Wednesday, August 27th, 2014
সাবধান! উন্মুক্ত খনির প্রস্তুতি চলছে!
কয়লা উত্তোলনে উন্মুক্ত খনি না করার অঙ্গীকার থাকলেও গোপনে উন্মুক্ত খননের সব প্রস্তুতি চলছে। দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ীতে ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট উন্মুক্ত খনির বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান ঘটেছিল। বিএনপির নেতৃত্বাধীন তৎকালীন জোট সরকার সেই অভ্যুত্থান দমন করতে গিয়ে তিনজনকে হত্যা করে। ব্যাপক দমন নিপীড়ন চালিয়েও অবশেষে আন্দোলনের মুখে জোট সরকার পিছু হটতে বাধ্য হয়। সম্পন্ন হয় ঐতিহাসিক ফুলবাড়ী চুক্তি। কয়লা উত্তোলনে দেশের কোথাও উন্মুক্ত খনি না করার একটি ধারা রয়েছে ওই চুক্তিতে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তখন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় গিয়ে এই চুক্তি বাস্তবায়ন করবেন। কিন্তু সেই চুক্তি আজও উপেক্ষিত। অঙ্গীকার ভুলে গেছে সরকার। উন্মুক্ত খনির বিরুদ্ধে জনমত তীব্র হওয়ায় সরকার গোপনেই চালিয়ে যাচ্ছে উন্মুক্ত খননের প্রস্তুতি।
উন্মুক্ত খননের জন্য সরকার কৌশলী পথ বেছে নিয়েছে। অগ্নিগর্ভ ফুলবাড়ীকে পাশ কাটিয়ে টার্গেট করা হয়েছে পার্শ্বস্থ বড়পুকুরিয়াকে। যেকোনো একটি খনিতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খনন শুরু করে দিতে পারলে উন্মুক্ত পদ্ধতির পক্ষে একটি বৈধতা প্রতিষ্ঠিত হবে। এর পরে বাকি খনিগুলো সহজেই উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খনন করা যাবে। এরকম একটি বিশ্বাস থেকে সরকার এখন বড়পুকুরিয়াকে কেন্দ্র করেই সব পরিকল্পনা সাজাচ্ছে। এর পাশাপাশি ফুলবাড়ী নিয়েও অব্যাহত আছে প্রচার প্রচারণা। বড়পুকুরিয়ায় উন্মুক্ত খনি করা গেলে ফুলবাড়ীতে তাদের কপাল খুলবে এই আশাই করছে এশিয়া এনার্জি। তাই বড়পুকুরিয়া এলাকায় ও জাতীয় পরিসরে নানা পদ্ধতিতে তারা উন্মুক্ত খনির পক্ষে জনমত তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে তারা অর্থের বিনিময়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় কিছু বুদ্ধিজীবীকে ব্যবহার করছে। সরকার তার কাজ দিয়েই প্রমাণ করেছে যে, তারা এশিয়া এনার্জির পক্ষে আছে।
সরকার যা করছে
কয়লা উত্তোলন বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ একটা জায়গা দখল করেছে। গত মেয়াদে ক্ষমতায় আসার আগে আওয়ামী লীগ তাদের দিন বদলের ইস্তেহারেও কয়লা উত্তোলন করে দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু কয়লা উত্তোলনের পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক চলে আসছিল অনেক আগে থেকেই। দেখা গেছে, সরকার ও তার সংশ্লিষ্ট বুদ্ধিজীবী এবং বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানির কনসালটেন্সির সঙ্গে যুক্ত বিশেষজ্ঞরা নানা সময় উন্মুক্ত খনির পক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন। এর মূল কারণটা হচ্ছে, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে গেলে অন্য পদ্ধতির চেয়ে তুলনামূলক বেশি কয়লা তোলা যায় এবং এ পদ্ধতিটি সরল। কয়লা উত্তোলনে যে বিদেশি কোম্পানিগুলো আগ্রহী, উন্মুক্ত পদ্ধতি হলেই তাদের ঝামেলা কম ও লাভ বেশি। অন্যদিকে একদল বিশেষজ্ঞ বলছেন, দৃশ্যমান এ লাভের বেশিরভাগই যাবে বিদেশি কোম্পানির পকেটে। আর আমাদের জন্য রয়ে যাবে দীর্ঘমেয়াদি ভোগান্তি ও ক্ষয়ক্ষতি। ধ্বংস হবে কৃষিজমি ও ভূগর্ভস্থ মিষ্টি পানির আধার। ক্ষয়ক্ষতি হবে আরও অসংখ্য ধরনের।
