![](https://ncbd.org/wp-content/themes/ncbd_tapon/images/corner-cap.png)
Wednesday, August 17th, 2016
রামপাল প্রকল্প: ১০টি প্রশ্ন ও বিভ্রান্তিকর উত্তর
রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে আরশাদ মনসুরের তোলা ১০টি প্রশ্নের যে উত্তর প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান পাঠিয়েছে, তা ৬ আগস্ট প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়েছে। প্রশ্ন-উত্তর পর্বে আলোচিত এই প্রযুক্তিগুলো কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হবে কি না, কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হলেই সুন্দরবনের ওপর রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পূর্ণ দূর হবে কি না, কিংবা এই প্রযুক্তিগুলোর কোনো সীমাবদ্ধতা বা ক্ষতিকর প্রভাব আছে কি না—এসব বিষয়ে কিছু কথা বলা জরুরি মনে করছি।
২. এফজিডি ব্যবহার: ইআইএ রিপোর্ট অনুসারে এফজিডি বাধ্যতামূলক ছিল না, বলা হয়েছিল কয়লায় সালফারের পরিমাণ শূন্য দশমিক ৬ শতাংশের বেশি হলেই কেবল এফজিডি ব্যবহৃত হবে। সমালোচনার কারণে হয়তো এখন এফজিডি ব্যবহারের কথা বলা হচ্ছে। ব্যয়বহুল এই পদ্ধতিতে শুধু প্রতি টন সালফার ডাই-অক্সাইড শোধনে বিপুল অর্থ (২০০ থেকে ৫০০ ডলার) লাগে। আবার এফজিডি বা স্ক্র্যাবার ব্যবহারের বিপদ হলো, কয়লা ও লাইমস্টোন থেকে ‘এফজিডি ওয়েস্ট ওয়াটার’-এ চলে আসা দ্রবীভূত কঠিন পদার্থ (ক্লোরাইড, সালফেট, বাইকার্বনেট), ভাসমান কঠিন পদার্থ (জিপসাম, ফ্লাই অ্যাশ), অ্যামোনিয়া, বিষাক্ত ভারী ধাতু যেমন আর্সেনিক, মার্কারি, সেলেনিয়াম, বোরন ইত্যাদি। ব্যবহৃত কয়লা ও লাইমস্টোনের ধরন অনুযায়ী এসবের মাত্রা বিভিন্ন রকম হয় বলে এসব পরিশোধনের কোনো একক ‘ওয়ান-সাইজ-ফিট-ফর-অল’ পদ্ধতি নেই, এগুলো পরিশোধন করাও দুরূহ ও ব্যয়সাপেক্ষ। (সূত্র: http://www.powermag.com/flue-gas-desulfurization-wastewater-treatment-primer/?pagenum=2>)
নিউইয়র্ক টাইমস–এর Cleansing the Air at the Expense of Waterways শীর্ষক রিপোর্ট অনুসারে (লিংক: http://www.nytimes.com/2009/10/13/us/13water.html?_r=0) বায়ু দূষণমুক্ত করার জন্য স্ক্র্যাবার ব্যবহার করা হবে জেনে ২০০৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার হ্যাটফিল্ডস ফেরি (Hatfield’s Ferry) কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের দূষণের ভুক্তভোগীরা খুশিই হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা দেখলেন, স্ক্র্যাবার ব্যবহার করার ফলে বাতাস কিছুটা দূষণমুক্ত হচ্ছে, কিন্তু তার বদলে দূষিত হচ্ছে পানি! এ প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট বিপুল পরিমাণ তরল বর্জ্য ফেলা হচ্ছে পার্শ্ববর্তী মননগাহেলা (Monongahela) নদীতে, যে নদী ৩ লাখ ৫০ হাজার মানুষের খাওয়ার পানির জোগান দেয়। তাই তো কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ১৫ মাইল বা ২৪ কিলোমিটার দূরে বসবাসকারী ফিলিপ কোলম্যানের উপলব্ধি, ‘মনে হচ্ছে তারা আমাদের নিশ্বাসের মাধ্যমে বিষ গ্রহণ থেকে মুক্তি দিয়েছে, বিনিময়ে আমাদের সেই বিষ পানির সঙ্গে পান করতে হচ্ছে।’ (সুন্দরবনের দূরত্ব কিন্তু ১৪ কিলোমিটার এবং পশুর নদ ঠিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশ দিয়ে গেছে!)
