Sunday, September 22nd, 2019
১১ কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ দুই হাজার কোটি টাকা
বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বর্তমানে শীর্ষে রয়েছে সামিট। এ গ্রুপের ১১টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। তবে গত অর্থবছর বেশিরভাগ কেন্দ্রের সক্ষমতার অর্ধেকও ব্যবহার করা হয়নি। অথচ ১১টি কেন্দ্রের জন্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি) ২০১৮-১৯ অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয়েছে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত কয়েক বছরে বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে অগ্রাধিকার দেয় সরকার। এ সময় বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে সামিট। তবে চাহিদা না থাকায় এখন অনেক কেন্দ্রেই উৎপাদিত হচ্ছে নামমাত্র। তবে বসিয়ে রেখে এসব কেন্দ্রের জন্য নিয়মিত ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হচ্ছে। ফলে একদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে, অন্যদিকে এ খাতে সরকারের ভর্তুকিও বাড়ছে।
তথ্যমতে, গত অর্থবছর বেসরকারি খাতের ৭৯টি কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনে পিডিবি। স্বল্পমেয়াদি রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি) নামক এসব কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা পাঁচ হাজার ৭৪১ মেগওয়াট। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এসব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনা হয়েছে দুই হাজার ৭১৩ কোটি ৩০ লাখ ৪৯ হাজার কিলোওয়াট ঘণ্টা। এজন্য ব্যয় করা হয় ২০ হাজার ৭৮১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।
এদিকে সামিট গ্রুপের ১১টি কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনা হয় ৫৮৪ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা। এজন্য ব্যয় করা হয় প্রায় পাঁচ হাজার ৮১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জই পরিশোধ করা হয় এক হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিদ্যুৎ কেনায় মোট ব্যয়ের ৩৮ দশমিক ২৮ শতাংশই ছিল ক্যাপাসিটি চার্জ।
পিডিবির তথ্যমতে, বর্তমানে সামিট গ্রুপের আইপিপি রয়েছে আটটি ও রেন্টাল কেন্দ্র তিনটি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বড় ও ব্যয়বহুল সামিট মেঘনাঘাট বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। ডিজেল ও গ্যাসচালিত এ কেন্দ্রটির উৎপাদন সক্ষমতা ৩৫৫ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ডিজেল দিয়ে কেন্দ্রটির উৎপাদন চলে (প্লান্ট ফ্যাক্টর) মাত্র ৯ শতাংশ সময়। আর গ্যাসের প্লান্ট ফ্যাক্টর ছিল ২৯ শতাংশ।
২০১৮-১৯ অর্থবছর কেন্দ্রটিতে ডিজেলে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় ২৭ কোটি ৪৭ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। আর গ্যাসে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় ৬৩ কোটি ৬৮ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। অর্থাৎ কেন্দ্রটির মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৯১ কোটি ১৫ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এতে ব্যয় হয় এক হাজার ১২২ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জই ছিল ৫৯৭ কোটি ২৮ লাখ টাকা।
সামিট গ্রুপের দ্বিতীয় বৃহৎ কেন্দ্রটি হলো সামিট বিবিয়ানা-২। গ্যাসচালিত ৩৪১ মেগাওয়াট সক্ষমতার কেন্দ্রটিতে গত অর্থবছর বিদ্যুৎ কেনা হয় ২২৭ কোটি ৫৮ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এতে ব্যয় হয় ৪৯২ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৩৩১ কোটি চার লাখ টাকা ছিল ক্যাপাসিটি চার্জ। কেন্দ্রটির প্লান্ট ফ্যাক্ট ৭৬ শতাংশ। এ কেন্দ্রটিতে সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার করা হয়েছে।
গ্যাসচালিত সামিট পূর্বাঞ্চল পাওয়ারের উৎপাদন সক্ষমতা ৩৩ মেগাওয়াট। কেন্দ্রটিতে গত অর্থবছর ১৮ কোটি ৪৭ লাখ ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। এতে ব্যয় হয় ৬৮ কোটি চার লাখ টাকা, যার মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জ ৩৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। এ কেন্দ্রের প্লান্ট ফ্যাক্টর ছিল ৬৪ শতাংশ।
