Tuesday, August 28th, 2018
বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আমদানি করা হচ্ছে কয়লা
বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্র দ্রুত চালু করতে প্রাথমিকভাবে এক লাখ টন কয়লা আমদানি করা হবে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। এই কয়লা সেপ্টেম্বরে আসার কথা রয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, কয়লা সরবরাহের জন্য সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশ দূতাবাসে ১৩ কোম্পানির কাছ থেকে আগ্রহপত্র (আরএফপি) চাওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে কয়লা খনি থেকে বড়পুকুরিয়া পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিতে হবে সরবরাহকারীকে। আগামী বৃহস্পতিবার সিঙ্গাপুরে আরএফপি জমা দেওয়ার শেষ দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। সমুদ্রপথে আমদানি করার পর এই কয়লা রেলপথে দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া পর্যন্ত নেওয়া হবে। এ জন্য সম্ভাব্য পাঁচটি রুট নির্ধারণ করা হয়েছে।
আগামী সেপ্টেম্বর থেকে বড়পুকুরিয়া খনির কয়লা উত্তোলন শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। তবে বিদ্যুৎকেন্দ্র পূর্ণ ক্ষমতায় চালাতে আগামীতে বড়পুকুরিয়ার কয়লার বাইরেও প্রতি মাসে ৮৬ হাজার টন কয়লা আমদানি করা হবে বলে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্রে জানা গেছে।
বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের তিনটি ইউনিট একসঙ্গে চালানো হলে প্রতিদিন পাঁচ হাজার টন কয়লার দরকার হয়। একটি ইউনিট সংস্কারের জন্য বন্ধ থাকায় বর্তমানে প্রতিদিন চার হাজার টন কয়লার প্রয়োজন হবে।
রোববার প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানিয়েছেন, জরুরি প্রয়োজন মেটাতে এক লাখ টন কয়লা আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সচিবালয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের সভাকক্ষে ঈদ পরবর্তী শুভেচ্ছা বিনিময় শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন। প্রতিমন্ত্রী বলেন, খনিতে যে কোনো সমস্যা হতে পারে। তাই আপদকালীন মজুদ হিসেবে এই কয়লা আনা হচ্ছে। কোন দেশ থেকে কয়লা আনা হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনও ঠিক হয়নি। আগ্রহী কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে প্রস্তাব চাওয়া হয়েছে। প্রস্তাব পাওয়ার পর সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত হলে জানা যাবে কোন দেশ থেকে কয়লা আসবে। সেপ্টেম্বর নাগাদ বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হবে। তবে পুরোপুরি চালু হতে অক্টোবর লেগে যাবে বলেও জানান তিনি।
জানা গেছে, সাম্প্রতিক কয়লা কেলেঙ্কারির ঘটনায় জ্বালানি সংকটে পড়ে বন্ধ রয়েছে দেশের একমাত্র কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বড়পুকুরিয়া। মজুদ উধাও হওয়ায় এবং খনির নতুন স্তর থেকে কয়লা উত্তোলনের প্রস্তুতির জন্য এই সংকট দেখা দিয়েছে। চলমান গ্রীষ্ম মৌসুমে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বন্ধ থাকায় রংপুর বিভাগে বিদ্যুতের ভোগান্তি বেড়েছে। কারণ ৫২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার কেন্দ্রটি এই অঞ্চলের বিদ্যুতের অন্যতম উৎস। তাই কয়লা আমদানির মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেয় সরকার। এ জন্য ১২ সদস্যের একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করেছে। এর ধারাবাহিকতায় গত ৭-১১ আগস্ট পর্যন্ত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগের একটি প্রতিনিধি দল সিঙ্গাপুরে অবস্থান করে ১৩টি বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে কয়লা সরবরাহের বিষয়ে আলোচনা করে। তারা দেশে ফিরে গত ১৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহীর সভাপতিত্বে এক বৈঠকে অংশ নেন। ওই সভায় বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্র