?> জাতীয় স্বার্থবিরোধী কয়লা নীতি বাতিল করুন, জনগণের স্বার্থে জ্বালানী নীতি প্রণয়ন করুন « NCBD – National Committee of Bangladesh

Wednesday, March 7th, 2007

জাতীয় স্বার্থবিরোধী কয়লা নীতি বাতিল করুন, জনগণের স্বার্থে জ্বালানী নীতি প্রণয়ন করুন

[৭ মার্চ, ২০০৭ ইং তারিখে ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটির সেমিনার কক্ষে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির উদ্যোগে জাতীয় স্বার্থবিরোধী কয়লানীতি বাতিল এবং জনগণের স্বার্থে কয়লা নীতি প্রণয়ন করার দাবীতে একটি গোল টেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন কমিটির আহ্বায়ক শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, প্রকৌশলী এবং মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন কমিটির সদস্য সচিব আনু মুহাম্মদ, অধ্যাপক। বক্তব্যটি হুবহু তুলে দেয়া হলো।]

সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জ্বালানী উপদেষ্টা গত সরকারের সময়ে প্রণীত কয়লা নীতি এই মার্চ মাসের মধ্যেই চূড়ান্ত করতে যাচ্ছেন। আমরা এই খবরে বিস্মিত ও উদ্বিগ্ন। যেখানে বর্তমান সরকার দুর্নীতি ও অনিয়ম দূর করবার অঙ্গীকার প্রকাশ করেছেন সেখানে দুর্নীতি ও অনিয়মের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জ্বালানী সম্পদ বিদেশী কোম্পানির হাতে তুলে দেয়ার নীতি বহাল রাখা স্ববিরোধী ও জাতীয় স্বার্থের জন্য হুমকি স্বরূপ। গত সরকারের জ্বালানী উপদেষ্টা এই কয়লা নীতির উপর ভর করেই ধ্বংসাত্মক ফুলবাড়ী প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি যে বর্তমান জ্বালানী উপদেষ্টাও একই সুরে কথা বলছেন। জাতীয় স্বার্থ বিরোধী দুষ্টনীতি বহাল রেখে দুর্নীতি কীভাবে দূর করা সম্ভব সেটাই আমাদের প্রশ্ন।

এই নীতি প্রণয়নের জন্য সাবেক সরকার দায়িত্ব দিয়েছিল ইনফ্রাকস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ফ্যাসিলিটেশন সেন্টারকে। জ্বালানী বিশেষায়িত জ্ঞান যার বিষয় নয়, উন্নয়ন পরিকল্পনা যার অগ্রাধিকার নয়, ব্যক্তিগত ও প্রধানত বিদেশী ব্যবসায়িক দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা যার প্রধান কাজ সেই সংস্থাকে কয়লা নীতি প্রণয়নের দায়িত্ব দিয়েছিল সাবেক সরকার। সাবেক সরকারের নীতিগত অবস্থান তাই কয়লানীতি করবার আগেই পাওয়া গেছে, তা হল কয়লা সম্পদকে বিদেশী ব্যবসায়িক মালিকানায় হস্তান্তর, জনগণের সম্পত্তি ব্যক্তিগতকরণ, এবং তার ধারাবাহিকতায় কয়লা সম্পদ বিদেশে পাচারকে বৈধতা দান। সেকারণে বাংলাদেশে কয়লা সম্পদের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহারের জন্য দক্ষ জনশক্তি ও উপযোগী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কোন ভিশন এই কয়লা নীতিতে নেই। আছে বাংলাদেশের অক্ষমতা আর অনভিজ্ঞতাকে অজুহাত করে বিদেশী কোম্পানির হাতে দেশের সব সম্পদ দিয়ে দেয়ার নীতি।

মূল দলিলের প্রথম পাতাতেই বলা হচ্ছে, কয়লার যে মজুদ আছে তা বহুদশক ধরে বাংলাদেশের চাহিদা মেটাতে সক্ষম। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি, দক্ষ জনশক্তি এবং অর্থসংস্থানের ক্ষমতা এখনও দেশে গড়ে ওঠেনি। আবার বলা হচ্ছে, রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থা বড় কয়লাখনির জন্য প্রয়োজনীয় পুঁজি যোগান দিতে সক্ষম নয় এবং একই সঙ্গে তার প্রযুক্তি বা অভিজ্ঞতাও নেই। বারবার এই অক্ষমতার বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হলেও এর সমর্থনে কোন তথ্য বা বিশে¬ষণ কোথাও নেই। পুঁজির অভাব বলার আগে কত পুঁজি দরকার, এবং তা সংগ্রহের বিভিন্ন উপায় কী কী হতে পারে, দক্ষ জনশক্তি বা অভিজ্ঞতার অভাব থাকলে তা পূরণের কী কী পথ আছে; দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ চাহিদা কেমন, কত সময় ধরে পরিকল্পনা নেয়া যায়, খনিজ সম্পদের গুণিতক ভূমিকা এসব কোন আলোচনা নেই। অভাবের কথা বারবার বলা হয়েছে পাতা নষ্ট না করে দ্রুত সমাধান বের করে ফেলার জন্য, সেটি হল, “সুতরাং কয়লা নীতির উচিত হবে বাংলাদেশে কয়লাক্ষেত্র উন্নয়নে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করা”। কয়লানীতির এই দলিলের মধ্যেই তাই টাটাকে বড়পুকুরিয়া এবং এশিয়া এনার্জিকে ফুলবাড়ীর ইজারাপ্রাপ্ত দেখিয়ে প্রাক্কলন করা হয়েছে। এই নীতির কেন্দ্রীয় মনোযোগ যেহেতু আভ্যন্তরীণ বাজার সীমিত সেহেতু বিনিয়োগকারীদের বৃহৎ বিনিয়োগের টাকা তুলবার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ রপ্তানির অনুমতি দিতে হবে (পৃ. ১১)। এই রপ্তানির ব্যবস্থা সহজ করবার জন্য কয়লা নীতির অনেক মনোযোগ, রপ্তানির জন্য রাস্তাঘাট, বন্দর উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে বারবার।