এদিকে গাজীপুরের কড্ডায় রয়েছে ফার্নেস অয়েলচালিত সামিটের ৩০০ মেগাওয়াট আইপিপি। গত অর্থবছর কেন্দ্রটির প্লান্ট ফ্যাক্টর ছিল ২৬ শতাংশ। এতে কেন্দ্রটি থেকে ৬৭ কোটি ১৬ লাখ ইউনিট বিদ্যুৎ কেনা হয়। এতে ব্যয় হয় ৯৫৯ কোটি ৩৭ লাখ টাকা, যার মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল ৩০৩ কোটি পাঁচ লাখ টাকা।
গাজীপুরের কড্ডায় ফার্নেস অয়েলচালিত সামিটের আরেকটি আইপিপি রয়েছে। ১৪৯ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নাম এসিই অ্যালায়েন্স পাওয়ার। কেন্দ্রটি থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪২ কোটি ৭৩ লাখ ইউনিট বিদ্যুৎ কেনা হয়। এতে ব্যয় হয় ৫২৪ কোটি ৩৩ লাখ টাকা, যার মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জ ৯৩ কোটি ১৬ লাখ টাকা।
এদিকে ফার্নেস অয়েলচালিত সামিট নারায়ণগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষমতা ১০২ মেগাওয়াট। কেন্দ্রটি থেকে গত অর্থবছর বিদ্যুৎ কেনা হয় ২০ কোটি ৪৮ লাখ ইউনিট। এতে ব্যয় হয় ৩৪৫ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল ১৪৪ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। কেন্দ্রটির প্লান্ট ফ্যাক্টর ছিল ২৩ শতাংশ।
সামিটের ফার্নেস অয়েলচালিত অপর দুটি আইপিপি হলো সামিট বরিশাল ও সামিট মদনগঞ্জ। কেন্দ্র দুটির উৎপাদন সক্ষমতা যথাক্রমে ১০০ ও ৫৫ মেগাওয়াট। এ দুই কেন্দ্রের মধ্যে গত অর্থবছর সামিট বরিশাল কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় ৩৬ কোটি ছয় লাখ ইউনিট। এতে ব্যয় হয় ৪৭৩ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল ১২০ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। আর সামিট মদনগঞ্জ কেন্দ্রটিতে গত অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় ১৯ কোটি ৫৭ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এতে বিল পরিশোধ করা হয় ২৪৮ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল ৬২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। দুই কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল যথাক্রমে ৪১ ও ৪৮ শতাংশ।
এর বাইরে সামিট গ্রুপের সহযোগী খুলনা পাওয়ার কোম্পানির অধীনে রয়েছে তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। এগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা যথাক্রমে ১১০, ১১৫ ও ৪০ মেগাওয়াট। কেন্দ্র তিনটি থেকে গত অর্থবছর বিদ্যুৎ কেনা হয় যথাক্রমে ১০ কোটি ৫৯ লাখ, ৩২ কোটি ৬৯ লাখ ও ১৭ কোটি ৫২ লাখ ইউনিট। এতে ব্যয় হয়েছিল যথাক্রমে ১৩৬ কোটি ৫৬ লাখ, ৪৭৮ কোটি ৭৫ লাখ ও ২৩০ কোটি ২১ লাখ টাকা।
গত অর্থবছর কেন্দ্র তিনটি ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল যথাক্রমে ৩৫ কোটি, ১৬৩ কোটি ৯৫ লাখ ও ৫৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। আর কেন্দ্র তিনটি প্লান্ট ফ্যাক্টর ছিল ১১, ৩২ ও ৫০ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্যাপাসিটি চার্জ বিদ্যুৎ খাতের জন্য বোঝাস্বরূপ। কোনো কারণে কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন বন্ধ থাকলেও এ অর্থ গুনতে হবে পিডিবিকে। এমনকি বর্তমানে চাহিদা না থাকায় বছরের বেশিরভাগ সময়ই বসে থাকছে বেসরকারি কেন্দ্রগুলো। এর পরও ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়মিতই পরিশোধ করতে হচ্ছে। তাই এ ধরনের লাইসেন্স প্রদানের আগে সংশ্লিষ্ট সব বিষয় গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
আইপিপিগুলোর জন্য ১৫-২২ বছরের চুক্তিতে ক্যাপাসিটি চার্জ অনেক বেশি দেওয়া হয়েছে বলে মনে করেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম। তিনি বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে সরকার দায়মুক্তি বিধান দিয়ে রেখেছে। ফলে এ খাতে কোনো প্রতিযোগিতা নেই, জবাবদিহিতাও নেই। আর এ সুযোগে বেসরকারি খাত বাড়তি সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। আইনটির প্রয়োগ বন্ধ না হলে এ খাতে সুশাসনও ফিরবে না।