনেকগুলো বিষয় আমরা লক্ষ্য করছি। ফুলবাড়ী বেসিনে উন্মুক্ত মুখ খনন পদ্ধতিতে খনি উন্নয়ন করতে কি ধরণের পরিবেশের ক্ষতি হতে পারে তা নিয়ে বাংলাদেশের নীতি নির্ধারক ও জনগণের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে এবং সরকারের পক্ষ থেকেও তা পরিষ্কার করা হয়নি।
অপরদিকে বাংলাদেশ রয়্যালটি বাবদ পাবে মাত্র ৬% Ñ যা দেশের স্বার্থ বিরোধী। আবার উত্তোলিত কয়লার একটি বড় অংশই রপ্তানি হয়ে যাবে দেশের বাইরে। এতে করে কয়লা উত্তোলনের এবং রপ্তানির মাধ্যমে আমাদের জ্বালানী নিরাপত্তা ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। আর এসব কিছুই হচ্ছে একটি সুষ্ঠু নীতিমালার অভাবে। এ পর্যন্ত প্রণীত কয়লানীতিতে উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে ব্যবহৃত জমি খনন শেষে পুনরুদ্ধার ও প্রকৃত মালিকের কাছে পুনর্বণ্টন বিষয় কোন নীতিমালা অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। সাথে সাথে রয়্যালটি এবং করপোরেট ট্যাক্স এর বিষয়টি সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হয়নি।
এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে সচেতন নাগরিক এবং ফুলবাড়ীর জনগণ স্বত:স্ফুর্তভাবে এ উন্মুক্ত খননের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় এবং যার পরিণতি ২৬ আগস্ট ২০০৬। ঐ দিন বিডিআর এর গুলিতে ৩ জন আন্দোলনকারী শহীদ এবং তিন শতাধিক আহত হয়। এ আন্দোলনের ফলে সরকার মৌখিকভাবে এশিয়া এনার্জির সাথে চুক্তি বাতিল করে এবং খনি সংশ্লিষ্ট সকল কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু সরকার এই বিষয়ে কোন আইনগত পদক্ষেপ নেয়নি, যার ফলে চুক্তিটি এখনও কার্যকর রয়েছে।
আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, রয়্যালটির এত কম রাখা হচ্ছে Ñ কার স্বার্থে এবং কীসের জন্য? উন্মুক্ত পদ্ধতি সকল বিবেচনায় আমাদের জন্য আসলে কতখানি লাভজনক হয়ে উঠবে? কেন কয়লাখনি বিষয়ক আলাদা দেশীয় প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হচ্ছে না এবং বারবার কেন শুধু কয়লা নীতি আলাদা করে প্রণয়ন করা হচ্ছে? কেন সমন্বিতভাবে জ্বালানী নীতি করা হচ্ছে না?
ধাতব খনিজ বালি: আমাদের খনিজ সম্পদে বেশ আগে থেকেই অন্তর্ভুক্ত ছিল ধাতব খনিজ বালি যা ১৯৬২ সালে কক্সবাজার-টেকনাফ সমুদ্র সৈকতে আবিষ্কৃত হয়। কিন্তু এর অনুসন্ধান ও উত্তোলনের কোন উদ্যোগ সে সময় নেওয়া হয়নি। অতি সা¤প্রতিক সময়ে দুটি বহুজাতিক কোম্পানি প্রিমিয়াম মিনারেল এবং কার্বন মাইনিং এ সংশ্লিষ্ট কাজ শুরু করেছে। প্রাথমিক পর্যায়ে তারা শুধুমাত্র অনুসন্ধান কাজের লাইসেন্স লাভ করে। এর মধ্যে প্রিমিয়াম মিনারেল কক্সবাজার-টেকনাফ অঞ্চলে এবং কার্বন মাইনিং কুড়িগ্রাম জেলার ব্রহ্মপুত্র নদীর চর এলাকায় অনুসন্ধান কার্যক্রম চালায়।
আমরা যে বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত তা হচ্ছে Ñ এই ধাতব খনিজ বালি উত্তোলনের অনুমোদন যদি বহুজাতিক কোম্পানি পায় তবে বাংলাদেশ কী পরিমাণ রয়্যালটি পাবে, কী প্রক্রিয়ায় এই খনিজ বালি উত্তোলন করা হবে এবং এক্ষেত্রে সরকারের নীতিমালা কী হবে?
অপরদিকে বাংলাদেশের পরমাণু শক্তি কমিশন কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে ধাতব খনিজ বালি নিয়ে অনেক দিন ধরে একটি প্রকল্প চালাচ্ছে। সেখানে ছোট আকারের একটি প্ল্যান্টের মাধ্যমে তারা বিভিন্ন খনিজ আহরণ করে। এমতাবস্থায় সরকার এই প্রকল্পটিকে আরো শক্তিশালী করার মাধ্যমে দেশীয়ভাবে সম্পদ আহরণ না করে কেন বিদেশী কোম্পানিকে আহ্বান জানাচ্ছে তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়।
উপরোক্ত বিষয়গুলোর আলোচনায় বারবার যে বিষয়টি এসেছে তা হচ্ছে দেশের স্বার্থ রক্ষার্থে প্রয়োজন শক্তিশালী জ্বালানী ও খনিজ নীতিমালা প্রণয়ন। এছাড়া বাপেক্স, পেট্রোবাংলাকে শক্তিশালীকরণ ও নতুনভাবে কয়লা ও ধাতব খনিজের জন্য শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। এসব বিষয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে একটি দিক নির্দেশনামূলক দৃঢ় বক্তব্য ও করণীয় জাতি আশা করে।
[প্রবন্ধটি ১১ আগস্ট ২০০৮ ইং তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীবৃন্দ কর্তৃক আয়োজিত আলোচনা সভায় উপস্থাপিত হয়।]