কী পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা হবে সে বিষয়ে ১২ পৃষ্ঠায় প্রথমে বলা হয়েছে, এই ক্ষেত্রে একটি বিস্তারিত ফিজিবিলিটি স্টাডি করা উচিৎ যা বিভিন্ন পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের লাভ-ক্ষতি পরীক্ষা করবে, তার পরপরই বলা হয়েছে দীর্ঘমেয়াদে দেশের জ্বালানী নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে সর্বোচ্চ পরিমাণ কয়লা উত্তোলনের মাধ্যমে। এর একমাত্র পথ তো উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন, তাহলে সেটাই যথার্থ! তাহলে ফিজিবিলিটি স্টাডি কেন? সর্বোচ্চ পরিমাণ কয়লা উত্তোলন করলে, তার দেশীয় চাহিদা যেহেতু সীমিত, রপ্তানি করতেই হবে। আর এশিয়া এনার্জি বা টাটা যে শর্তে কাজ চাইছে তাতে রপ্তানি আয়ও মালিকানা অনুযায়ী তাদের। দেশের জন্য থাকবে কয়লাশূণ্য বিষাক্ত বিরাট গর্ত, উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া মানুষের হাহাকার আর পুরো অঞ্চলের উৎপাদনশীল সময়ের স্মৃতি। যতটুকু কয়লা দেশে থাকবে সেটাও বাংলাদেশকে কিনতে হবে কোম্পানির সুবিধামতো দামে। তারপর শুরু করতে হবে আমদানি। তার মানে এই নীতি অনুযায়ী, নিজেদের প্রয়োজন না থাকলেও মানুষ-পরিবেশ-অর্থনীতি ধ্বংস করে বেশী বেশী কয়লা কয়লা উত্তোলন করে তা দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিলেই দেশের জ্বালানী নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে!

এই পদ্ধতিতে কয়লাখননের পরিবেশগত সমস্যা মোকাবিলার কথাও বলা হয়েছে! বলা হয়েছে, দেশে এখন এই বিষয়ে যথাযথ নিয়মকানুন নেই সুতরাং বিশ্বব্যাংকের বিধিমালা অনুসরণ করা যায় (পৃ. ১৪)। আবার বলা হয়েছে, আগামী পাঁচ বছর ধরে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা খননের দীর্ঘমেয়াদে পরিবেশগত প্রভাব পরীক্ষা করবার জন্য সরকারের একটি সমীক্ষা দল গঠন করতে হবে। এটি দেখবে এনেক্স এ-তে নির্দেশিত ক্ষেত্রগুলো ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে উন্মুক্ত পদ্ধতি অব্যাহত থাকবে কী না। এনেক্স এ-র ক্ষেত্রগুলো কী? ফুলবাড়ীতে এশিয়া এনার্জি, বড়পুকুরিয়ায় টাটা….. (পৃ. ২৭)। তারমানে এগুলোর সমীক্ষার দরকার নেই। তাহলে সর্বনাশের আর বাকি থাকে কী?

আমরা মনে করি, কয়লাসহ জ্বালানী সম্পদের দীর্ঘকালীন মজুদ রাখা আর তার সর্বোত্তম ব্যবহারের জন্য দেশে সক্ষমতা তৈরির ওপরই দেশের জ্বালানী নিরাপত্তা নির্ভর করে। সামান্য রয়্যালটির বিনিময়ে সবকিছু ছারখার করে নিজেদের খনিজ সম্পদ পাচার করে দেয়া কোম্পানি বা কতিপয় ব্যক্তির বড় লাভের ব্যাপার হলেও দেশের জন্য ভয়ংকর পরিণতি ডেকে আনতে বাধ্য। এই নীতি এরকম প্রকল্পকেই বৈধতা দেবার লক্ষ্যে প্রণয়ন করেছিল সাবেক সরকার। আমরা আশা করি এরকম জাতীয় স্বার্থ বিরোধী ও ধ্বংসাত্মক নীতি বাতিল করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশের জনগণের শতকরা ১০০ ভাগ মালিকানা রেখে খনিজ সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের জন্য যথোপযুক্ত জ্বালানী  নীতি প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।

তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যু-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি

০৭ মার্চ, ২০০৭।