Monday, August 29th, 2016
প্রধানমন্ত্রীর সাংবাদিক সম্মেলনের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় কমিটির বক্তব্য
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
শুভেচ্ছা নেবেন।
গত ২৭ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিষয়ে বিস্তারিত বক্তব্য রেখেছেন। তিনি এই কেন্দ্র সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি করবে না দাবি করে বেশ কিছু তথ্য উপাত্ত দিয়েছেন। এছাড়া সুন্দরবন রক্ষা আন্দোলন নিয়েও কিছু বক্তব্য রেখেছেন। এর আগে বিএনপি নেত্রী এ বিষয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন। এসব বিষয়ে জাতীয় কমিটির বক্তব্য উপস্থাপনের জন্যই আমরা আজকের এই সাংবাদিক সম্মেলন আহবান করেছি। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কয়েকটি যুক্তি তথ্য পরীক্ষা করবো এবং সেই সাথে সঠিক তথ্য ও আমাদের বক্তব্য পেশ করবো।
প্রধানমন্ত্রীর দাবি: “গ্যাসের মজুদ দ্রুত হ্রাস পাওয়ায় অদুর ভবিষ্যতে বিদ্যুৎকেন্দ্রে আর গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হবেনা।“
সঠিক তথ্য ও আমাদের বক্তব্য: এই মুহূর্তে বাংলাদেশে উত্তোলনযোগ্য ১২ বছরের নিশ্চিত রিজার্ভ ১৪ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আছে। এই মুহূর্তে দেশের ৬৩ ভাগ অর্থাৎ ৫০৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ গ্যাস দিয়ে উৎপাদিত হচ্ছে। নবায়ন সহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিলে প্রায় ১৫০০ মেগাওয়াটের বাড়তি উৎপাদন এখনই করা সম্ভব। যারা একসময়ে চিৎকার করেছে বাংলাদেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে তারাই আজকে গ্যাস সংকট জিইয়ে রেখে তার অজুহাতে দেশবিধ্বংসী বিভিন্ন প্রকল্পকে জায়েজ করবার চেষ্টা করছে। সেসময় জনপ্রতিরোধের মাধ্যমে আমরা গ্যাস রফতানির চক্রান্ত মোকাবিলা করতে পেরেছি বলেই আজ দেশে বিদ্যুৎ, শিল্প কারখানা চলছে।
বঙ্গোপসাগরে বিশাল গ্যাস মজুদের সম্ভাবনা। আমাদের প্রস্তাব না মেনে কনকো ফিলিপস-এর সাথে চুক্তি করায় গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে দেশ পিছিয়ে গেছে। নইলে এতোদিনে আরও বৃহৎ গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন সম্ভব হতো। সরকার এখন বিনা দরপত্রে ‘পারস্পরিক বোঝাপড়া’র ভিত্তিতে সমুদ্রের গ্যাসব্লকগুলো এমনভাবে বিদেশি কোম্পানিকে দেবার পরিকল্পনা করছে যাতে গ্যাসের দাম আমদানি করা গ্যাসের চাইতেও বেশি পড়বে। বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানির মধ্যে ভাগবাটোয়ারা না করে আমাদের প্রস্তাব অনুযাযী অগ্রসর হলে কয়েক দশকের বিদ্যুৎ চাহিদা কমদামে পরিবেশ বান্ধবউপায়ে পূরণ করা এখান থেকেই সম্ভব হতো। এটা করলে সুন্দরবন ধ্বংস, রূপপুর মহাবিপদ বা বাঁশখালী হত্যাকান্ড কোনোটিরই দরকার হতো না। কুইক রেন্টালের দুষ্টচক্রেও অর্থনীতিকে ফেলতে হতো না। গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হতো না।এই পরিস্থিতির জন্য অতএব সরকারের ভুলনীতি ও দুর্নীতিই দায়ী। এখনও সঠিক নীতি ও ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এসব ফাঁদ থেকে বের হওয়া সম্ভব।