৩. পার্টিকুলেট ম্যাটার্সের মাত্রা: ইএসপি ব্যবহার করে বাতাসে ক্ষুদ্র কণা নিঃসরণের হার কমানোর কথা বলা হলেও ইএসপির আওতার বাইরে থাকা দূষণের উৎস যেমন নির্মাণকাজ, কয়লা পরিবহন, ছাই ব্যবস্থাপনা ইত্যাদির মাধ্যমে সুন্দরবনের বিভিন্ন অংশে পার্টিকুলেট ম্যাটার্সের মোট মাত্রা কত হবে এবং তা কীভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে, তার কোনো হিসাব করা হয়নি।
৪. পারদ দূরীকরণ: কী পরিমাণ পারদ নিঃসরণ হবে এবং তার কত অংশ দূরীকরণ সম্ভব হবে, তার কোনো হিসাব করা হয়নি। ইএসপি ও এফজিডির মাধ্যমে সম্পূর্ণ পারদ দূর করা যায় না—গড়ে ৪৮ শতাংশ, সর্বোচ্চ ৬৯ শতাংশ পারদ দূর করা যায়। (সূত্র: https://netl.doe.gov/File%20Library/Research/ Coal/ewr/mercury_-FGD-white-paper-Final.pdf) সেই সঙ্গে এফজিডি ওয়েস্ট ওয়াটারে পারদের পরিমাণ বৃদ্ধির বিপদ তো আছেই।
৫. পানি পরিশোধন: ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের মাধ্যমে দূষিত পানি পরিশোধন করে নদীতে নির্গমনের কথা বলা হলেও কার্যকারিতা নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে। পরিশোধনের বেলায় শুধু পিএইচ নিয়ন্ত্রণ করলেই হয় না, দূষিত পানিতে বিওডি, টিডিএস, টিএসসহ বিভিন্ন বিষাক্ত ভারী ধাতু নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়োজন হয়, যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঠিকঠাক করা হয় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৭২টি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৮৮টি থেকে নদীতে পানি নির্গমনের বেলায় আর্সেনিক, বোরন, কেডমিয়াম, সিসা, পারদ ও সেলিনিয়ামের কোনো সীমা বা মাত্রা মেনে চলা হয় না। (সূত্র: https://netl.doe.gov/File%20Library/Research/Coal/ewr/mercury_-FGD-white-paper-Final.pdf) নিউইয়র্ক টাইমস–এর রিপোর্ট থেকেও দেখা যাচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামা, কেনটাকি, নর্থ ক্যারোলাইনা, ওহাইওসহ ১০টি রাজ্যের ২১টি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নদী ও জলাভূমিতে ফেডারেল ড্রিংকিং স্ট্যান্ডার্ডের চেয়ে ১৮ গুণ বেশি আর্সেনিকসম্পন্ন পানি নির্গত করেছে। আর ঢাকার নদীগুলোতে প্রতিদিন ৯০ হাজার ঘনমিটার তরল বর্জ্য কোনো ধরনের পরিশোধন ছাড়াই ডিসচার্জ করা হয়। ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট থাকলেও সেগুলো ব্যবহার করা হয় না। কারণ, প্রতি ঘনমিটার তরল বর্জ্য পরিশোধন করতে ৩০ টাকা করে লাগে! (সূত্র: বণিক বার্তা, ২ এপ্রিল, ২০১৬) এ রকম একটা অবস্থায় কীভাবে ভরসা রাখা যেতে পারে যে ঢাকা থেকে বহু দূরে সুন্দরবনের প্রান্তে ঠিকঠাকমতো পানি পরিশোধন করে নদীতে ফেলা হবে!
