?> ন্যায় বিচারের স্বার্থে বিদ্যুতের দাম কমানোর দাবী « NCBD – National Committee of Bangladesh

Tuesday, March 11th, 2014

ন্যায় বিচারের স্বার্থে বিদ্যুতের দাম কমানোর দাবী

গত ৪-৬ মার্চ বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরী কমিশনে বিদ্যুতের খুচরা দামহার বৃদ্ধির গণশুনানী হয়েছে। বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা ও কোম্পানির প্রস্তাবসমুহ এবং তার ওপর অনুষ্ঠিত এ গণশুনানী পর্যালোচনান্তে ন্যায় বিচারের স্বার্থে ভোক্তাদের পক্ষ থেকে ক্যাব বিদ্যুতের দাম কমানোর তাগিদে কমিশনের নিকট অভিমত ও সুপারিশ পেশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে কিছু কৌশলগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে বিদ্যুৎ খাত অসাধু ব্যবসা মুক্ত হতে পারে এবং আর্থিক ঘাটতি কমিয়ে এনে ভতুর্কি কমানো যেতে পারে ফলে অনায়াসেই বিদ্যুতের দাম কমানো সম্ভব। তাই বিদ্যুতের দাম কমানোর দাবীতে আজকের এ সংবাদ সম্মেলন।

২০১২ সালের ডিসেম্বরের গণশুনানির ভিত্তিতে ভোক্তা পর্যায়ে গড়ে প্রায় ৩.৭৫ শতাংশ দাম বৃদ্ধি করে বিদ্যুতের খুচরা দামহার কমিশন পুনর্নিধারণ করে। কিন্তু তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। তখন প্রায় ৭২৫ কোটি টাকা ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে এ মূল্য বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত হয়।

গত ৪-৬ মার্চ বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির নতুন প্রস্তাবসমূহের ওপর গণশুনানী অনুষ্ঠিত হয়। সে গণশুনানীতে কমিশনের কারিগরী কমিটি প্রস্তাবসমুহের মূল্যায়ন প্রতিবেদন পেশ করে। তাতে দেখা যায়, ভর্তুকি দেয়া না হলে কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ঘাটতি পূরণের জন্য গড়ে প্রায় ৪.৮১ শতাংশ খুচরা মূল্যহার বৃদ্ধির প্রয়োজন হতে পারে। প্রস্তাবে দেখানো হয়েছে গড়ে প্রায় ১.১১ শতাংশ সিস্টেম লস হ্রাস পাবে। তাতে সাশ্রয় হবে প্রায় ২২৫ কোটি টাকা। কমিটির মূল্যায়নে তা আলোকপাত করা হয়নি। তাছাড়া জনবল, মেরামত ও রক্ষনাবেক্ষণ এবং উন্নয়ন প্রকল্প ব্যয় বেড়েছে অস্বাভাবিক। এ অস্বাভাবিক ব্যয় বৃদ্ধি নজরে আসলেও কমিটির হিসাবে আসেনি। দামহার নির্ধারণে কমিটি তা ভোক্তাদের ওপর আরোপ করেছে। গতবারের তুলনায় এবারে বিদ্যুৎ প্রবাহ প্রবৃদ্ধি ৮-১০ শতাংশ হবে বিধায় বিতরণ ব্যয়হার কমবে, তাও মূল্যয়নে ধরা হয়নি। এ সব সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় আসা দরকার।

যদি অস্বাভাবিক বাড়তি জনবল, মেরামত ও রক্ষনাবেক্ষণ এবং উন্নয়ন প্রকল্প ব্যয় বাদ দিয়ে দামহার নির্ধারণ হয় এবং সিস্টেম লস কমার কারণে সাশ্রয়ী অর্থে ঘাটতি সমন্বয় করা হয়, তাহলে বিদ্যুতের দামহার বৃদ্ধির দরকার হয় না। ভোক্তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ভুলনীতি ও দুর্নীতি বিদ্যুতের দামবৃদ্ধির অন্যতম কারণ।