প্রধানমন্ত্রীর দাবি: আলট্রা-সুপারক্রিটিক্যাল পাওয়ার প্ল্যান্ট বসানো হবে। সবচেয়ে গুনগত মান সম্পন্ন কয়লা ব্যবহার করা হবে। ইএসপি থাকবে যা উদগিরনকৃত ৯৯.৯৯ ভাগ ফ্লাই অ্যাশ ধরে রাখতে সক্ষম। এফজিডি দিয়ে ৯৬ ভাগ সালফার গ্যাস শোষিত হবে। ২৭৫ মিটার চিমনি দিয়ে যে কার্বনডাইঅক্সাইড গ্যাস নির্গত হবে তা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১.৬ কিলোমিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। অন্যান্য গ্যাসের ঘনত্ব বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার স্বীকৃত মাত্রার চেয়ে কম থাকবে।”
সঠিক তথ্য ও আমাদের বক্তব্য: আলট্রা-সুপারক্রিটিক্যাল পাওয়ার প্ল্যান্ট বসানো হলেও এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বছরে ৭৭ লাখ টন কার্বনডাইঅক্সাইড নির্গত হবে। ইএসপির দক্ষতা ৯০% হলেও, যখন উন্নতমানের কয়লা ব্যবহার করা হয় তখন এর দক্ষতা অনেক কমে যায়। ফলে দৃশ্যমান দূষণ কমলেও অদৃশ্য দূষণ অর্থাৎ যেসব পার্টিক্যালের আকৃতি ২.৫ মাইক্রন বা এর চেয়ে ছোট সেসবের দূষণ বেড়ে যায়। এফজিডি দিয়ে সালফার গ্যাসের নির্গমন কমানোর পরও এখান থেকে বছরে ১৫ হাজার ৪শত টন সালফার গ্যাস নির্গত হবে। ২৭৫ ফুট চিমনি দিয়ে নির্গমনের ব্যবস্থা থাকলেও এসব ক্ষতিকর গ্যাস এবং অদৃশ্য পার্টিক্যাল বিলীন হতে ৪৫০ থেকে ৫০০ কিলোমিটার দূরত্ব পার হতে হবে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের আশেপাশের তাপমাত্রা এখানকার কার্বনডাইঅক্সাইড নির্গমনের কারনে বেশ খানিকটা বেড়ে যাবে, যার প্রভাবে সরকারী ভাষ্য মতে ১৪ কিলোমিটার দূরের সুন্দরবনও গরম হয়ে যাবে এবং নির্গত কার্বনডাইঅক্সাইড ১.৬ কিলোমিটারের মধ্যে আটকে রাখা অসম্ভব এবং অবাস্তব।
কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুষণ বিষয়টা এরকম যে কোন টেকনোলজি ব্যবহার করেই সেই দূষণ শতভাগ দূর করা যায় না। উদাহরণ স্বরূপ এফজিডির কথাই ধারা যাক। এফজিডি ব্যবহারে করে বিপুল অর্থ ব্যয়ের মাধ্যমে বাতাস থেকে সালফার অনেকখানি অপসারণ করা সম্ভব হলেও তার ফলে পানি দূষণ বেড়ে যায়। এফজিডি বা স্ক্রাবার ব্যবহারের বিপদ হলো-কয়লা ও লাইমস্টোন থেকে ’এফজিডি ওয়েস্ট ওয়াটার’এ চলে আসা দ্রবীভূত কঠিন পদার্থ (ক্লোরাইড, সালফেট, বাইকার্বনেট), ভাসমান কঠিন পদার্থ (জিপসাম, ফ্লাই অ্যাশ), অ্যামোনিয়া, বিষাক্ত ভারী ধাতু যেমন আর্সেনিক, মার্কারি, সেলেনিয়াম, বোরন ইত্যাদি। ব্যবহৃত কয়লা ও লাইমস্টোনের ধরন অনুযায়ী এসবের মাত্রা বিভিন্ন রকম হয় বলে এসব পরিশোধণের কোন একক পদ্ধতি নেই, উপরন্তু এগুলো পরিশোধন করা দুরূহ ও ব্যয়সাপেক্ষ। বায়ু দূষণমুক্ত করার জন্য স্ক্রাবার ব্যবহার করা হবে জেনে ২০০৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভিনিয়ার হ্যাটফিল্ড’স ফেরী (Hatfield’s Ferry) কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের দূষণের ভুক্তভোগীরা খুশীই হয়েছিলেন। কিন্তু পরে দেখা গেলো স্ক্রাবার ব্যবহার করার ফলে বাতাস কিছুটা দূষণ মুক্ত হচ্ছে, কিন্তু তার বদলে দূষিত হচ্ছে পানি! এ প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট বিপুল পরিমাণ তরল বর্জ্য ফেলা হচ্ছে পার্শ্ববর্তী মননগাহেলা (Monongahela) নদীতে, যে নদী ৩ লক্ষ ৫০ হাজার মানুষের খাওয়ার পানির যোগান দেয়। সেখানে ২৪ কিমি দূরে বসবাসকারি মানুষও তাই বলেন, ’মনে হচ্ছে তারা আমাদেরকে নি:শ্বাসের মাধ্যমে বিষ গ্রহণ থেকে মুক্তি দিয়েছে, বিনিমিয়ে আমাদেরকে সেই বিষ পানির সাথে পান করতে হচ্ছে।”
প্রধানমন্ত্রীর দাবি: ”বায়ু প্রবাহ সুন্দরবনের বিপরীত দিকে, সুন্দরবনের উল্টো দিকে প্রবাহিত হবে।”