৬. ছাই ব্যবস্থাপনা: সরকার একদিকে বলছে, সিমেন্ট কোম্পানিগুলোর কাছে ফ্লাই অ্যাশ বিক্রি করা হবে, অন্যদিকে সিমেন্ট কোম্পানিগুলো বিজ্ঞাপন দিয়ে ফ্লাই অ্যাশমুক্ত সিমেন্টের প্রচার করছে। এই অবস্থায় শুধু রামপাল নয়, আরও যেসব বৃহৎ কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিকল্পনা করা হয়েছে, সেগুলো থেকে উৎপন্ন বিপুল পরিমাণ ছাই যথাযথ সময়ে বিক্রয় হওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে। বড়পুকুরিয়া কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ছাইয়ের ক্রেতা খুঁজে পেতে নয় বছর লেগেছে, তত দিনে চারপাশের পরিবেশ ছাইদূষণের শিকার হয়েছে।
৭. অনলাইন মনিটরিং: অনলাইন মনিটরিং-ব্যবস্থায় শুধু বায়ুদূষণ মনিটরিং করা হয়। কিন্তু চিহ্নিত দূষণ দূরীকরণ কি হবে?
প্রি–কনস্ট্রাকশন ফেইজে জমি তৈরি, মাটি ভরাট, ড্রেজিং ইত্যাদির মাধ্যমে যতটুকু দূষণ হয়েছে, তা চিহ্নিত করে রিপোর্ট দিয়েছিল মনিটর প্রতিষ্ঠান সিইজিআইএস। নভেম্বর ২০১৪ সালে তৃতীয় মনিটরিং রিপোর্টে ধুলো নিয়ন্ত্রণ, ড্রেজার থেকে শব্দদূষণ ও কালো ধোঁয়া নির্গমনের সমস্যা সমাধানের কথা বলা হলেও ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সালের অষ্টম মনিটরিং রিপোর্টেও দেখা যাচ্ছে, সেগুলোর সমাধান হয়নি।
৮. নির্গত পানির তাপমাত্রা: এত দিন বলা হতো, নির্গত পানির তাপমাত্রা নাকি একেবারেই স্বাভাবিক থাকবে! প্রশ্ন-উত্তরে স্বীকার করা হয়েছে, পানির তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বাড়বে। পানির তাপমাত্রা আসলে কত বাড়বে, সেটা একটা প্রশ্ন। কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে নির্গত পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিষয়ে জাইকার একটি রিপোর্টে থার্মাল ইফ্লুয়েন্ট নির্গমনের ফলে পানির তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত বৃদ্ধি এবং এর ফলে মাছের ক্ষতি হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সূত্র: <http://open_jicareport.jica.go.jp/pdf/12233847.pdf>
৯. কয়লা আনা-নেওয়ার প্রভাব: স্রেফ প্রযুক্তি ব্যবহার করে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে কয়লা পরিবহনের দূষণ ও ঝুঁকি সম্পূর্ণ দূর করা যাবে না। যেমন ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের পাশ দিয়ে চলা কয়লা পরিবহনকারী জাহাজ থেকে কয়লা, তেল, আবর্জনা, দূষিত পানি নিঃসরণ ও শব্দদূষণ, সুন্দরবনের ভেতরে বড় জাহাজ থেকে ছোট জাহাজে কয়লা ওঠানো-নামানোর সময় পানি/বায়ু/শব্দদূষণ, রাতে জাহাজ চলাচলের সময় জাহাজের সার্চ লাইটের আলোয় নিশাচর প্রাণীর ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ইত্যাদি। তা ছাড়া জাহাজের ড্রাফট মেইনটেইন করার জন্য নিয়মিত নদী ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন হবে, সেই ড্রেজিংয়ের ফলেও নদীদূষণ ঘটবে।
১০. পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন: পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়নের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হয়েছে। কিন্তু সে মূল্যায়ন প্রত্যাখ্যাত হলেও আমলে নেওয়া হয়নি। আসলে আগে চুক্তি ও স্থান চূড়ান্ত করে পরে ইআইএ কিংবা গণশুনানি করার অর্থ থাকে না।
প্রকৃতপক্ষে, প্রযুক্তি ব্যবহার করে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কিছু কিছু দূষণ আংশিক কমানো গেলেও অনেক দূষণ আবার কমানো যায় না। বায়ুদূষণ কমাতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে পানিদূষণ বেড়ে যায়। এ কারণেই সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মতো স্পর্শকাতর অঞ্চলের ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন না করার কথা বলা হয়েছে ভারতের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ইআইএ গাইডলাইন, ২০১০-এ। আমরা আশা করব, সুন্দরবনের গুরুত্ব বিবেচনা করে সরকার রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র অন্যত্র স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত নেবে।
[লেখাটি প্রথম আলো’তে ১৬ আগস্ট ২০১৬ তারিখে প্রকাশিত]