দাবি:
১. ২০১২-১৩ অর্থবছরে  ২০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রবৃদ্ধি ধরে ৪০ বিলিয়ন একক বিদ্যুৎ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। সেজন্য ৩ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা ভর্তুকীসহ বাল্ক বিদ্যুতের দাম ৪.৭০টাকা কমিশন নির্ধারণ করে। কিন্তু উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে ৩৬.৪৮ বিলিয়ন একক। যেহেতু বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হওয়ায় ঘাটতিও কমেছে এবং ভর্তুকি সাশ্রয় হয়েছে, সেহেতু এই সাশ্রয়ী অর্থ দ্বারা খুচরা বিদ্যুতের আর্থিক ঘাটতি সমন্বয় করে দাম কমাতে হবে।

২.বিতরণ সংস্থা/কোম্পানির জন্য কোন প্রফিট মার্জিন রাখা যাবে না।

৩.গণশুনানীতে প্রতীয়মান হয়, বিদ্যমান দামহার-কাঠামো জনস্বার্থ পরিপন্থী। ভোক্তা শ্রেণীভেদে দামহারে যে তারতম্য রয়েছে তাতে প্রান্তিক গ্রাহক শ্রেণী বৈষম্যের শিকার। বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত জ্বালানীতে ভর্তুকি দে’য়া হয়। ফলে ধনী ও গরীব বিদ্যুৎ গ্রাহক প্রত্যেকেই কমবেশি এ ভর্তুকি সুবিধা পায়। এই প্রেক্ষাপটে গণশুনানিতে বিদ্যুতের দামহার গরীব গ্রাহকের (আবাসিক, বানিজ্যিক, শিল্প ও কৃষি গ্রাহক) জন্য কমানো এবং ধনী গ্রাহকের (আবাসিক, বাণিজ্যিক ও শিল্প) জন্য বাড়ানোর দাবী উঠেছে। সে দাবি মানতে হবে।

৪.দামহার বৃদ্ধির অভিঘাত থেকে প্রান্তিক গ্রাহকদের সুরক্ষার জন্য বিদ্যুতের বানিজ্যিক, উৎপাদন ও নানা পর্যায়ে ভর্তুকি দামহার নির্ধারণের জন্য একটি গাইড লাইন এবং বিদ্যুৎ খাতের বিদ্যমান দামহার-কাঠামো সংস্কার প্রয়োজন। গণশুনানীতে তা গুরুত্ত্ব পেয়েছে। এ ব্যাপারে বিভিন্ন পর্যায়ের ভোক্তা প্রতিনিধি নিয়ে কমিটি গঠনের প্রস্তাব এসেছে। সে প্রস্তাব গ্রহণ করতে হবে।

৫.আলোচ্য প্রেক্ষাপটে বাল্ক বিদ্যুতের দামহার পর্যালোচনা করা জরুরী। রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেনার ফলে বিদ্যুতের দামহার বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণহীন। বিগত গণশুনানীতে চুক্তির মেয়াদ শেষে এসব প্লান্টের মেয়াদ বৃদ্ধি না করার জন্য সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব গৃহীত হয়। কুইক রেন্টাল থেকে গ্যাস-বিদ্যুৎ (৬’শ মেগাওয়াটের বেশি) না কিনে সরকারি খাতে সে গ্যাসে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হলে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হতে পারে এবং তাতে বাল্ক বিদ্যুতের বর্তমান দামহার কমিয়ে আনা সম্ভব। খুচরা বিদ্যুতে তা সমন্বয় করা হলে খুচরা বিদ্যুতের দাম কমে আসবে। এই কারণে বিদ্যুতের দাম কমানোর জন্য গণ শুনানীতে সমবেতভাবে সমস্বরে দাবি উঠেছে। সে দাবি মানতে হবে।