সঠিক তথ্য ও আমাদের বক্তব্য: সরকারি নির্দেশ দিয়ে বায়ুপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা যায় না বলে বছরে অন্তত চারমাস বাতাস বিদ্যুৎকেন্দ্র এলাকা থেকে সুন্দরবনের দিকে প্রবাহিত হয়। সরকারি ইআইএ রিপোর্টেই স্বীকার করা হয়েছে, নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি বছরের এই ৪ মাস বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বাতাস সুন্দরবনের দিকে প্রবাহিত হবে। (সূত্র: রামপাল ইআইএ পৃষ্ঠা- ২৮৪)
গরমের মৌসুমে আমাদের দেশের বাতাস ঠিক সুন্দরবনের দিক থেকে উত্তর অর্থাৎ ঢাকার দিকে প্রবাহিত হয়, শীতের মৌসুমে ঢাকার দিক থেকে সুন্দরবনের দিকে প্রবাহিত হয়। ফলে এই কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারনে যে পরিমাণ ক্ষতিকারক বায়বীয় পদার্থ নিঃসরিত হবে সেটা গরমের মৌসুমে ছোট্ট দেশের বাকি বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষকে এবং শীতের মৌসুমে সুন্দরবনকে দুষিত করবে।
সুন্দরবনের পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য এই চার মাসই যথেষ্ট। তাছাড়া ঘূর্ণি বাতাস ঝড় ইত্যাদি নানা কারণেই এই চারমাস ছাড়াও বছরের অন্য সময়েও বাতাস সুন্দরবনের দিকে প্রবাহিত হতে পারে। আরেকটি বিষয় হলো, কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দূষণ শুধু বায়ুবাহিত নয়, কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পানিদূষণ, শব্দদূষণ, ছাইয়ের দূষণ, কয়লা পরিবহণের কারণে দূষণ সারা বছর ধরেই ঘটবে যার সঙ্গে বাতাসের দিকের কোনো সম্পর্ক নেই।
প্রধানমন্ত্রীর দাবি: ”দূষিত বা গরম পানি পশুর নদীতে ফেলা হবে না।”
সঠিক তথ্য ও আমাদের বক্তব্য: পশুর নদীতে যে স্বাভাবিকের চেয়ে ২ ডিগ্রী বেশি গরম পানি ফেলা হবে সেটা খোদ কোম্পানিরই স্বীকার করা তথ্য। প্রকৃত পক্ষে আরো বেশি গরম পানি ফেলার আশংকা রয়েছে কারণ কয়লা বিদ্যুতকেন্দ্র বিষয়ে জাইকার একটি রিপোর্টে থার্মাল ইফ্লুয়েন্ট নির্গমনের ফলে পানির তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত বৃদ্ধি এবং এর ফলে মাছের ক্ষতি হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
আর ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের মাধ্যমে দূষিত পানি পরিশোধন করে নদীতে নির্গমনের কথা বলা হলেও কার্যকারিতা নিয়ে আশংকা রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৭২ টি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে ১৮৮টি থেকে নদীতে পানি নির্গমনের বেলায় আর্সেনিক, বোরন, কেডমিয়াম, সীসা, পারদ এবং সেলিনিয়ামের কোন সীমা বা মাত্রা মেনে চলা হয় না। নিউইয়র্ক টাইমসের রিপোর্ট থেকেও দেখা যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামা, কেনটাকি, নর্থ ক্যারোলিনা, ওহাইও সহ ১০টি রাজ্যের ২১টি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নদী ও জলাভূমিতে ফেডারেল ড্রিংকিং স্ট্র্যান্ডার্ডের চেয়ে ১৮গুণ বেশি আর্সেনিক সম্পন্ন পানি নির্গত করেছে।
আর ঢাকার নদীগুলোতে প্রতিদিন ৯০ হাজার ঘনমিটার তরল বর্জ্য কোন ধরণের পরিশোধন ছাড়াই ডিসচার্জ করা হয়। ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট থাকলেও সেগুলো ব্যবহার করা হয় না, কারণ প্রতিঘনমিটার তরল বর্জ্য পরিশোধন করতে ৩০ টাকা করে লাগে!এইরকম একটা অবস্থায় কিভাবে ভরসা রাখা যেতে পারে যে, ঢাকা থেকে বহু দূরে সুন্দরবনের প্রান্তে, আরও বহুগুণ বেশি টাকা খরচ করে ঠিকঠাক মতো পানি পরিশোধন করে নদীতে ফেলা হবে?
প্রধানমন্ত্রীর দাবি: (বনাঞ্চলের ২৫ কিমি এর মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন না করা বিষয়ে ভারতের গাইড লাইন প্রসঙ্গে) ”ভারতের মতো বিশাল দেশের সাথে তুলনা করা আমাদের খাটে না”।
সঠিক তথ্য ও আমাদের বক্তব্য: ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি ও বনাঞ্চল-নদী-কৃষি-জীবন-জীবিকা ইত্যাদি জালের মতো পরস্পরের ওতপ্রোত ভাবে জড়িত থাকার কারণে এখানে বরং ক্ষতি আরো বেশি হওয়ার কথা, সেই কারণে ভারত থেকে বাংলাদেশে এসব প্রকল্পের বিষয়ে আরো বেশি সাবধান হওয়া দরকার। ভারতে ২৫ কিমি সীমার মধ্যে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র যদি নিরাপদ না হয় তাহলে বাংলাদেশ ছোট দেশ হওয়ার কারণে সেই কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র আরও অনিরাপদ হবে।
প্রধানমন্ত্রীর দাবি: “কয়লা পরিবহনের বেলায় শব্দ আলো দূষণ সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখা হবে, কাভার্ড বার্জে করে কয়লা পরিবহন করা হবে।”
সঠিক তথ্য ও আমাদের বক্তব্য: রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লার জাহাজ চলাচলের ফলে সুন্দরবনের যে বিপদ সম্পর্কে আমরা এতদিন ধরে বলে আসছি, খোদ কোল ট্রান্সপোর্ট ইআইএ রিপোর্টেও তার অনেকগুলোই আছে। যেমন- জাহাজ থেকে কয়লার গুড়ো ও ধুলা ছড়ানো, জাহাজ ডুবে তেল ও কয়লা ছড়ানো, কয়লার জাহাজ থেকে বর্জ্য নি:সরণ, আলো দূষণ, জাহাজ রুটের মধ্যে থাকা ডলফিন অভয়ারণ্য সহ বিপন্ন প্রায় বণ্য প্রাণী আরো বিপন্ন হওয়া ইত্যাদি। কিন্তু ইআইএ রিপোর্টে এইসব ক্ষতি ও ঝু কি মোকাবেলার জন্য দায়সারা ভাবে আইএমও কনভেনশন মেনে চলার কথা বলা হয়েছে, কয়লার জাহাজ ধীরে চালানোর কথা বলা হয়েছে, অপ্রয়োজনীয় সিটি না বাজানোর কথা বলা হয়েছে, জাহাজের বর্জ্য যত্রতত্র না ফেলার কথা বলা হয়েছে, কয়লার স্বপ্রজ্জ্বলন এড়ানোর জন্য অগ্নি প্রতিরোধক পিচ্ছিলকারক ব্যবহারের সুপারিশ করা হয়েছেৃ যেগুলোর ব্যবহার ও বাস্তবায়ন ভীষণ অনিশ্চিত।সবচেয়ে বড় কথা এগুলো বাস্তবায়িত হলেও সুন্দরবনের বিপদ কমবেনা কারণ- জাহাজ চলাচল করলে দুর্ঘটনা ও দূষণের ঝুকি থাকবেই, জাহাজ চলাচল রুটের ডলফিন অভয়ারণ্য ক্ষতিগ্রস্থ হবেই, জাহাজের ঢেউ, শব্দ, আলো ইত্যাদির মাধ্যমে জীববৈচিত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবেই।
প্রধানমন্ত্রীর দাবি: ”বিদ্যুৎকেন্দ্রের শব্দ ১৪ কিমি দূরে যাবে কিভাবে?”
