Sunday, August 10th, 2014
বড়পুকুরিয়ায় উন্মুক্ত কয়লা খনি কতটা যুক্তিযুক্ত?
গত ২০ জুলাই দৈনিক প্রথম আলোয় খনি প্রকৌশলী জনাব মুশফিকুর রহমানের একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে তিনি বড়পুকুরিয়ায় উন্মুক্ত কয়লাখনির সম্ভাবনা দেখেছেন এবং ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের (আইডব্লিউএম) চলতি সমীক্ষার প্রসঙ্গ টেনেছেন। লেখাটিতে তিনি বাংলাদেশের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে যে আশাবাদ প্রকাশ করেছেন, সেজন্য আমি তার প্রশংসা করি; কিন্তু তিনি উন্মুক্ত খনির বিরোধিতাকারীদের ‘হাতুড়ে বিশেষজ্ঞ’ বলে যে কটূক্তি করেছেন, সেজন্য তার নিন্দা করি। এই বিরোধিতাকারী বিশেষজ্ঞরা ‘হাতুড়ে’ হতে পারেন, কিন্তু তারা বিরোধিতা করছেন কোনো ব্যক্তিগত লোভ-লালসা বা কোনো বিশেষ স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী কিংবা কোম্পানির দালালির জন্য নয়। তারা তা করছেন কোনো এলাকার নিরীহ জনগণের স্বার্থে, যারা তাদেরকে এই বিরোধিতার জন্য ভাড়া করে খাটায় না। সরকারি একটি প্রকল্পের বিরোধিতা করার অধিকার সেই প্রকল্পের অভিঘাতে ভুক্তভোগীদের যেমন আছে, তেমনি তাদের সমর্থনে দাঁড়ানো মানবাধিকার কর্মীদেরও আছে।
বাংলাদেশের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জনাব নসরুল হামিদ ১০ জুলাই ঘোষণা করেন, সরকার বড়পুকুরিয়ায় একটি ছোট উন্মুক্ত কয়লাখনি করতে যাচ্ছে। খনিটি খনিমুখে নির্মিতব্য একটি ১৩০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুেকন্দ্রে জ্বালানি সরবরাহ করবে। আপাতদৃষ্টিতে এ উদ্দেশ্য প্রশংসনীয়। কিন্তু বাংলাদেশে উন্মুক্ত কয়লাখনি সম্পর্কে আমরা যারা ‘হাতুড়ে বিশেষজ্ঞ’ তারা বলছি, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খনির গভীরতা ১০০ মিটারের বেশি হলে তা লাভজনক হয় না। আমাদের ‘প্রকৃত বিশেষজ্ঞ’রা জার্মানির হামবাক কলোন এলাকার উন্মুক্ত কয়লাখনির উদাহরণ দেন। ওই এলাকায় লিগনাইট জাতের যে কয়লা তোলা হচ্ছে, তা ১০০ মিটার গভীর থেকে ঢাল হয়ে ৫০০ মিটার গভীর পর্যন্ত জমা আছে। তাই ১০০ মিটার উন্মুক্ত করে সেখান থেকে সুড়ঙ্গ করে দূরবর্তী এলাকার লিগনাইট কয়লা তোলা হচ্ছে। হামবাক কলোন এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির চাপ খুবই কম, তাই ক্রমাগত পানি তুলে তা সামাল দেয়া গেছে। বড়পুকুরিয়া ও ফুলবাড়ীর বিটুমিনাস কয়লার স্তর ১২০ মিটার থেকে ৫০০ মিটার গভীরে নৌকার আকারে অবস্থিত বিধায় উন্মুক্ত পদ্ধতি লাভজনক হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাছাড়া বড়পুকুরিয়া ও ফুলবাড়ীর কয়লাস্তরের ওপরের ১৫০ মিটার ধুপি টিলা পানির স্তর আছে, যার চাপ এত বেশি যে, পাম্পে ক্রমাগত পানি তুলে বা অন্যভাবে ঠেকিয়ে রাখা মোটেও সম্ভব নয় বিধায় ব্রিটিশ কনসালট্যান্ট ওয়ারডেল আর্মস্ট্রং ১৯৯১ সালের মে মাসে কুয়া ও সুড়ঙ্গ পদ্ধতির সুপারিশ করেন।
