?> বিদ্যুৎ সংকট, জ্বালানী মন্ত্রণালয়ের দুষ্টগ্রহ এবং বহুজাতিক কোম্পানির আগ্রাসন « NCBD – National Committee of Bangladesh

Tuesday, April 21st, 2009

বিদ্যুৎ সংকট, জ্বালানী মন্ত্রণালয়ের দুষ্টগ্রহ এবং বহুজাতিক কোম্পানির আগ্রাসন

১৯৯৪ সালে Broken Hill Properties বা BHP নামে একটি অস্ট্রেলিয়ান কোম্পানিকে কয়লা অনুসন্ধানের কাজে নিয়োগ করা হয়। কয়লা খনি করতে গেলে কী বিরাট পরিমাণ পানি পাম্প করতে হয় তা একটি ভারতীয় উপদেষ্টা ফার্ম এর নিকট জানার পর তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন যে, ১৫০ মিটারের বেশী গভীরতায় উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হবে এবং ১৯৯৮ সালে দায়িত্ব হস্তান্তর করেন এশিয়া এনার্জির কাছে যাদের জন্ম মাত্র ১ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৯৭ সালে। তখনকার জানা মতে ফুলবাড়ী কয়লা খনির গভীরতা ছিল ২৪০ মিটার। সর্বশেষ অনুসন্ধানে গভীরতা আরো বেশী বলে জানা গেছে। একটি ৮০০ মিটার ব্যাসের একটি বৃত্তাকার এলাকার ১১০ মিটার গভীর জায়গার পানি শুষ্ক করতে প্রতি মিনিটে ৮ থেকে ১০ হাজার লিটার প্রতি পানি নিষ্কাশন করা প্রয়োজন হয়। ২৪০ মিটার গভীরতা ধরলেও ৩ কি.মি. গুণ ২ কি.মি. এরিয়া শুষ্ক করতে প্রতি সেকেন্ডে ৪শ ঘনফুট পানি পাম্প করতে হবে, যা মাঝারি সাইজের নদীর প্রবাহের সমান। এতে খনির কিনারা থেকে চারদিকে ১০ কি.মি.পর্যন্ত জায়গা অর্থাৎ প্রায় ২০০ বর্গমাইল জুড়ে এলাকা মরুভূমি হয়ে যাবে। যা প্রকৃত এলাকার চেয়ে বহুগুণ বেশী। এশিয়া এনার্জির প্রস্তাবে শুধু খনি এলাকার জনবসতি উচ্ছেদ ও পূনর্বাসনের কথা বলা আছে। বাকি বিরাট এলাকার লোকেরা ক্ষতিপূরণ পাবে না তবুও ফসল ফলে না বলে বিনা ক্ষতিপূরণে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হবে। এই সব কথা এশিয়া এনার্জি জানে এবং তাদের দালাল, আমলা, বুদ্ধিজীবি, মন্ত্রী তাদেরও জানার কথা। কয়লা খনির দূষিত পানি ভূ-গর্ভস্থ জলাধারে বহুদূর পর্যন্ত বিষাক্ত করবে। মাছতো মারা যাবেই জলজ জীবও জন্মাতে পারবে না। ফলে বড় আকারের হাহাকার সৃষ্টি হবে। এলাকার অধিবাসী জেনে শুনে সর্বনাশ বরণ করতে চায় না বলে উন্মুক্ত খনন পদ্ধতির বিরোধিতা করে তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলে এবং ২৬ আগস্ট ২০০৬ প্রানান্ত আন্দোলনে ৩ জন নিহত, বহু লোক পঙ্গু এবং শত শত লোক আহত হয়। বিনা উষ্কানিতে নিরাপরাধ ও শান্তিপূর্ণ অবস্থানে জনতার উপর সশস্ত্র বাহিনী গুলি চালায়। পৃথিবীর ইতিহাসে দরিদ্র দুর্বল দেশের খনিজ সম্পদ লুণ্ঠনে প্রতিবাদী জনগণের উপর এ ধরনের গুলি চালানোর ব্যতিক্রম হয় বলে জানা নেই। সম্ভবত এশিয়া এনার্জির ইন্ধনেই গুলি চালানো হয়। এর ৪ দিন পর ৩০ আগস্ট ২০০৬ ফুলবাড়ীর জনগণের সঙ্গে তৎকালীন সরকারের যে চুক্তি হয় তদনুযায়ী অবিলম্বে এশিয়া এনার্জিকে ফুলবাড়ী তথা বাংলাদেশের মাটি থেকে বহিষ্কৃত হবার কথা ছিল। (যদিও এখনো তারা বহাল তবিয়তে আছেন এবং কিছু অর্থ ব্যয় করে মানুষের মন তাদের পক্ষে টানার চেষ্টা করছেন, জনপ্রতিনিধিদের এবং সাংবাদিকদের বিদেশ ভ্রমনসহ নানা পুরষ্কার দিয়ে জনগণের রায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে বিবেক-মূল্য পরিশোধ করছেন।)

