?> মধ্যপাড়া কঠিনশীলা খনি: পাথর না তুলেও ২৫০ কোটি টাকা লোপাট « NCBD – National Committee of Bangladesh

Saturday, January 11th, 2020

মধ্যপাড়া কঠিনশীলা খনি: পাথর না তুলেও ২৫০ কোটি টাকা লোপাট

মধ্যপাড়া কঠিন শিলাখনি থেকে জার্মানিয়া ট্রেস্ট কনসোর্টিয়াম নামের একটি প্রতিষ্ঠান ছয় বছরে ৩২ লাখ টন পাথর তুলেছে। এ জন্য প্রতিষ্ঠানটির ৩০০ কোটি টাকা নেওয়ার কথা, কিন্তু নিয়েছে এ পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ শ কোটি টাকা। চুক্তির বাইরে আড়াই শ কোটি টাকা বেশি নিতে চুক্তি সংশোধন পর্যন্ত করতে হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রাথমিক অনুসন্ধান করছে। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে এ তথ্য জানা গেছে।

আগামী ১৯ ফেব্রুয়ারি জার্মানিয়া ট্রেস্ট কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, প্রতিষ্ঠানটিকে আবার কাজ দেওয়ার চেষ্টা করছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি বিভাগ।

দিনাজপুরের মধ্যপাড়া কঠিন শিলাখনিটি পরিচালনা করছে সরকারি প্রতিষ্ঠান মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড (এমজিএমসিএল)।
 
জানা গেছে, ২০১২ সালের ২ এপ্রিল বাংলাদেশের যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের পরিদপ্তরের কার্যালয়ে (রেজসকো) জার্মানিয়া করপোরেশন লিমিটেড নামে একটি বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন করা হয়। এ কোম্পানির ৮০ ভাগ মালিকানা রয়েছে কাজী সিরাজুল ইসলামের নামে। তিনি এ কোম্পানির বর্তমান চেয়ারম্যান। বাকি ২০ ভাগের মালিকানা দুজনের। এঁরা হলেন মোহাম্মদ জাভেদ সিদ্দিকী ও মোহাম্মদ মশিউর রহমান। বর্তমানে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মশিউর রহমান।

জার্মানিয়া করপোরেশন লিমিটেড ও বেলারুশের কোম্পানি ট্রেস্টের সঙ্গে জার্মানিয়া ট্রেস্ট কনসোর্টিয়াম (জিটিসি) নামে প্রতিষ্ঠান করে মধ্যপাড়া কঠিন শিলাখনি থেকে পাথর উত্তোলনের দরপত্রে অংশ নেয়। দরপত্রে বিজয়ী হয়ে ২০১৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর এমজিএমসিএলের সঙ্গে চুক্তি সই করে জিটিসি।

জানতে চাইলে এমজিএমসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ বি এম কামরুজ্জামান গত বছরের ৩ ডিসেম্বর মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, জিটিসির সঙ্গে চুক্তি ছিল ৯২ লাখ টন পাথর উত্তোলনের। তারা মাত্র ৩০ ভাগের কিছু বেশি পাথর তুলেছে। অথচ প্রতিষ্ঠানটি নানা খাতে আবার অর্থও নিয়েছে।

 

মধ্যপাড়া কঠিন শিলা কোম্পানির দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, জিটিসির সঙ্গে পাথর খনি কোম্পানি এমজিএমসিএলের ছয় বছরের চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান জিটিসি ৯২ লাখ টন পাথর তুলবে। এ পাথর তুলতে ১২টি খাতে জিটিসিকে দেওয়া হবে প্রায় ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। ২০১৩ সালের অক্টোবরে করা চুক্তি অনুযায়ী প্রতিবছর প্রতিটি খাত থেকে কত অর্থ নিতে পারবে, তা নির্দিষ্ট করা ছিল। দুই বছর পরে এসে একটি সম্পূরক চুক্তির মাধ্যমে প্রথম করা চুক্তির আমূল পরিবর্তন করা হয়। আর তাতেই ছয় বছরের জন্য বিভিন্ন খাতের বরাদ্দের একটি অংশ ২০১৬ সালের মধ্যেই তুলে ফেলে জিটিসি। টাকা নিয়ে গেলেও তারা এ সময় পাথর তুলতে পারেনি।

কঠিন শিলার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০১৩ সালের অক্টোবরে করা এমজিএমসিএল ও জিটিসির চুক্তিটির একটি সম্পূরক চুক্তি করা হয় ২০১৫ সালের ২৭ মার্চ। এই সম্পূরক চুক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ধারাগুলো পরিবর্তন করে দেওয়া হয়। অথচ এভাবে সরকারের অনুমোদন না দিয়ে ঠিকাদারের সঙ্গে মিলে চুক্তি সংশোধন করার সুযোগ নেই।

জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জিটিসিকে ২০১৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি খনি বুঝিয়ে দেওয়া হয়। চুক্তি অনুযায়ী এর আগেই জিটিসিকে ৬৮ কোটি টাকা অগ্রিম দেওয়া হয় খনি উন্নয়নের জন্য। প্রতিষ্ঠানটি ২০২০ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৯২ লাখ টন পাথর খনি থেকে তুলবে। এখন পর্যন্ত তুলেছে মাত্র ৩২ লাখ টন।

এমজিএমসিএলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, খনি থেকে পাথর উত্তোলনে জিটিসির বিনিয়োগ করতে হয়নি, সরকারের ৬৮ কোটি টাকা অগ্রিম নিয়ে তারা কাজ শুরু করে। এ অর্থ ২৩ মাসের মধ্যে পরিশোধ করার কথা ছিল। অগ্রিম নেওয়া এ অর্থ ৪৮টি কিস্তির মাধ্যমে ২০১৬ সালের ২০ জানুয়ারির মধ্যে ফেরত দেওয়ার কথা থাকলেও জিটিসি এ অর্থ এখন পর্যন্ত ফেরত দেয়নি।

খনি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব অর্থ যে আত্মসাতের উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছে, তা সহজেই বোঝা যায়। কারণ, বিস্ফোরক দিয়ে খনির গভীরে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়, এরপর পাথর উত্তোলন করা হয়। তারা বিস্ফোরক কেনার সব টাকা খরচ করে ফেলেছে। কিন্তু পাথর তোলেনি। তাহলে এই বিস্ফোরক কোথায় গেল।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খনিতে কর্মরত শ্রমিকদের বিমার আওতায় আনার জন্য বরাদ্দ ছিল ১০ কোটি টাকা। এ বরাদ্দের একটি অর্থও জিটিসি ব্যবহার করেনি। কারণ বিমার অর্থ নিলে সেটি ধরা পড়ে যাবে, সে জন্য নেয়নি বলে একাধিক খনি কর্মকর্তার মন্তব্য।

জানা গেছে, চুক্তি অনুযায়ী খনি থেকে উত্তোলিত পাথরে ৮ শতাংশের বেশি গুঁড়া (পাথরের ডাস্ট) থাকা যাবে না। এর বেশি হলে তা বিল থেকে কর্তন করা হবে। জিটিসি যে পাথর দিয়েছে, তাতে গড় ১৮ শতাংশ গুঁড়া ছিল। বিল দেওয়ার সময় বাড়তি ৮ শতাংশ গুঁড়ার দাম কেটে নেওয়া হয়নি। এতে ৩২ লাখের মধ্যে ২ লাখ ৫৬ হাজার টন গুঁড়া বিক্রি করেছে জিটিসি।

২০ ফেব্রুয়ারি জিটিসির সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে। কিন্তু এর আগে প্রতিষ্ঠানটি সরকারের ওপর মহলে দৌড়াদৌড়ি করছে মেয়াদ বাড়ানোর জন্য। খনির নতুন ঠিকাদার নিয়োগ দিতে গত বছরের ৭ অক্টোবর এমজিএমসিএল আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে। পাথরখনি কোম্পানির দুই কর্মকর্তা বলেছেন, দরপত্র আহ্বানের দিনই পেট্রোবাংলা থেকে মুঠোফোনে মৌখিক নির্দেশে দরপত্রটি বাতিল করে এমজিএমসিএল।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘জিটিসির সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে ফেব্রুয়ারিতে। পাথর উত্তোলনে দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া চলছে। যারা এখন পাথর উত্তোলনের কাজ করছে, তাদের পারফরম্যান্স ভালো ছিল না, চুক্তি অনুযায়ী তারা পাথর তুলতে পারেনি ঠিকই। কিন্তু বেআইনিভাবে জিটিসি টাকা নিয়ে গেছে এটি আমার জানা নেই। এ বিষয়ে দ্রুত কমিটি গঠন করা হবে। অভিযোগের সত্যতা থাকলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেবে সরকার।’ জিটিসির অনিয়মের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে প্রতিষ্ঠানটির মনোনীত প্রতিনিধি সিরাজুল ইসলামের কাছে জানতে চাওয়া হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা নিয়ম মেনে অর্থ উত্তোলন করেছি। নিয়মের বাইরে কিছু করিনি।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বদরুল ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, চুক্তি অনুযায়ী জিটিসি পাথর তুলতে পারেনি। একটি নতুন দক্ষ কোম্পানিকে যাচাই–বাছাই করে পাথর উত্তোলনের ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া উচিত।