?> জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের রামপাল সফরের আমন্ত্রণের জবাব « NCBD – National Committee of Bangladesh

Thursday, November 12th, 2015

জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের রামপাল সফরের আমন্ত্রণের জবাব

বরাবর
জনাব নসরুল হামিদ এমপি
প্রতিমন্ত্রী মহোদয়
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।

জনাব, আমরা গত ২৮ অক্টোবর ২০১৫ তারিখে স্বাক্ষরিত (২ ও ৮ নভেম্বর প্রাপ্ত) আপনার পত্রে আগামী ১৯ নভেম্বর আপনার সাথে রামপাল এলাকা পরিদর্শনের আমন্ত্রণ পেয়েছি। এই আমন্ত্রণের জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ জানাই। আমন্ত্রণপত্রে উক্ত পরিদর্শন কার্যক্রমের উদ্দেশ্য আপনি বলেছেন- ‘রামপাল, সুন্দরবন, পশুর নদী এবং এর আশপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র সম্পর্কে ধারণা লাভ এবং প্রকল্প সম্পর্কে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ ও প্রকল্প সম্পর্কে ইতিবাচক চিন্তা-ভাবনা বিনিময়। ’এই বিষয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত জানাবার আগে আপনার অবগতির জন্য কয়েকটি তথ্য জানানো দরকার মনে করি।

২০১০ সালে প্রথম আমরা এই ভয়াবহ প্রকল্প সম্পর্কে জানতে পারি। আইন অনুযায়ী পরিবেশ সমীক্ষা সম্পন্ন হবার কথা থাকলেও তার বেশ আগেই সেখানে জমি অধিগ্রহণ শুরু হয়। এলাকার মানুষদের ভয়ভীতি দেখিয়ে জমি থেকে সরে যেতে বলা হচ্ছিলো। আমরা তখনই প্রথম ঐ এলাকা পরিদর্শন করি। প্রকল্প সম্পর্কে জানবার জন্য মন্ত্রণালয়ে এবং সুন্দরবনের ওপর তার প্রভাব সম্পর্কে জানবার জন্য বিশেষজ্ঞদের সাথে আমরা যোগাযোগ করি। তারপর থেকে বহুবার আমরা রামপাল এলাকায় গেছি। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার পুলিশ কিংবা সরকারি দলের সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হই। প্রথম থেকেই স্পষ্ট ছিলো যে, এই প্রকল্প অনিয়ম ও অস্বচ্ছতায় ভরা। চুক্তিও জাতীয় স্বার্থবিরোধী। সেকারণে সরকারের মধ্যে এই বিষয়ে একটা ভীতি আছে। সেকারণে আমাদের সফরে সবসময়ই বিঘœ সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছে।

গত ১২ এপ্রিল ২০১৩ তারিখে আপনার মন্ত্রণালয় কর্তৃক আমন্ত্রিত হয়ে রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব নিরুপন বা ইআইএ সম্পর্কে গণশুনানি বা পিপলস কনসালটেশনে অন্য বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবাদীদের সাথে জাতীয় কমিটির প্রতিনিধিদলও গিয়েছিলেন। এছাড়া লিখিতভাবেও আমরা পরিবেশ সমীক্ষাটির বিষয়ে মতামত প্রদান করেছিলাম। প্রকল্পের ব্যাপারে মূল আপত্তির মধ্যে সুন্দরবন থেকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিপজ্জনক দূরত্ব, ক্ষতিকর সালফার ও নাইট্রোজেন গ্যাসের অনিরাপদ মাত্রা, ছাইদূষণ, কয়লা পরিবহনের সময়কার শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, কয়লার কার্গো দুর্ঘটনার ঝুঁকি কিংবা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্গত পানির মাধ্যমে পশুর নদীর পানি দূষণ ইত্যাদি বিষয়গুলো ছিলো। সরকারি প্রতিনিধি বাদে উপস্থিত সকল বিশেষজ্ঞই ইআইএ প্রত্যাখ্যান করেন এবং রামপাল কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র বাতিল করার আহবান জানান।

