Sunday, August 12th, 2018
গ্যাজপ্রম: অর্থ অপচয় কূপ নষ্ট, গ্যাস পেল না বাংলাদেশ
দেশের স্থলভাগে (অনশোরে) প্রায় ১৫টি কূপ খনন করেছে রাশিয়ার গ্যাজপ্রম এনার্জি। এসব কূপ খননে সরকারের ব্যয় হয়েছে সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। যদিও খননকৃত অধিকাংশ কূপই নষ্ট হয়ে গেছে। যেগুলো চালু আছে, সেগুলোতেও কাঙ্ক্ষিত গ্যাস উৎপাদন হচ্ছে না।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাজপ্রম অভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠান হলেও বাংলাদেশে এর নাম ব্যবহার করে তৃতীয় একটি পক্ষ কাজ করছে, অভিজ্ঞতা ও কারিগরি দিক থেকে যারা অনেক পিছিয়ে। এই তৃতীয় পক্ষই অধিক ব্যয়ে কূপ খননের সুবিধা নিচ্ছে।
জানা গেছে, ১৫টি কূপ খননে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রমের সঙ্গে ঠিকাদারি চুক্তি স্বাক্ষর করে পেট্রোবাংলা। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০-এর আওতায় এ চুক্তি করা হয়। প্রতিটি কূপ খননে ব্যয় হয় গড়ে ৯০০ কোটি টাকা।
যেকোনো প্রতিষ্ঠানের চেয়েই এ ব্যয় অনেক বেশি। ব্যয় বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৪ সালে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেডের (বিজিএফসিএল) চারটি কূপ খননে কাজ করে কানাডার সিনোপেক। এতে ব্যয় হয় বাংলাদেশী মুদ্রায় ৪৫০ কোটি টাকার মতো। এ হিসাবে কূপপ্রতি খরচ দাঁড়ায় ১১৫ কোটি টাকার কিছু বেশি। একইভাবে বাপেক্স কর্তৃক প্রতিটি কূপ খননে ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়নসহ ব্যয়ের পরিমাণ ৭০-৮০ কোটি টাকা। আর ভাড়া করা রিগের মাধ্যমে খনন করলে এ ব্যয় দাঁড়ায় ১০০-১১০ কোটি টাকা।
চুক্তি অনুযায়ী, গ্যাজপ্রম পেট্রোবাংলার আওতাধীন বিজিএফসিএলের তিতাস গ্যাসক্ষেত্রে চারটি, সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেডের (এসজিএফএল) রশিদপুর গ্যাসক্ষেত্রে একটি উন্নয়ন কূপ, বাপেক্সের সেমুতাং ক্ষেত্রে একটি, শাহবাজপুরে দুটি, শ্রীকাইলে একটি ও বেগমগঞ্জে একটি কূপ খনন করে। এর মধ্যে ২০১৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া তিতাস গ্যাসক্ষেত্রের ২১ নম্বর কূপে। কূপটি থেকে সে সময় দেড় কোটি ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হয়। কিন্তু পরের বছরই ২০১৪ সালের জুনের শুরুতে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। তিতাসের ২০ নম্বর কূপটির খননের স্থান ঠিক না হওয়ায় পানি চলে আসে সেটিতেও। তিতাসের এ দুটি কূপই কেবল নয়, বাংলাদেশে কাজ শুরুর পর গ্যাজপ্রম প্রথম যে ১০টি কূপ খনন করে, তার পাঁচটিই নষ্ট হয়ে যায়।
জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান আবুল মনসুর মো. ফয়েজউল্লাহ বণিক বার্তাকে বলেন, গ্যাজপ্রম আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। তাদের এক্ষেত্রে কাজ করার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে। তবে গ্যাসের কূপ মানেই অনিশ্চয়তা। এদিক থেকে আমরা তাদের দোষারোপ করতে পারি না। আর কোন কূপ খনন করতে হবে, সেটা আমরাই নির্ধারণ করে দিই। বাপেক্সের সে ধরনের জনবল ও সামর্থ্য থাকলে বাইরের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া হতো না।