চুক্তি সম্পাদনের ৫ দিনের মাথায় অর্থাৎ ৪ সেপ্টেম্বর ২০০৬, তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী এবং বর্তমান প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা ফুলবাড়ী সফরে যান এবং জোরালো ঘোষণা দিয়ে বলেন যে, তিনি চুক্তির প্রতি পূর্ণ সমর্থন করেন এবং বলেন (ক্ষমতায় গেলে) ফুলবাড়ী তথা বাংলাদেশের কোথাও উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা খনি হতে দেবেন না। বর্তমানে ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি এ ব্যাপারে মৌন ব্রত অবলম্বন করেছেন। তবে তাঁর মন্ত্রী এবং আত্মীয়??? খন্দকার মোশারফ হোসেন দাবী করছেন যে (Daily Star, ৯ এপ্রিল ২০০৯), উন্মুক্ত পদ্ধতিই আমাদের সংকট মুক্তির প্রশস্ত পথ। তিনি তার আত্মীয় প্রধান মন্ত্রীকে উদ্ধার করার জন্য উল্টো সুরে গান গাইছেন কিনা জানি না। প্রচারণা করা হয় আমাদের কমিটিও খনি থেকে কয়লা উত্তোলন করতে দিচ্ছে না, তার অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে না। এই প্রচারণা বিশুদ্ধ প্রতারণা, ভাওতাবাজি। আমরা কয়লা উত্তোলন চাই এবং এখনই চাই, অবিলম্বে চাই। কিন্তু কয়লা যেন আমাদের মালিকানায় থাকে এবং কয়লা তুলতে গিয়ে মাটি, মানুষ, ভূ-গর্ভস্থ পানি তথা পরিবেশের কোন ক্ষতি না হয়। বর্তমানে যে সুড়ঙ্গ পদ্ধতিতে বড়পুকুরিয়াতে কয়লা তোলা হচ্ছে সেই পদ্ধতিতে মজুদের মাত্র ১০-২০% মজুদ তোলা সম্ভব। তাতেই আমাদের চাহিদা ২০ বছর পর্যন্ত পূরণ হবে। বাকি ৮০-৯০% খনিতে থাকবে। কোন ক্ষতি নেই সেই কয়লাতো আমাদেরই থাকবে। নিত্য নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার হচ্ছে। ২০ বছরের মধ্যে অবশিষ্ট কয়লা তোলার প্রযুক্তি আবিষ্কার হওয়ার সম্ভাবনা বিলক্ষন। আমাদের বক্তব্য, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে এশিয়া এনার্জি কয়লা তুলে শতকরা ৯৪ ভাগের মালিক হবেন। মাত্র ৬% আমরা পাব। তারা ৮০% পর্যন্ত রপ্তানি করতে পারবে। বাকি ১৪% আন্তর্জাতিক মূল্যে ক্রয় করার অধিকার আমাদের থাকবে। যদি ধরা যায় বর্তমান সুড়ঙ্গ পদ্ধতিতে আমাদের ১০০% মালিকানায় মাত্র ১৫% উঠানো যায় সেই ১৫% বেশী, না উন্মুক্ত পদ্ধতিতে আমাদের শেয়ার, যে ৬%, তা বেশী। অর্থাৎ ২.৫ গুণ বেশী না ১ গুণ বেশী। অথবা মন্ত্রী সাহেবের ধারণা কি এই যে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে তোলা ১ টন কয়লা সুড়ঙ্গ পদ্ধতিতে তোলা ১ টন কয়লার চেয়ে বেশী বিদ্যুৎ দেয়! মন্ত্রী সাহেব বলেছেন পাম্প করা পানির দরুণ উত্তর বঙ্গের পানির অভাব দূর হবে। প্রকৃত পক্ষে পাম্প করা পানি ছাড়বারই সমস্যা হবে। নদী দিয়ে ছাড়তে হবে এবং নদী দিয়ে তা চলে যাবে। পানির একটি অংশ কয়লা ধুতে লাগবে তাতে পানি দূষিত হবে। আবার পানির একটি অংশ মরুকরণের ফলে শুকনা জমিতে পাম্প করে উপরিভাগে কয়েক ফুট ঢুকানো যেতে পারে। কিন্তু কতখানি সফল হবে তা বলা মুশকিল। মন্ত্রী সাহেব বলেছেন, কয়লাখনি করার দরুন উত্তর বঙ্গের পানির প্রাপ্যতা বাড়বে। সত্য এই যে, কয়লাখনি করার কারণে পানির পরিমাণ একটুকু বাড়বে না। এক স্থানের পানি অন্য স্থানে যাবে। আসলে উপরে যা বলা হল, একটি অংশ নদী দিয়ে চলে যাবে, একটি অংশ দূষিত হবে এবং সামান্য অংশ মরুকরণে শুষ্ক হয়ে যাওয়া জমির উপরিস্তর সিক্ত করা যাবে।