অথচ বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম, এর এক সপ্তাহের মাথায় ভারতের এনটিপিসি-র সাথে চুক্তি সম্পাদন করা হয়। এই ঘটনায় স্পষ্ট হয় যে, ঐ কনসালটেশন বা স্বাধীন মতামত অনুষ্ঠান ছিলো একেবারেই লোকদেখানো, প্রতারণামূলক। পরবর্তীতে যে সংশোধিত ইআইএ রিপোর্ট প্রকাশ করা হয় সেটিও প্রথমটির মতোই ত্রুটিপূর্ণ ছিল। সুন্দরবনের পাশে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের মূল পরিকল্পনা অক্ষুন্ন রেখেই, সমালোচনার কারণে কিছু কিছু বিষয় ঘুরিয়ে লিখে এবং নতুন কিছু ফাঁপা আশ্বাস যুক্ত করে, তৈরী করা হয় সংশোধিত ইআইএ রিপোর্ট। মূল ইআইএ রিপোর্টের মতোই সংশোধিত ইআইএ রিপোর্টেও যে কোন মূল্যে সুন্দরবনের পাশে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করার জন্য ভুল মানদন্ড ব্যবহার, ক্ষতিকর প্রভাব কমিয়ে দেখানো, কোন কোন ক্ষেত্রে ক্ষতির মাত্রার কোন পর্যালোচনা না করা, ক্ষতির মাত্রাকে হালকা ভাবে উপস্থাপন, ফাঁপা আশ্বাস প্রদান ইত্যাদি প্রবণতা স্পষ্ট।

গত ১ নভেম্বর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দিয়ে আমাদের ‘সুচিন্তিত মতামত’কে ‘গুরুত্বের সাথে বিবেচনা’র কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সরকারের কার্যক্রমে বরাবরই সকল ‘সুচিন্তিত মতামত’ উপেক্ষা করবার ঘটনা দেখা গেছে। যে কারণে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রভাব সম্পর্কে ভয়াবহ তথ্য বিশ্লেষণ জানাবার পরও ওরিয়ন-এর আরেকটি বিদ্যুৎ প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়েছে; মন্ত্রীসভা রামপালে দ্বিতীয় আরেকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে; সুন্দরবনের ভেতরে বারবার তেল, কয়লা, সিমেন্ট, সার বোঝাই জাহাজ বারবার ডুবি সত্ত্বেও এর প্রতিরোধ ও ক্ষয়ক্ষতি নিরসনে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, এলাকায় ভূমি ও বনগ্রাসী বিভিন্ন প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে আশংকা হচ্ছে, যে সুন্দরবন বিশ্বের সম্পদ, যা দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের কয়েক কোটি মানুষের জীবনরক্ষার প্রাকৃতিক প্রাচীর, লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকার অবলম্বন, জীববৈচিত্রে অনন্য সেই সুন্দরবনের বিপর্যয় ও বিনাশ নিয়ে সরকারের কোনো মাথাব্যথাই নেই।

সেজন্যই কোম্পানি ও সরকারের পক্ষ থেকে ক্রমান্বয় ভুল তথ্য ও মিথ্যাচারের মধ্য দিয়ে এই প্রকল্পকে বৈধতা দেবার চেষ্টা দেখছি। কোম্পানি থেকে পত্রিকায় বিবৃতি দেয়া হয়েছে। গত ২ নভেম্বর ডেইলিস্টারে বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে বিজ্ঞাপন দিয়ে সুন্দরবনধ্বংসী রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বিরোধীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, “এ প্রকল্প নিয়ে একটি মহল ও কতিপয় ব্যক্তি বা সংগঠন বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রচার ও কর্মকান্ড পরিচালনা করছে যা অমূলক, ভিত্তিহীন ও দেশের স্বার্থ বিরোধী।” এই ধরনের বক্তব্য নিশ্চয়ই ‘সুচিন্তিত মতামত’কে ‘গুরুত্বের সাথে বিবেচনা’র লক্ষণ নয়।