এই বিবাদে সরকারপক্ষ সব সময়ই উন্মুক্ত খননের পক্ষে অটল ছিল। সরকারের গত মেয়াদে এ নিয়ে অনেক কিছু ঘটে। তখন বড়পুকুরিয়ায় উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খননের সম্ভাবনার কথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই প্রথম জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন। ১১ এপ্রিল, ২০১০ ‘ডেইলি স্টারে’ প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়। জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী ওই বছরের ২৯ মে বলেন, বড়পুকুরিয়ায় পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে উন্মুক্ত খনি করার প্রস্তাব করা হচ্ছে। এই আয়োজনের অংশ হিসেবে জনসচেতনতা সৃষ্টি, খনি অঞ্চলের বাসিন্দাদের বিকল্প জীবন ও জীবিকার ব্যবস্থা, আর্থিক ও কারিগরি সংশ্লিষ্টতা, উত্তোলিত কয়লার ব্যবহার প্রভৃতি বিষয়ে ব্যাপক প্রচারণা শুরু করা হয়। এরপর জ্বালানিবিষয়ক সংসদীয় কমিটির প্রধান সুবিদ আলী ভূঁইয়ার নেতৃত্বে একটি দল জার্মানির কোলনের উন্মুক্ত কয়লাখনি পরিদর্শন করে। তারা ফিরে এসে বলেন, কোলনের মাটি, কয়লার ধরন ও ভূগর্ভস্থ জলের সঙ্গে ফুলবাড়ী ও বড়পুকুরিয়ার মিল আছে, তাই এখানেও উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খনন করা যাবে। এসব থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, সরকার উন্মুক্ত খননের পথেই যেতে চাইছে। কিন্তু এর বিপরীতে চলমান থাকে গণআন্দোলন। সরকারের নিয়োজিত বিশেষজ্ঞরাও অনেক প্রতিবেদনে উন্মুক্ত খনন প্রশ্নে আশঙ্কা ব্যক্ত করেন। এর মধ্যেই নির্বাচন এগিয়ে আসতে থাকে।
একপর্যায়ে গত মেয়াদের মাঝামাঝি দিকে সরকার কয়লা উত্তোলন থেকে পিছু হটে। ১৫ জানুয়ারি, ২০১২ আইইবি প্রাঙ্গণে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেন, ‘কয়লা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মজুদ থাকুক। ভবিষ্যতে হয়ত এমন প্রযুক্তি আসবে, যখন কয়লা উত্তোলন না করেই সেখান থেকে শক্তি ব্যবহার করা যাবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে কয়লা আমদানি করা যায়। বিদেশ থেকে কয়লা আমদানি করে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে।’ প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণা তখন আন্দোলনরত জনগণ, সংগঠন, বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদদের আশ্বস্ত করে। জনস্বার্থ হানিকর উন্মুক্ত খনন পদ্ধতির দিকে না যাওয়ার প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণায় তারা সাধুবাদ জানান।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণার পরেও এর মধ্যে এই প্রতিশ্রুতির বিপরীত কিছু ঘটনা ঘটেছে। সরকারের অনেকে উন্মুক্ত খননের সপক্ষে বক্তব্য রেখেছেন। ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত খনি করতে চাওয়া জনতা কর্তৃক বহিষ্কৃত বিদেশি কোম্পানি এমিয়া এনার্জির পক্ষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করে পুলিশ নামিয়েছে। এশিয়া এনার্জির সঙ্গে সরকার সম্পর্ক ছিন্ন করেনি। তারা এখনও নিজেদের ফুলবাড়ীর কয়লা খনির মালিক ঘোষণা দিয়ে এই খনি নিয়ে লন্ডনের শেয়ারবাজারে ব্যবসা করছে। এসব ক্ষেত্রে সরকারের কোনো নড়াচড়া দেখা যায়নি। যার ফলে সংশয় জেগেছে, প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণা শুধু ‘ভালো ভালো কথা’, কাজের কথা নয়।