৬.রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল প্লান্টের চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি বা নবায়ন হবে না। এ প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে বিগত বাল্ক বিদ্যুতের মূল্যহার বৃদ্ধির গণশুনানীতে গৃহীত হয়। অথচ ২০২০ সাল নাগাদ তার মেয়াদ বৃদ্ধি হচ্ছে। যে সুপারিশের ভিত্তিতে এ মেয়াদ বৃদ্ধি সে সুপারিশ প্রতিবেদন ঐ সব প্লান্ট মালিকের স্বার্থ ও চাপে করা হয়েছে। তার সাথে বিদ্যুৎ খাত উন্নয়নের সম্পর্ক সাংঘর্ষিক। ভোক্তাদের এ অভিযোগ খতিয়ে দেখার জন্য ঐ প্রতিবেদনের ওপর গণ শুনানীর দাবি ওঠেছে। সে দাবী মানতে হবে।

৭.জনবল নিয়োগ এবং উন্নয়ন প্রকল্প প্রনয়ন ও বাস্তবায়নে বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা/কোম্পানির সক্ষমতা মানসম্মত না হওয়ায় বিতরণ ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। তাদেরকে কেবলমাত্র বিদ্যুৎ কেনা-বেচার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার জন্য গণশুনানীতে প্রস্তাব করা হয়েছে। কেন্দ্রীয়ভাবে পৃথক পৃথক সংস্থার মাধ্যমে জনবল নিয়োগ এবং উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করার প্রস্তাবও এসেছে। এ সব প্রস্তাব গ্রহণ করতে হবে।

৮.বিদ্যুৎ সঞ্চালনের একমাত্র লাইসেন্সী পিজিসিবি। ঢাকার বিদ্যুৎ বিতরণের লাইসেন্সী ডিপিডিসি ও ডেসকো। অথচ তাদের মালিকানায় ও পরিচালনায় ১৩২ কেভি সঞ্চালন লাইন রয়েছে। এসব লাইন সম্প্রসারণও করছে। এ অজুহাতে তারা ব্যয় বাড়াচ্ছে। অবিলম্বে এ সব লাইন পিজিসিবি’র নিকট হস্তান্তর করতে হবে।

৯.নিরপেক্ষ কারিগরি বিশেষজ্ঞ দ্বারা বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ সংস্থা/কোম্পানির টেকনিক্যাল অডিট করাতে হবে।

১০. সরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে চাহিদা মাফিক গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ক্যাপটিভসহ যে কোন ব্যক্তিখাত বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং আবাসিক ও সিএনজিতে নতুন করে গ্যাস সংযোগ নিষিদ্ধ করতে হবে।

১১. গ্যাস ও বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ তদন্তের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য গোয়েন্দা সংস্থাকে দায়িত্ত্ব দিতে হবে।

১২.ঐ সব অবৈধ সংযোগের সাথে জড়িত ইউটিলিটির কর্মকর্তা, কর্মচারি, দালাল ও ঠিকাদারদের সনাক্ত করতে হবে এবং ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কমিশনের সিদ্ধান্তক্রমে বিষয়টি দুদকে পাঠাতে হবে। এমন সব অবৈধ সংযোগ প্রতিরোধকল্পে কমিশনকে ভ্রাম্যমান আদালতে বিচার কার্যক্রম শুরু করার প্রস্তাব  ভোক্তা অধিদপ্তরে পাঠাতে হবে।

অসাধু ব্যবসার কবল থেকে ন্যায় বিচারের স্বার্থে বিদ্যুৎ খাতকে মুক্ত করার জন্য এ সব দাবী মেনে নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সকল মহলের প্রতি আহবান জানানো হলো।

[১১ মার্চ ২০১৪ তারিখে ক্যাব-এর সংবাদ সম্মেলনে এই লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন ক্যাবের জ্বালানী উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম]