?> বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় এর মাননীয় উপদেষ্টা বরাবর উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে কয়লা খনি উন্নয়ন প্রকল্প বিষয়ে স্মারকলিপি « NCBD – National Committee of Bangladesh

Tuesday, February 13th, 2007

বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় এর মাননীয় উপদেষ্টা বরাবর উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে কয়লা খনি উন্নয়ন প্রকল্প বিষয়ে স্মারকলিপি

[বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় এর মাননীয় উপদেষ্টা বরাবর ১৩.০২.০৭ ইং তারিখে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে কয়লা খনি উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক প্রদত্ত ছাড়পত্র নবায়ন না করা এবং ছাড়পত্র প্রদানের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তি প্রদান বিষয়ক যে পত্রটি প্রেরণ করে তা এখানে হুবহু তুলে ধরা হলো।]

মাননীয় উপদেষ্টা

বন ও পরিবেশ মন্ত্রনালয়, তত্বাবধায়ক সরকার

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।

বিষয়: উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে ফুলবাড়ী কয়লাখনি উন্নয়ন প্রকল্পের পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক প্রদত্ত ছাড়পত্র নবায়ন না করা এবং উক্ত ছাড়পত্র প্রদানের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিতকরণ ও শাস্তি প্রসঙ্গে।

জনাব,

এশিয়া এনার্জি ফুলবাড়ী কয়লাখনি উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য জ্বালানী মন্ত্রণালয়ে দাখিল করে এবং পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক ১১.৯.২০০৫ ইং তারিখে ১ বছরের জন্য ইস্যুকৃত সাময়িক ছাড়পত্র (সংযুক্তি-১) সেই সময়ে জমা দেয়। সরকার উক্ত পরিকল্পনা প্রস্তাব মূল্যায়নের জন্য ১২ সদস্যের একটি কারিগরি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে। কমিটি ২৪.৯.২০০৬ ইং তারিখে তাদের মূল্যায়ন প্রতিবেদন সরকারের নিকট পেশ করে। কমিটি তাদের মূল্যায়ন প্রতিবেদনে ফুলবাড়ী কয়লাখনি উন্নয়নের জন্য সরকারের সঙ্গে মাত্র ৬% রয়্যালটির বিনিময়ে ৫৭২ মিলিয়ন টন কয়লা রপ্তানির উদ্দেশ্যে এশিয়া এনার্জিকে দিয়ে দেয়ার জন্য সম্পাদিত চুক্তি বেআইনি এবং দেশের স্বার্থবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সেই সঙ্গে উক্ত ছাড়পত্র প্রদানের ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তর উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে খনি উন্নয়ন হলে পরিবেশের ক্ষতির সম্ভাব্যতা এবং সম্ভাব্য ক্ষতির মাত্রা অনুধাবন করেনি বিধায় ছাড়পত্র নবায়নের ক্ষেত্রে উক্ত ছাড়পত্র যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা উচিত বলে সুস্পষ্ট অভিমত দিয়েছে।

কমিটি এশিয়া এনার্জির দাখিলকৃত ইআইএ রিপোর্ট পর্যালোচনা করে এই মর্মে অভিমত দিয়েছে যে, ছাড়পত্র প্রদানের ক্ষেত্রে ফুলবাড়ীর স্থানীয় জনসাধারণের মতামত যথাযথভাবে যাচাই করা হয়েছে কিনা তাতে সন্দেহ রয়েছে। তাছাড়া উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে খনি খননে সেখানকার জনগণের সম্মতি রয়েছে; এশিয়া এনার্জি যে পাবলিক কনসালটেশন এর ভিত্তিতে এ দাবী করেছে তা কতটুকু যথাযথ, তা গভীরভাবে খতিয়ে দেখার জন্য কমিটি বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করেছে।

এ প্রসঙ্গে উলে¬খ্য যে, ফুলবাড়ীর জনগণ দীর্ঘদিন ধরে কয়লা রপ্তানি এবং উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে কয়লাখনি উন্নয়নের প্রতিবাদে বিভিন্ন কমসূচী পালন করে। পরিশেষে ২৬.০৮.২০০৬ ইং তারিখে ফুলবাড়ী শহরে সেখানকার হাজার হাজার মানুষ এশিয়া এনার্জির অফিস ঘেরাও কর্মসূচী শান্তিপূর্ণভাবে সমাপনান্তে পুলিশের গুলিতে তিনজন নিরীহ মানুষ প্রাণ হারান এবং আহত হন শতাধিক। ফলে আন্দোলন ভয়াবহ আকার ধারণ করে। পরিশেষে ৩০.০৮.২০০৬ তারিখে দেশের মানুষ, অর্থনীতি ও পরিবেশের জন্য ধংসাত্মক এশিয়া এনার্জির চুক্তি বাতিল এবং উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে কয়লা খনি খনন না করার মর্মে ফুলবাড়ীর ৮ লাখ জনগণের সাথে সরকার এক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। সুতরাং এতে প্রমাণিত হয় যে, যে পাবলিক কনসালটেশনের ভিত্তিতে এশিয়া এনার্জি দাবী করেছে যে, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে ফুলবাড়ী কয়লা খনি উন্নয়ন প্রকল্পে জনগণের সম্মতি রয়েছে, তা আদৌ সত্য নয় এবং এই প্রকল্পের ছাড়পত্র প্রদানের ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তর কোনভাবেই জনগণের মতামত যাচাই করে দেখেনি।

কমিটি তার সুপারিশে বলেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যায় উন্নত দেশে পরিবেশ সংরক্ষণ সংস্থা এবং কর্তৃপক্ষ পরিবেশ সংরক্ষণ ও তদারকির জন্য কঠোর আইন ও প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে কয়লা খনি খননের ফলে উদ্ভুত এসিড মাইন ড্রেনেজ ম্যাটারিয়াল ও অন্যান্য পরিবেশগত সমস্যা রোধ করতে পারেনি। সেখানকার হাজার হাজার মাইল নদী পথ এই কারণে দূষিত হয়েছে। এতদপ্রেক্ষিতে কমিটি আরো বলেছে, পরিবেশ বান্ধব কয়লা খাত উন্নয়নের লক্ষ্যে কয়লা অনুসন্ধান, খনন, উৎপাদন, মজুদকরণ, পরিবহণ ও ভূমি পুনরুদ্ধার সম্পর্কিত বিদ্যমান আইনসমূহ মূল্যায়ন এবং পরিবেশ সংরক্ষণ আইন সংশোধন ও প্রয়োজনে নতুন আইন সংযোজন করা ব্যাতিত উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে কয়লা উৎপাদনের সিদ্ধান্ত বাস্তবসম্মত নয়।

এশিয়া এনার্জির সঙ্গে চুক্তি সুস্পষ্টভাবে জাতীয় স্বার্থ বিরোধী কারণ তৎকালীন আইনে রয়্যালটির পরিমাণ ছিল ২০%।

এই আইন অনুযায়ী ১০ জুলাই, ১৯৯৪ তারিখে দিনাজপুর জেলার ৫৯ নং মৌজায় কয়লাখনি উন্নয়নের জন্য ২০% রয়্যালটির ভিত্তিতে সরকার পেট্রোবাংলার সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়। অথচ ২০ অক্টোবর, ১৯৯৪ তারিখে একই ২০% রয়্যালটি বলবৎ থাকা সত্ত্বেও মাত্র ৬% রয়্যলিটির ভিত্তিতে সরকার এশিয়া এনার্জির সঙ্গে এই চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে।

তাছাড়া কমিটি এও বলেছে, ৩৫ বছর খনি খননকালে কয়লা উৎপাদনের জন্য খনি শুষ্ক রাখতে এবং পাম্পের দ্বারা ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের যে পরিকল্পনা করা হয়েছে, তাতে ২১৪ বর্গকিলোমিটার এলাকা মরুকরণ এবং সেখানে বসবাসরত ২ লাখ ৪০ হাজার অধিবাসী কী ভয়াবহ বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে এবং দীর্ঘ মেয়াদে ভূ-গর্ভস্থ জলাধার কি ধরণের ভয়াবহ অবস্থার শিকার হবে তা অনুধাবন করার মতো অভিজ্ঞতা এশিয়া এনার্জির কোন কনসালটেন্ট/বিশেষজ্ঞের নেই।

কমিটি উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে ফুলবাড়ীতে কয়লা উৎপাদন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলে অভিহিত করেছে। কারণ সেখানকার জনবসতি পৃথিবীর যে কোন স্থানের তুলনায় খুবই ঘনত্বপূর্ণ। অর্থাৎ প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১০৭৯ জনেরও বেশী। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ায় ৩ জন, যুক্তরাষ্ট্রে ৩২ জন, ইন্দোনেশিয়ায় ১২০ জন, চীনে ৩৯ জন, জার্মানিতে ১৩৭ জন। এমনকি ভারতে ৩৬৩ জন। খনি এলাকার জমি খুবই উর্বর এবং তিন ফসলী। খনির কাজে পর্যায়ক্রমে মোট ৬,৬৮৮.০০ হেক্টর অর্থাৎ ৬৬.৮৮ বর্গ কিলোমিটার আবাদযোগ্য কৃষি জমি ব্যবহৃত হবে। ফলে কৃষি উৎপাদন ব্যহত হবে ও তাছাড়াও ৪০ থেকে ৫০ হাজার লোককে সরিয়ে নিতে হবে। কিন্তু তাদের পুনর্বাসনের জন্য আবাদযোগ্য জমি পাওয়া যাবে না এবং এসব মানুষের অধিকাংশই কৃষি থেকে চিরতরে নির্বাসিত হয়ে ছিন্নমূল ভাসমান মানুষে পরিণত হবে। অন্যদিকে খনির ফলে প্রত্যক্ষভাবে ১,৩৬০ জন লোকের কর্মসংস্থান হবে। কিন্তু এ চাকুরীগুলির অধিকাংশই উচ্চ প্রযুক্তি নির্ভর হওয়ায় স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের এই চাকুরী প্রাপ্তির সম্ভাবনা খুবই কম।

তাছাড়াও খনন কাজে উৎপাদিত পরিবেশ দূষণকারী এসিড মাইন ড্রেনেজ ম্যাটারিয়াল হতে পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য তা মাটি চাপা দিয়ে ঢেকে রাখার যে পরিকল্পনা এশিয়া এনার্জি প্রস্তাব করেছে তা গ্রহণযোগ্য নয় বলে কমিটি অভিহিত করেছে। কমিটি এ প্রসঙ্গে বলেছে যে, খনি উন্নয়নের খরচ কমানোর লক্ষ্যে খনি থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে উত্তোলিত দূষণ এসিড মাইন ড্রেনেজ ম্যাটারিয়াল খনির পাশে লম্বালম্বিভাবে খনি খননের মাটি দিয়ে মাটি চাপা দেওয়ার জন্য ২০ বর্গ কি.মি. এলাকাজুড়ে ১২০ মিটার অর্থাৎ ৩৯৪ ফুট উঁচু একটি মাটির টিলা সৃষ্টির প্রস্তাব করা হয়েছে। এই মাটি খনির গর্ত ভরাটের কাজে না লাগার ফলে ৬৯৬ হেক্টর জমি জমির একটি জলাধারের প্রস্তাব রয়েছে। সুতরাং সব মিলিয়ে ২৭ বর্গ কি.মি আবাদযোগ্য কৃষি জমি চিরতরে ধংস হয়ে যাবে। স্থানচ্যুত হবে রেল লাইন, মহাসড়ক ও ফুলবাড়ী শহর। কমিটি তা গ্রহণযোগ্য মনে করেনি।

এর প্রেক্ষিতে আমরা মনে করি কমিটি উপরে উলে¬খিত বিষয়াদি বিবেচনান্তে উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে ফুলবাড়ীতে কয়লা উৎপাদন গ্রহণযোগ্য নয় মর্মে অভিহিত করেছে, এই সব বিষয়াদি পরিবেশ অধিদপ্তর বিবেচনা ছাড়াই উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে ফুলবাড়ী কয়লা উৎপাদনের ছাড়পত্র দিয়ে অমার্জনীয় এবং বিচারযোগ্য অপরাধ করেছে। ফলশ্র“তিতে সেখানকার ৩ জন মানুষ প্রাণ দিয়েছেন এবং শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন।

অতএব উল্ল্যেখিত অবস্থাধীনে ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্পের ছাড়পত্র নবায়ন না করার জন্য এবং ১১.০৯.২০০৫ তারিখে পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক ইস্যুকৃত ছাড়পত্র প্রদানের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে দেশের প্রচলিত আইনে শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা করতে বিশেষ অনুরোধ জানানো হল।