দ্রুত চালু করতে দ্রুত এক লাখ টন কয়লা আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বৈঠকে জানানো হয়, বড়পুকুরিয়া খনির কয়লা উত্তোলন শুরু হলেও তা বিদ্যুৎকেন্দ্রের পুরো চাহিদা মেটাতে পারবে না। ঘাটতি মেটাতে বছরে অতিরিক্ত সাড়ে পাঁচ লাখ টন কয়লা আমদানি করতে হবে। অর্থাৎ প্রতি মাসে ৪৬ হাজার টন কয়লা আনতে হবে। কয়লা সরবরাহের জন্য সিঙ্গাপুরে প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেওয়া ১৩ কোম্পানিকে আরএফপি পাঠানো হয়েছে। এ কোম্পানিগুলো হলো ইন্দোনেশিয়ার গ্লেনকোর, সিঙ্গাপুরের ভিটল এশিয়া, ভারতের আদানি গ্লোবাল, সিঙ্গাপুরভিত্তিক আভানি রিসোর্স, ট্রাফিগুরা, কার্গোশিপ, গ্লোবালকোল, জেরা ট্রেডিং, বিএইচপি বিলিয়ন, ইন্দোনেশিয়ার পিটি সাকসেস ইনটান প্রতামা, কন্টিনেন্টাল প্ল্যাটফর্ম, গিব্রার এনার্জি ইন্দোনেশিয়া ও জিএমআর ইনফ্রাস্ট্রাকচার।
কয়লার উৎস: বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমদানি করা কয়লার গুণাগুণ বড়পুকুরিয়ার কয়লার মতো হতে হবে। প্রাথমিকভাবে বলা হচ্ছে তিন দেশ থেকে বাংলাদেশ কয়লা আমদানি করতে পারে। এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার কয়লা উন্নতমানের হলেও আমদানি ব্যয় বেশি। পরিবহন ব্যয় কম হলেও ইন্দোনেশিয়ার কয়লার ক্যালোরিফিক ভ্যালু (দহন দক্ষতা) কম ও আর্দ্রতা বেশি। দক্ষিণ আফ্রিকার কয়লা উন্নতমানের, সালফারের উপস্থিতি এক শতাংশের নিচে। কিন্তু আমদানি ব্যয় বেশি।
সম্ভাব্য পাঁচ রুট: কয়লা সমুদ্রপথে আনা হবে। এ জন্য চট্টগ্রাম, মোংলা অথবা ভারতের কোনো সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করা হবে। আমদানি করা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র পর্যন্ত পৌঁছাতে রেলপথ ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ জন্য সম্ভাব্য পাঁচ রুট হলো- চট্টগ্রাম থেকে বড়পুকুরিয়া, মোংলা থেকে যশোরের নওয়াপাড়া হয়ে বড়পুকুরিয়া, ভারতের গেদে বন্দর থেকে বাংলাদেশের দর্শনা হয়ে বড়পুকুরিয়া, ভারতের রাধিকাপুর হয়ে বাংলাদেশের বিরল দিয়ে বড়পুকুরিয়া এবং রহনপুর হয়ে বাংলাদেশের আমনুরা দিয়ে বড়পুকুরিয়া। এই রুটগুলোর রেললাইন, কয়লা পরিবহনের জন্য পর্যাপ্ত ওয়াগন ও ইঞ্জিন প্রস্তুত করার বিষয়ে রেলওয়েকে অনুরোধ করে চিঠি দিয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। কোন রুটে কয়লা আমদানি করা হবে তা আগ্রহী কোম্পানি চূড়ান্ত হওয়ার পর বলা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন পিডিবির এক কর্মকর্তা।
দাম কেমন হবে: দেশে কয়লাভিত্তিক আরও বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে। আগামী বছরই এক হাজার তিনশ’ মেগাওয়াটের পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসবে। এ ছাড়া রামপাল, মাতারবাড়ী, চট্টগ্রামের বাঁশখালীসহ বিভিন্ন জায়গায় আরও কয়েকটি বড় বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ চলছে। ২০২১ সালের মধ্যে কয়লাভিত্তিক পাঁচ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হওয়ার কথা রয়েছে। সরকারের পরিকল্পনা অনুসারে ২০৪০ সালের মধ্যে ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কয়লা দিয়ে উৎপাদন করা হবে। এসব বিদ্যুৎ প্রকল্প চলবে আমদানি করা কয়লা দিয়ে। আমদানি করা কয়লার দাম কেমন হতে পারে এর ওপর একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। তাতে বলা হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার কয়লা আনতে ২০২০ সালে টনপ্রতি খরচ হবে ১০৩ ডলার। যা ২০২৫ সালে ১২৫ ডলার, ২০৩০ সালে ১৪৭ ডলার এবং ২০৪০ সালে হবে ১৯০ দশমিক ৭০ ডলার। অন্যদিকে ইন্দোনেশিয়া থেকে চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত আনতে ২০২০ সালে টনপ্রতি সম্ভাব্য খরচ হতে পারে ৭৫ ডলার। ২০২৫ সালে এই দর ৯০ ডলার, ২০৩০ সালে ১০৫ ডলার এবং ২০৪০ সালে দাঁড়াবে ১৩৬ ডলার। বড়পুকুরিয়া থেকে প্রতিটন কয়লা কিনতে সর্বশেষ হিসাবে পিডিবির ব্যয় হয় টনপ্রতি ১৩০ ডলার।