যদিও প্রধানমন্ত্রী দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসেও আগের অবস্থান পরিবর্তন করেননি। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে এ মেয়াদের প্রথম দিনে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে অফিস করতে গিয়ে তখনও তিনি একই প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। সেদিন ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আগে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার কথা ভাবতে হবে, কৃষিজমি রক্ষা করতে হবে। তারপর সিদ্ধান্ত নেব কয়লা উত্তোলন করব কি না? তিনি বলেন, কয়লা উত্তোলন ভবিষ্যতের ওপর ছেড়ে দিতে চাই। কয়লা উত্তোলনের জন্য নতুন প্রযুক্তির অপেক্ষায় থাকব।’
এই হচ্ছে সরকারপ্রধানের কয়লা উত্তোলন বিষয়ক ঘোষণা। খুবই পরিষ্কার কথা। কিন্তু এর মাত্র ৬ মাসের মধ্যেই পাশা উল্টে যাওয়ার দশা হলো। খাদ্যনিরাপত্তা, কৃষিজমির শঙ্কা দূর হওয়ার মতো কিছু ঘটেনি। এখনও কোনো প্রজন্মও পার হয়ে যায়নি। আধুনিক কোনো প্রযুক্তিও আসেনি। কিন্তু এর মধ্যেই উন্মুক্ত খনির লক্ষ্যে তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। অনেক দূর এগিয়েও গেছে সরকার। দিন-ক্ষণ প্রায় ঠিক করে দিয়ে ঘোষণা এসেছে জ্বালানি মন্ত্রণালয় থেকে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর তাতে বাদ সাধেনি।
গত ১০ জুলাই, ২০১৪ বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির উত্তরাংশ থেকে অক্টোবর থেকেই উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের কাজ শুরু হবে। তিনি জানান, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ইন্সটিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম) ‘হাইড্রোলজিক্যাল স্টাডি এন্ড গ্রাউন্ডওয়াটার মডেলিং ফর নর্দান পার্ট অব বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং’ শীর্ষক এক সমীক্ষা প্রকল্প চালাচ্ছে, যা শেষ হবে সেপ্টেম্বরে। সেই প্রতিবেদন হাতে এলেই কয়লা উত্তোলনের কাজ শুরু হবে। তিনি আরও জানান, বড়পুকুরিয়া থেকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে উৎপাদিত কয়লা দিয়ে সেখানে ১৩০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জমি অধিগ্রহণের পরিকল্পনাও হাতে নেয়া হয়েছে।
মন্ত্রীর এই বক্তব্য থেকে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যে, আইডব্লিউএমের প্রতিবেদনে যা-ই থাক না কেন, উন্মুক্ত খনির সিদ্ধান্ত তারা আগেই নিয়ে রেখেছেন। নইলে কীভাবে তিনি বলেন যে, ‘অক্টোবর থেকেই উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের কাজ শুরু হবে’? শুধু তা-ই নয়, প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার আগেই ‘বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জমি অধিগ্রহণের পরিকল্পনাও’ করা হয়ে গেছে। এর অর্থ দাঁড়ায়, প্রধানমন্ত্রী ফেব্রুয়ারিতে যে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন তা ছিল শুধু লোক দেখানো ঘোষণা। বিপরীতে কয়লা নিয়ে তার মূল মনোভাব কী, তা প্রমাণ হচ্ছে কাজের মধ্য দিয়ে। অক্টোবরেই উন্মুক্ত খনির কাজ শুরু করছে সরকার।