গত কয়বছরে রামপাল, সুন্দরবন, পশুর নদী এবং এর আশপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র সম্পর্কে আমরা নিজেরা বহুভাবে তথ্যসংগ্রহ এবং বিশ্লেষণ করেছি। প্রত্যক্ষ সফর, বিশেষজ্ঞদের দীর্ঘ গবেষণা এবং সেইসাথে বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনার মাধ্যমে আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে, কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র সুন্দরবনের ওপর সর্বনাশা ক্ষতিকর প্রভাব রাখবে। আপনাদের অনুমোদিত ইআইএ রিপোর্ট অনুসারে, রামপালে নির্মিতব্য কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৪ কিমি দূরে অবস্থিত। কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র মারাত্মক পরিবেশ দূষণকারী বলে বিশ্বের বহু দেশে কোন সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও জনবসতির ১৫-২০ কিমি এর মধ্যে এ ধরনের বড় আকারের কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয় না। যে ভারতীয় এনটিপিসি বাংলাদেশে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে চাচ্ছে, সেই ভারতেরই পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ইআইএ গাইড লাইন, ২০১০ লংঘন করে ভারতের কোম্পানি এই কাজে যুক্ত হয়েছে।

আপনার আমন্ত্রণের সূত্রে বলতে চাই, সুন্দরবন রক্ষা ও দেশের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য যৌথসফর সহ সরকারকে সবরকম সহযোগিতা করতে আমরা সবসময়ই সম্মত আছি। তবে সরকার সমাজে সংলাপে সহযোগিতায় যে আসলেই আগ্রহী তার লক্ষণ থাকা দরকার। সেজন্য সরকারকেই কতিপয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সুন্দরবনের বিষয়ে এগুলোর মধ্যে প্রধান হলো: (১) দেশ ও বিদেশের বিশেষজ্ঞ, ইউনেস্কোসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও পরিবেশবাদীদের অকাট্য দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সুন্দরবন বিনাশী রামপাল ও ওরিয়ন বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থগিত করা। সুন্দরবনের জন্য ক্ষতিকর সকল তৎপরতা বন্ধ করা। এবং (২) মিথ্যা প্রচার ভুল তথ্য এবং সুন্দরবন রক্ষার দাবিতে আন্দোলনকারিদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা ও দমনপীড়ন বন্ধ করা। এসব ব্যবস্থা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ঘোষণায় আপনাদের সদিচ্ছা প্রকাশিত হবে, তখন আমরা সানন্দে আপনার প্রস্তাবিত যৌথ সফরে অংশগ্রহণ করতে পারবো বলে আশা রাখি।

কেনো সুন্দরবনের পাশে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র সুন্দরবনের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর সে বিষয়ে আমরা বহুবার বিস্তারিত মতামত রেখেছি। নীচে আপনাদের প্রচারিত বিজ্ঞাপনে প্রদত্ত তথ্যের জবাবও আমরা সংযুক্ত করছি। জনগণের অর্থ অপচয় করে এধরনের ভুল তথ্য প্রচার আর না করতে আবারও অনুরোধ জানাচ্ছি। আমরা একইসঙ্গে, গণমাধ্যমের উপস্থিতিতে, সুন্দরবনের ওপর রামপাল ও ওরিয়ন কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সম্ভাব্য ক্ষতিকর দিক নিয়ে আলোচনা বা সংলাপের জন্য আপনাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আপনি সম্মত থাকলে এজন্য যথাযথ স্থান ও সময় নির্ধারণ করা সম্ভব হবে।

আমরা বারবার বলি, আবারও বলছি, বিদ্যুৎ উৎপাদনের বহু বিকল্প রয়েছে কিন্তু সুন্দরবনের কোন বিকল্প নেই। আশা করি, বর্তমান সরকার বাংলাদেশের অস্তিত্বের জন্য সুন্দরবনের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে সুন্দরবনের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর মৈত্রী সুপার থারমাল পাওয়ার প্রকল্প ও ওরিয়নের কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র বাতিল করে যথাযথ পরিবেশগত সমীক্ষার মাধ্যমে ও স্বচ্ছতার সঙ্গে তা অন্যত্র স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। একইসঙ্গে সুন্দরবন নীতিমালা গ্রহণ করে সুন্দরবনবিনাশী সবধরনের তৎপরতা বন্ধে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।

ধন্যবাদসহ,
শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, আহবায়ক
আনু মুহাম্মদ, সদস্য সচিব