ব্যর্থতার পরও ২০১৫ সালের জুনে গ্যাজপ্রমকে নতুন করে আরো পাঁচটি কূপ খননের কাজ দেয় জ্বালানি বিভাগ। শ্রীকাইল-৪, বাখরাবাদ-১০, রশিদপুর-৯, ১০ ও ১২ কূপগুলো খননে ব্যয় হয় ৭৫০ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে রশিদপুর-৯ নম্বর কূপ খননে শুধু গ্যাস উন্নয়ন তহবিল থেকেই ব্যয় করতে হয়েছে ১৯৮ কোটি টাকা।
জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, এসজিএফএলের আওতাধীন রশিদপুর-৯ নম্বর কূপ থেকে দৈনিক এক কোটি ঘনফুট গ্যাস উত্তোলনের আশ্বাস দেয় গ্যাজপ্রম। এজন্য খনির গভীরে ৩ হাজার ৪০০ থেকে ৩ হাজার ৫০০ মিটার পর্যন্ত খননের বিষয়ে চুক্তি হয়। কিন্তু ৩ হাজার ৩০৯ মিটার খননের পর কাজ সমাপ্ত ঘোষণা করে গ্যাজপ্রম। নির্ধারিত গভীরতায় কূপ খননে ব্যর্থ হলেও পুরো অর্থই তুলে নেয় রুশ প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে কূপটি অকেজো অবস্থায় রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এসজিএফএলের ব্যবস্থাপক ও রশিদপুর-৯ নম্বর কূপ খনন প্রকল্পের পরিচালক মো. রায়হানুল আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ৩ হাজার ৩০৯ মিটার খননের পর ভূমির গঠনগত কারণে গ্যাজপ্রম খননকাজ চালাতে অসম্মতি প্রকাশ করে। অনেক চাপ প্রয়োগ করেও এর বেশি খনন করতে আর রাজি হয়নি তারা। কিন্তু টার্ন কি বেসিসে চুক্তির কারণে পুরো অর্থই গ্যাজপ্রমকে পরিশোধ করতে হয়েছে।
এদিকে গ্যাজপ্রমের খননকৃত প্রথম পাঁচটি কূপের সবগুলোই ওয়ার্কওভার করতে হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাপেক্সকে। পরবর্তীতে ওয়ার্কওভার করতে হয়েছে ভোলাসহ আরো কয়েকটি কূপও। ওয়ার্কওভার করলেও এসব কূপ থেকে গ্যাস মিলছে সামান্য।
শ্রীকাইল গ্যাসকূপ থেকে দৈনিক গ্যাস উত্তোলন হওয়ার কথা ৪০ মিলিয়ন ঘনফুট। অথচ উত্তোলন হচ্ছে ৩০ মিলিয়ন ঘনফুটের কম। একই অবস্থা সুমেতাং, রশিদপুর ও তিতাস গ্যাসক্ষেত্রের। কোনো গ্যাসক্ষেত্রই সক্ষমতা অনুযায়ী গ্যাস উত্তোলন করতে পারছে না। অথচ শেভরন তাদের কূপ থেকে সক্ষমতার চেয়ে বেশি গ্যাস উত্তোলন করছে। এসবের মধ্যে গ্যাস অনুসন্ধানে ব্যর্থতার নজির সৃষ্টি হচ্ছে বলে জানান জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, গ্যাস খাতের অগ্রগতি দেখাতে কূপ খননের সংখ্যা বাড়ানোর লক্ষ্য রয়েছে। ফলে পেট্রোবাংলার দেখিয়ে দেয়া কূপে খননকাজ পরিচালনা করতে নিয়োগ করা হচ্ছে গ্যাজপ্রমকে। ফলে কূপের সার্বিক পরিস্থিতি ও তথ্য-উপাত্ত না জেনেই খনন শুরু করছে গ্যাজপ্রম।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, তাদের পিএসসির আওতায় চুক্তি করে অনুসন্ধানে নিয়োগ করা যেতে পারে। ড্রিলিং কাজে নিয়োজিত করা বোকামি। গ্যাজপ্রমকে যদি যথাযথভাবে ব্যবহার করতে হয়, তাহলে অনুসন্ধানে ব্যবহার করতে হবে; খননে নয়।