এটা কে না জানে যে, আইডব্লিউএম একটি সরকারপুষ্ট সংস্থা। বছর বছর সরকারি আনুকূল্যে সরকার প্রস্তাবিত প্রকল্পে বিনা টেন্ডারে কাজ নিয়ে তারা সমীক্ষা ও পরামর্শ দিয়ে থাকে। যে কোনো প্রকল্পে সরকারকে ইয়েস রিপোর্ট দেয়ার প্রতিষ্ঠান অনেক আছে। আর এটা তো দেখাই যাচ্ছে, রামপালের মতো এখানেও রিপোর্টের আগে সরকার জমি অধিগ্রহণের পথে হাঁটছে। এসব রিপোর্ট লোক দেখানো, এটা তারাই প্রমাণ করছেন। সরকারপুষ্ট প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ৭০০ ঘনমিটার পানি তোলার দরকার হলে তাকে ৩০০ ঘনমিটার দেখিয়ে দেয়া সম্ভব। পানি ওঠানোর সময় তো গিয়ে আর কেউ পানি মেপে দেখতে পারবে না। দেশের মানুষের টাকায় গড়ে ওঠা প্রকৌশল সামর্থ্যকে এখন দেশের বিরুদ্ধে লাগানো হচ্ছে।
জাতীয় পরিসরে প্রচারণা
উন্মুক্ত খনির সপক্ষে জোর প্রচারণা চালাচ্ছে সরকার ও এশিয়া এনার্জি। বড়পুকুরিয়ায় খননের ক্ষেত্রে তারা বলছেন, ‘পরীক্ষামূলকভাবে’, ‘একাংশে’, ‘সীমিত পরিসরে’ উন্মুক্ত খনি করা হবে। এরকম নানা প্রচারণার মাধ্যমে তারা এটা ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন যে, ছোট পরিসরে করা হচ্ছে বিধায় ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা নেই। এরপর এটা করতে পারলেই তারা ঘোষণা দিবেন যে, পরীক্ষামূলকভাবে করে দেখা গেছে সমস্যা হচ্ছে না, সুতরাং যে কোনো জায়গায় করা যাবে। উন্মুক্ত খনির বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা জনমতকে দুর্বল করতে এই কৌশল নিয়েছেন তারা।
এ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে নানা গণমাধ্যম, টিভি চ্যানেল, পত্রিকা, সাময়িকী। বেতনভুক প্রকৌশলীদের দিয়ে লেখানো হচ্ছে উন্মুক্ত খনির সপক্ষে। এসব লেখায় সঠিক তথ্যের চেয়ে বেশি থাকছে প্রোপাগান্ডা। উন্মুক্ত খনি ভালো, এটা করলে সমস্যা হবে না- এমন সব সিদ্ধান্ত প্রমাণ করার লক্ষ্যে ভুলভাল তথ্যেরও জোগান দেয়া হচ্ছে। বিজ্ঞাপনী, অনুষ্ঠান আয়োজন ও গণসংযোগ পরিচালন প্রতিষ্ঠান ‘এশিয়াটিক’ তো আগে থেকেই চুক্তিবদ্ধ হয়ে আছে এশিয়া এনার্জির সঙ্গে। তারা তাদের বিশাল প্রভাবকে কাজে লাগাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে জাতীয় পরিসরে উন্মুক্ত খনির সপক্ষে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। যেখানে উন্মুক্ত খনির বিরুদ্ধে থাকা যুক্তি, তথ্য ও তত্ত্বকে আমলে নেয়া হচ্ছে না।
স্থানীয় তৎপরতা