সুড়ঙ্গ পদ্ধতিতে মাত্র ১৫% হারে কয়লা যা উঠবে তাতেই আমাদের চাহিদা মিটবে। শতকরা ১৫ ভাগ ধরলেও ফুলবাড়ী থেকে কয়লা পাওয়া যাবে ৮৫ মিলিয়ন টন। ২০ বছরে খরচ করলে প্রতি বছর খরচ করা যাবে ৪.২ মিলিয়ন টন, যা দিয়ে ১৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানো যাবে। অন্য কয়লাখনি থেকে একই পদ্ধতিতে আরও ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে। সাগরের তেল-গ্যাস দিয়ে যে সম্ভাবনা আছে তাও বিরাট। ২০ বছরের মধ্যে নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার হতে পারে যাতে আমাদের বাকি না তোলা অংশ পুরো তুলতে পারব। অথচ উন্মুক্ত পদ্ধতিতে একবার বিদেশী কোম্পানি সব নিয়ে গেলে ৩০ বছর পর একটি কয়লাশূন্য খাদ বিষাক্ত পানির হ্রদ এবং সুজলা সুফলা বাংলাদেশের একটি বিরাট এলাকার ভূ-গর্ভস্থ এবং বুকের উপর প্রবাহিত পানি দূষিত হবার দৃশ্য ছাড়া আর কিছুই দেখব না।

ড. আবদুল মতিন পাটোয়ারীর পরীক্ষামূলক কয়লাখনি খনন প্রস্তাব সম্বন্ধে কিছু বলা যাক। ড. আবদুল মতিন পাটোয়ারীর কয়লানীতির উপর সর্বশেষ পর্যালোচনা রিপোর্টে সুপারিশ করা হয়েছে উন্মুক্ত খনন full scale -এ শুরু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে বড়পুকুরিয়াতে একটি পরীক্ষামূলক ক্ষুদ্র আয়তনের কয়লাখনি খনন করতে। ড. পাটোয়ারীর রিপোর্ট সাধারণভাবে জনগণের স্বার্থের অনুকূলে। কিন্তু পরীক্ষামূলক কয়লাখনির সুপারিশ একেবারেই অকার্যকর ও অপ্রয়োজনীয়। কারণ এই যে, উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি নতুন নয়, বহু দেশে চালু আছে। কী পরিবেশে এটি সুবিধাজনক এবং কী পরিবেশে এটি ধ্বংসাত্মক হতে পারে তা অভিজ্ঞতার আলোকে সহজে নির্ণয় করা যায়।

তাছাড়া সুবিধা অসুবিধা বের করা যায়। বিষে মৃত্যু আনে কী না তা দেখার জন্য গলাধঃকরণ করার প্রয়োজন হয় না। ড. পাটোয়ারীর প্রস্তাবিত পরীক্ষা কোন নির্দিষ্ট ফল দিবে না। তার কারণ গভীরতার সমস্যা সরল অনুপাতে হ্রাস বৃদ্ধি হয় না। আবার মডেলের জন্য ক্ষুদ্র এলাকা ধরে ২৪০ বা ৩০০ মিটার গভীরতার খনি খনন করা সম্ভব নয়। আবার যদি সম্ভব হয়ও উন্মুক্ত খননের যে সমস্ত ক্ষতির কথা বিরাট এলাকা মরুকরণ ভূ-গর্ভস্থ জলাধার ও চারদিকে জমির বুকের উপর নদী-নালা, খাল-বিলের প্রবাহ দূষিত হবার সমস্যা সরল আনুপাতিকভাবে হবে না। তবে এটা ঠিক যে, ধ্বংসের লীলা প্রত্যক্ষ করা যাবে ফলে full scale -এ উন্মুক্ত খনন এর পরিকল্পনা অবশেষে পরিত্যক্ত হবে, যদিও সর্বনাশের অনেকাংশ পরীক্ষাকালীন সময়েই ঘটে যাবে। সেহেতু পাটোয়ারী সাহেবের সুপারিশ অনুসারে সরকারি অর্থেই পরীক্ষা কাজ করতে হবে, তাতে উপরোক্ত সর্বনাশের সঙ্গে ট্যাক্স দানকারী জনগণের অর্থনাশও যোগ হয়ে যাবে।

পাটোয়ারী সাহেব যদি বলতেন পৃথিবীতে যত উন্মুক্ত খনি আছে তার উপাত্ত নেয়া হোক। সেখানে সফলভাবে এ পদ্ধতি প্রযোজ্য হয়েছে তাদের পরিবেশের সঙ্গে আমাদের পরিবেশের পার্থক্য বা মিল খোঁজা হোক। অংক করে উন্মুক্ত খনির প্রযোজ্যতা পরীক্ষা করা হোক। সেটাই সঠিক হত। পরীক্ষামূলক উন্মুক্ত খনির প্রস্তাব অকার্যকর অর্থ ও সময় অপচয়কারী। ফলে পরিত্যাজ্য।

অতীতে বিভিন্ন জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি ও তৎপরতার সাথে যুক্ত ড. তৌফিক-ই-চৌধুরী এখন জ্বালানী উপদেষ্টা। আমাদের জানামতে তাঁর অতীতের ভূমিকার কোন পরিবর্তন হয় নাই। এখনও তিনি প্রকৃতপক্ষে জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলী দিয়ে বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থ রক্ষায় উঠে পড়ে লেগেছেন। সমুদ্রের গ্যাস ব্লকগুলো রপ্তানিমুখি চুক্তির মাধ্যমে কনোকো ফিলিপস ও টাল্লোর হাতে তুলে দেবার ফাইলপত্র তৈরি করেছেন, এশিয়া এনার্জির সঙ্গে উন্মুক্ত খনন পদ্ধতির চুক্তি সম্পাদনের জন্য জোরদার চেষ্টা চালাচ্ছেন। স্থানীয় সংসদ সদস্য উন্মুক্ত খননের দরুন উচ্ছেদের শিকার গ্রামবাসীদের বাজারের তুলনায় কয়েকগুণ ক্ষতিপূরণ দানের ঘোষণা দিয়ে পক্ষে আনার চেষ্টা করছেন।

জ্বালানী মন্ত্রণালয়কে দুষ্টগ্রহ থেকে মুক্ত করতে না পারলে আমাদের বিদ্যুৎ সংকট কাটবে না, আর আমাদের খনিজ সম্পদ ও জ্বালানী নিরাপত্তা তথা জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের সম্ভাবনা সবই বিপর্যয়ে পতিত হবে। অবিলম্বে তাই ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীসহ বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থ রক্ষাকারীদের জ্বালানী মন্ত্রণালয় থেকে অপসারণ করে জাতীয় স্বার্থ বিরোধী তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত থাকার দায়ে বিচারের সম্মুখিন করতে হবে। শেখ হাসিনা জনগণের মঙ্গল চাইলে এবং তাঁর দিনবদলের প্রতিশ্র“তিতে আন্তরিক হলে এ ব্যাপারে তিনি আর গড়িমসি করবেন না। প্রধানমন্ত্রীর জনস্বার্থ সেবায় আন্তরিকতার পরীক্ষাও হবে এর মাধ্যমেই। বাংলাদেশের জনগণ নিজের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় যে কোন আন্দোলন এগিয়ে নিতে বিন্দুমাত্র পিছপা হবেন না।

[২১ এপ্রিল ২০০৯, প্রেসক্লাবে তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি কর্তৃক আয়োজিত আলোচনা সভায় কমিটির আহ্বায়ক প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ কর্তৃক লিখিত এবং পঠিত বক্তব্যের একাংশ]