বড়পুকুরিয়া কয়লাখনিতে ছয় মিটার ব্যাসের ৩২৬ ও ৩২০ মিটার গভীর দুটি ধাতুর কুয়া পুঁতে পাতাল থেকে প্রলম্বিত আনুভূমিক সুড়ঙ্গ পদ্ধতিতে (Long Wall Top Coal Caving) কয়লা তোলা চলছে। China Machinery Export and Import Company (CMC) নামে চীনা কোম্পানির সঙ্গে সম্পাদিত এই উত্তোলন চুক্তির মেয়াদ ২০১১ সালের ৩১ আগস্ট শেষ হওয়ার পর CMC ও Xuzhou Coal Mining Group Corporation (XMC)-এর মিলিত কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে বড় পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি (BCMCL)-এর Management, Production, Maintenance & Provisioning Services (MPM&P) নতুন চুক্তি হয়। বড় পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানির ওয়েবসাইট থেকে কয়লা উত্তোলনবিষয়ক ছকে প্রকাশিত তথ্য পাওয়া যায়।
বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির বিশেষত্ব হলো, কাদামাটি ও পলিমাটির স্তরের মাঝে ছয়টি স্তরে এ কয়লার মজুদ আছে, যার মধ্যে একটি প্রায় ৩৬ মিটার পুরু। এই কয়লা বিটুমিনাস পর্যায়ের, যাতে সালফারের পরিমাণ মাত্র শূন্য দশমিক ৫৩ শতাংশ হওয়ায় তা বিদ্যুেকন্দ্রের জ্বালানি হিসেবে আদর্শ। তবে কয়লা উত্তোলনের চলতি কুয়া ও সুড়ঙ্গ পদ্ধতিতে একটি বড় ধরনের ত্রুটি আছে, তা হলো— উত্তোলিত কয়লার ভূগর্ভস্থ ফাঁকা জায়গাটি বালু দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে না। ফলে ওপরের মাটির চাপে এলাকাটি দুই থেকে তিন মিটার বসে অনাবাদি হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে পার্বতীপুর উপজেলার হামিদপুর ইউনিয়নের এক বিশাল এলাকা দেবে গিয়ে জলাশয়ে পরিণত হয়েছে। জনগণ দেবে যাওয়া রাস্তার ওপর বাঁশের মাচা নির্মাণ করে (স্থানীয় ভাষায় ‘ধামাল’) যাতায়াত করছে। অথচ চলতি কুয়া ও সুড়ঙ্গ পদ্ধতিতে ৫০ শতাংশের বেশি কয়লা তোলাও সম্ভব নয়। তাই উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খনির প্রায় সবটা কয়লা তোলার জন্য বাংলাদেশ সরকার বড়পুকুরিয়া কয়লাক্ষেত্রের অগভীর উত্তরাংশে সীমিত পরিসরে একটি উন্মুক্ত কয়লাখনি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
জনাব মুশফিকুর রহমান লিখেছেন, ‘উন্মুক্ত কয়লাখনি নির্মাণের প্রয়োজনে বড়পুকুরিয়ার সংশ্লিষ্ট অংশ থেকে বছরে প্রায় ৩৪৪ মিলিয়ন ঘনমিটার পানি উত্তোলন করতে হবে এবং আইডব্লিউএম সেখানে ডিওয়াটারিং অপারেশন ব্যবস্থাপনা সম্ভব বলে মনে করে।’ আইডব্লিউএম আগেও ফুলবাড়ী নিয়ে সমীক্ষা করেছে। একই গভীরতার এই পাইলট প্রকল্পে তাদের সমীক্ষার ফল একই রকম হতে পারে। তবে আমার কথা, আইডব্লিউএম একটি সরকারপুষ্ট সংস্থা, যারা বছর বছর সরকারি আনুকূল্যে সরকার প্রস্তাবিত প্রকল্পে বিনা টেন্ডারে কাজ নিয়ে সমীক্ষা ও পরামর্শ দিয়ে থাকে। আইডব্লিউএম যত পরামর্শ দিয়েছে এবং তাদের পরামর্শে যেসব কাজ হয়েছে, সেসব কাজের কতটি সফলভাবে শেষ হয়েছে, তা যাচাই করলে থলের বেড়াল বেরিয়ে আসবে। শুধু আইডব্লিউএম নয়, কোনো বিশেষ মহল যদি সরকারি কোনো প্রকল্পে আগ্রহী থাকে, তাহলে সে প্রকল্প সম্ভব বলে সমীক্ষা রিপোর্ট দেয়ার জন্য অনেক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান তৈরি আছে। বাস্তবে ওইসব প্রকল্প জনগণের বিপদ ডেকে আনে, পরিবেশ ধ্বংস করে। ওই ধরনের প্রকল্প শুরু হয়ে মুখ থুবড়ে পড়লে এবং জনগণের অর্থ ব্যয় হলেও আগ্রহী মহল যা লুটপাট করার তা করে নেয়।