জাতীয় পরিসরে প্রচারণার পাশাপাশি স্থানীয়ভাবেও নানা ধরনের কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছে। ফুলবাড়ী এলাকায় এশিয়া এনার্জি দুর্নীতি ও অর্থের বিনিময়ে তার পক্ষে যে লোকবল গড়ে তুলেছিল স্থানীয় জনগণের তোপের মুখে টিকতে না পেরে তাদের ঘাঁটি হয়েছে এখন বড়পুকুরিয়া। তারা বড়পুকুরিয়ায় অর্থ, অস্ত্র ও মাদকের মাধ্যমে স্থানীয় বেকারদের একাংশকে দলে টেনেছে বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করে আসছেন। এদের মাধ্যমে উন্মুক্ত খনির বিপক্ষে থাকা সাধারণ গরিব কৃষকদের হুমকি দেয়া হয়। উন্মুক্ত খনির বিপক্ষে আন্দোলনরত তেল গ্যাসখনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সঙ্গে কোনো কর্মসূচিতে যেতে বাধা দেয়া ও ভয়-ভীতি দেখানো হয়। স্বল্পশিক্ষিত সাধারণ মানুষের মধ্যে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হয়। তাদের উন্মুক্ত খনির পক্ষে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করা হয়। মাঝে মাঝেই লিফলেট বিতরণ করা হয়।
উন্মুক্ত খননের লাভ-ক্ষতি
কয়লাখনি থেকে আহরণের জন্য দুটি প্রধান বিকল্প পদ্ধতি আছে। একটি হচ্ছে ভূগর্ভস্থ খনন পদ্ধতি। অপরটি উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি। সাধারণ প্রচারণা হচ্ছে, ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে মজুদের ১০ থেকে ৩৫ ভাগ পর্যন্ত কয়লা তোলা সম্ভব। আর উন্মুক্ত পদ্ধতিতে মজুদের ৯০ ভাগ পর্যন্ত কয়লা তোলা সম্ভব। উন্মুক্ত খননে বেশি কয়লা পাওয়া যাবে তাই এর পক্ষ নিচ্ছে সরকার। কিন্তু ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে এত কম কয়লা পাওয়ার এ তথ্যটি সঠিক নয় বলছেন বিশেষজ্ঞরা। উন্মুক্ত খনির যুক্তি জোরদার করতেই এ প্রচারণা চালানো হয় বলে তাদের দাবি।
পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত সরকারি কমিটির প্রতিবেদনেই এমনটি বলা হয়েছে। মোশাররফ কমিটির প্রতিবেদনের ৪৩ পাতায় আছে, ‘অতীতে একটা ভুল প্রচারণা চলানো হয়েছে যে ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে মাত্র ১০ শতাংশ কয়লা উত্তোলন করা যায়, বাকি ৯০ শতাংশ কয়লা তোলাই যায় না। এটা মারাত্মক ভুল বক্তব্য (দিস ইজ অ্যা গ্রস মিস-স্টেটমেন্ট)। ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে কী পরিমাণ কয়লা তোলা যাবে তা নির্ভর করে ঠিক কী উপায়ে কয়লা তোলা হচ্ছে এবং পিলারের ডিজাইন কেমন তার ওপর। রুম এন্ড পিলার পদ্ধতিতে ৫০ শতাংশ কয়লা তোলা যায় এবং মেকানাইজড লং ওয়াল মাইনিং-এর মাধ্যমে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কয়লা তোলা যায়।’
সরকারি কমিটির এ প্রতিবেদন অনুযায়ী ভূগর্ভস্থ ও উন্মুক্ত পদ্ধতির মধ্যে ২০ ভাগ কয়লা পাওয়া-না পাওয়ার তারতম্য রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ২০ ভাগ কয়লা বেশি পেতে উন্মুক্ত খনন করা হলে এর চেয়ে অনেকগুণ বেশি ক্ষতি বহন করতে হবে। উন্মুক্ত পদ্ধতি করতে গেলে খনি সংশ্লিষ্ট এলাকার কৃষিজমি চিরতরে ধ্বংস করে খনন চালাতে হবে। এতে ভূউপরিস্থ জলাশয় দূষিত হবে। ভূগর্ভস্থ প্রাকৃতিক জলাধার নষ্ট হবে। বিস্তীর্ণ এলাকা মরুকরণের শিকার হবে। কৃষি উৎপাদনশীলতা ধ্বংস হবে। লাখ লাখ মানুষ উচ্ছেদ হবে। কৃষি খাতে কর্মসংস্থান হারিয়ে নতুন কোনো কর্মসংস্থান না হওয়ায় তারা ভাসমান জনগোষ্ঠীতে পরিণত হবে। উত্তোলিত কয়লা থেকে বিষাক্ত পানি চুইয়ে দূষিত হবে পরিবেশ।
জানা গেছে, ১৯৮৭ থেকে ১৯৯১ সময়কালে যুক্তরাজ্যের খনিজ অনুসন্ধান ও কনসালট্যান্সি ফার্ম হিসেবে খ্যাত মেসার্স ওয়ার্ডেল আর্মস্ট্রং বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির ওপর আর্থ-প্রাযুক্তিক একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল। সেই সমীক্ষা শেষে তারা বড়পুকুরিয়ায় উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি কারিগরি কারণেই সম্ভব নয় বলে সিদ্ধান্ত জানিয়েছিল। তাদের হিসাব অনুযায়ী ৩০ বছরের খনি জীবনে প্রতি সেকেন্ডে সেখানে ৮ থেকে ১০ হাজার লিটার পানি প্রত্যাহার করতে হবে। এত দীর্ঘসময় ধরে এভাবে ভূগর্ভস্থ পানি প্রত্যাহারের যে ফলাফল তা যে ভয়াবহ বিপর্যয় তৈরি করতে পারে সেটা খনির জন্যও অনুকূল নয়।
উল্লেখ্য, বর্তমানে উত্তরাঞ্চলে কৃষি আবাদের জন্য বছরে এর এক শতাংশেরও কম পানি তোলা হয়, এটিকে কৃষি ও ভূবিজ্ঞানীরা সেই অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানি স্তর রক্ষার জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করেন। এর ফলে এখনই এই অঞ্চলের শতকরা ৩০ ভাগ টিউবওয়েল অচল হয়ে পড়েছে। সেখানে দিনপ্রতি ৮০ কোটি লিটার পানি উঠালে তার প্রতিক্রিয়া হবে ভয়াবহ। পানি ব্যবস্থাপনা এভাবে বিপর্যস্ত হলে এই পুরো অঞ্চলই মানুষের বসবাস ও আবাদের অযোগ্য হয়ে যাবে।
এছাড়া রয়েছে বিপুল জনবসতির চাপ। দেশের গড় জনঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১০৭৯ যেখানে এটা অস্ট্রেলিয়ায় ৩, যুক্তরাষ্ট্রে ৩২, ইন্দোনেশিয়ায় ১২০, চীনে ১৩৯, জার্মানিতে ২৩৭ এবং ভারতে ৩৬৩। সারাদেশে জনঘনত্ব এত বেশি হওয়ায় এক অঞ্চল থেকে বসতি এবং সমাজজীবন সরিয়ে তা অন্য অঞ্চলে প্রতিস্থাপন একেবারেই অসম্ভব।
সব মিলিয়ে এটা স্পষ্ট হচ্ছে যে, স্বল্প লাভের নিমিত্তেই ডেকে আনা হচ্ছে বড় বিপদ। মুখে যা-ই বলা হোক না কেন, সরকার উন্মুক্ত খনির প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। এর ফলে কী ঘটতে পারে তার তোয়াক্কা করছে না। প্রধানমন্ত্রী যখন উন্মুক্ত খনি থেকে সরে এসেছিলেন, তখন অনেকেই তাকে সাধুবাদ জানিয়েছিলেন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সেটা ছিল নির্বাচনী কৌশল। নির্বাচন শেষ হয়ে আবার ক্ষমতায় এসে উন্মুক্ত খননের পথেই এগুচ্ছে সরকার। যা কিনা কিছু বিদেশি কোম্পানি ও সরকারে থাকা ব্যক্তির লাভ এনে দিবে। আর বিপরীতে নিঃস্ব করবে গরিব জনগোষ্ঠীকে। ধ্বংস হবে পরিবেশ ও প্রতিবেশ।
তেল গ্যাস খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি থেকে এটা স্পষ্ট করে জানিয়েছে যে, আমাদের দেশের ভূস্তরের যে গঠন ও আমাদের আবাদি ও আবাসিক জমির যে অভাব, তাতে করে এদেশে কোথাও উন্মুক্ত খনি করা সম্ভব না। এখন কয়লা আমদানি করা হোক। এগুলো এখনই তুলে শেষ করে ফেলার দরকার নেই। পরে আরও ভালো প্রযুক্তি আসবে এবং এই সম্পদটা তখন বেশি ভালো করে কাজে লাগানো যাবে। এখন বেশিরভাগটাই যাবে বিদেশি কোম্পানি ও কমিশনভোগীদের পকেটে। সরকার যদি অর্থমূল্যের বাইরে মানুষ ও পরিবেশের মূল্য না বুঝতে পারে তাহলে সেটা তার জন্য কতটা বুমেরাং হতে পারে, ফুলবাড়ীর গণঅভ্যুত্থান সেই বার্তাই স্মরণ করিয়ে দেয়। তারা এ থেকে যে শিক্ষা নেয়নি, তা দেখাই যাচ্ছে। এখন আমরা যারা উন্মুক্ত খনির বিরোধিতা করি, আমাদের সাবধান হতে হবে এবং দ্রুত এই দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে মাঠে নামতে হবে।