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণ এখন বাংলাদেশের জন্য আবশ্যকীয় হয়ে পড়েছে। এ কয়লা আমদানি করলেও হয়। কারণ আমাদের কয়লা যখনই তুলব, তখনই ফুরাতে শুরু করবে। পৃথিবীতে খনিজসম্পদ যেখানেই থাক, তা সীমিত, নবায়নযোগ্য নয়। আমাদের গ্যাসসম্পদ অচিরেই ফুরিয়ে যাবে। তাই বলে কোনো বিশেষ মহলের চাপে বা আগ্রহে কোনো স্থানে জনগণের ওপর প্রকল্প চাপিয়ে দেয়া ঠিক নয়। বড়পুকুরিয়ায় সীমিত আকারে উন্মুক্ত কয়লা খনি প্রকল্প শুরু করার আগে অন্তত চারটি সমীক্ষা হওয়া জরুরি। যেমন— ১. অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা, ২. কারিগরি সম্ভাব্যতা, ৩. সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা ও ৪. পরিবেশগত অভিঘাত। অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা আপাতদৃষ্টিতে লাভজনক মনে হলেও খনিটি খনন, পরিচালন, উত্তোলন ও ব্যবহার প্রক্রিয়ায় যে খরচ হবে তা আসলেই লাভজনক উত্পাদন দিতে পারবে কিনা তা দেখতে হবে। আইডব্লিউএমের মাধ্যমে যে কারিগরি সম্ভাব্যতা দেখা হচ্ছে, তাতে ৩৪৪ মিলিয়ন ঘনমিটারের জায়গায় ৬৮৮ মিলিয়ন ঘনমিটার পানি তোলার প্রয়োজন হলেও অঙ্কের হিসাবে তা সম্ভব দেখানো যায়। প্রশ্ন হলো, বাস্তবে তা সম্ভব কিনা? আইডব্লিউএম কি দায়িত্ব নিয়ে এ ব্যাপারে সুপারিশ করবে?
আমরা কোনো সরকারি প্রকল্প গ্রহণের আগে জনগণের স্বার্থ নিয়ে কথা বলার সময় প্রকল্পটির সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বিচার করার ব্যাপারে জোর দিই। এক্ষেত্রে বিচার্য বিষয়গুলো হচ্ছে— ক. বিদ্যমান অবস্থায় স্থানীয় জনগণের জীবিকা ও প্রস্তাবিত জীবিকা, খ. বিদ্যমান ঐতিহ্য, ধর্ম ও সংস্কৃতির ওপর অভিঘাত ও প্রস্তাবনা, গ. স্থানীয় জনগণের আবাসন এবং প্রস্তাবিত বিকল্প আবাসন ব্যবস্থা, ঘ. বিদ্যমান অবস্থায় নারীর কর্মসংস্থান এবং প্রস্তাবিত কর্মসংস্থান, ঙ. শিশু-কিশোরদের খেলার মাঠ, শিক্ষা ও বিনোদনের বিকল্প ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে প্রকল্পটি স্থানীয় জনগণের জীবনধারণের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হবে কিনা এবং না হলে কীভাবে তা করা যাবে, জনগণের বিকল্প জীবিকা কী হবে, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের কী কী ব্যবস্থা হবে, তা বেরিয়ে আসবে। আমরা প্রকল্পটি যাতে পরিবেশবিমুখ না হয়, সেজন্য— ক. প্রকল্পের জন্য পশু, পাখি, মাছ, জলজ উদ্ভিদ ও ভূমিজ গাছপালার ক্ষতি, খ. প্রকল্পের কারণে চারপাশের জনজীবন ও পরিবেশের ওপর অভিঘাত, গ. প্রকল্পের কারণে সাংবত্সর জলবায়ুর পরিক্রমণের ওপর অভিঘাত, ঘ. দেশী ও আন্তর্জাতিক পরিবেশগত আইনে প্রকল্পের গ্রহণযোগ্যতা, ঙ. প্রকল্পের জন্য উত্তোলিত জল ব্যবহার এবং বর্জ্য শোধন ব্যবস্থা ইত্যাদি যাচাই করতে বলি। ওই অনুযায়ী চারটি সমীক্ষা সম্পন্ন করে তা দেশবাসীর কাছে প্রকাশ করলে কারো মনে ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ থাকবে না। তখন কোনো প্রকল্প জনগণের কাছে আপদ নয়, সম্পদ হিসেবে গৃহীত হবে।
[৯ অগাষ্ট ২০১৪ তারিখ দৈনিক বণিক বার্তায় প্রকাশিত
http://www.bonikbarta.com/2014-08-09/news/details/9871.html]
লেখক: প্রকৌশলী; সাবেক মহাপরিচালক, পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা;
চেয়ারম্যান, জল পরিবেশ ইনস্টিটিউট, email: minamul@gmail.com