সঠিক তথ্য ও আমাদের বক্তব্য: বিদ্যুৎকেন্দ্রের শব্দ ১৪ কিমি দূরে সুন্দরবনের মধ্যে যাবে না কিন্তু বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের মধ্যে দিয়ে জাহজে করে যে কয়লা পরিবহন করা হবে, কয়লা লোড আনলোড করা হবে, ড্রেজিং করা হবে তার ফলে সুন্দরবনের মধ্যে শব্দ দূষণ ঘটবে।
প্রধানমন্ত্রীর দাবি: “বিদ্যুতের দাম ৮ টাকা সঠিক তথ্য নয়।”
সঠিক তথ্য ও আমাদের বক্তব্য: এটি সরকারি রিপোর্টে বর্ণিত তথ্য। এফজিডির মতো ব্যয়বহুল টেকনোলজি ব্যবহার করলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম আরো অনেক বেশি বাড়বে। দেখুন: the cost of electricity production has been estimated as BDT. 8.49 per kwh for first full year and BDT. 8.04 per kwh for levelised cost of energy. (সূত্র: রামপাল ইআইএ পৃষ্ঠা-৪১৩)
সস্তায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা বলে সুন্দরবনকে ঝুকিতে ফেলে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে, তাতে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ ভর্তুকী লাগবে। Institute of Energy Economics & Financial Analysis এর হিসেব অনুসারে ভর্তুকী না দিলে ইউনিট প্রতি খরচ পড়বে ৯.৫৪ টাকা! আর যেসব প্রযুক্তি ব্যবহারের কথা বলা হচ্ছে তার ব্যবহার করলে এই দাম কয়গুণ বাড়বে তা বলা কঠিন।
প্রধানমন্ত্রীর দাবি: ”বিদ্যুৎকেন্দ্রের ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। সেখানকার মানুষের বর্তমান পেশা সুন্দরবন থেকে চুরি করে গাছ কাটা, গাছ কাটতে গিয়ে বাঘের পেটে যাওয়া”।
সঠিক তথ্য ও আমাদের বক্তব্য: এটা সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য নিদারুণ অপমানজনক এবং অসত্য একটি কথা। বাস্তবে দরিদ্র জনগণ অর্থাৎ মৌওয়াল, বাওয়ালি, জেলেসহ সুন্দরবন অঞ্চলের দরিদ্র জনগণ সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থান বা ইকোসিস্টেমের অংশ হিসেবে যুগ যুগ ধরে সুন্দরবনের সঙ্গে সহাবস্থান করছে। সুন্দরবনের আসল বিপদ হল প্রশাসন সমর্থিত বিভিন্ন লুটেরা কর্তৃক সুন্দরবনের গাছ লুট, বাঘ-হরিণ শিকার, বন্যপ্রাণি পাচারসহ রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো কথিত উন্নয়ন প্রকল্প, এবং ভূমিদস্যুরা যাদের হাত থেকে এই বনকে রক্ষা করতে সুন্দরবনের দরিদ্র মানুষ প্রতিনিয়ত লড়াই করছে। আমরা বুঝতে পারি গরীব মানুষদের ’চোর’ বলে উচ্ছেদ করা খুব সহজ, সাগরচোরদের পথ তাতে পরিষ্কার হয়।
১৩২০ মেগাওয়াট কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ পর্যায়ে ৪ হাজার অস্থায়ী কর্মসংস্থান এবং পরিচালনা পর্যায়ে দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিক মিলিয়ে সর্বোচ্চ ৬০০ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হতে পারে। কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ও পরিচালনায় মূলত কারিগরী জ্ঞান সম্পন্ন লোকের কর্মসংস্থান হয় বলে এসব কর্মসংস্থানের খুব সামান্যই স্থানীয় জনগণের ভাগ্যে জুটবে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ও চালু হলে কি পরিস্থিতি হবে তার লক্ষণ কিন্তু এখনই ধরা পড়ছে। সাপমারী ও কৈগরদাসকাঠী মৌজায় ৮টি ইউনিয়নের ৪০টি গ্রামের ২ হাজার পরিবার এই প্রকল্পের কারণে ইতিমধ্যেই মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। আর বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলে মাটি পানি বাতাস মারত্মক দূষিত হয়ে সুন্দরবন ও তার চারপাশের জলাভূমির উপর নির্ভরশীল জেলে, কৃষক, বাওয়ালী, মউয়াল সহ কয়েক লক্ষ মানুষের জীবিকা ক্ষতিগ্রস্থ হবে। উদাহরণ স্বরূপ মৎসজীবিদের জীবিকা বিনষ্ট হওয়ার কথা খোদ কোল ট্রান্সপোট্র্ ইআইএ রিপোর্টেই স্বীকার করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর দাবি: ”বড় পুকুরিয়ায় সাবক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহার করা হচ্ছে। কোন ক্ষতি হচ্ছে এরকম কথা একবারও কেউ লিখতে পারে নাই।”
সঠিক তথ্য ও আমাদের বক্তব্য: আমরা জানি না কোন সমীক্ষার ভিত্তিতে তিনি এই কথা বারবার বলছেন। আমরা বহুবার বড়পুকুরিয়া গেছি, এবং আমাদের কাছে বড়পুকুরিয়া নিয়ে বেশ কয়েকটি সরেজমিন প্রতিবেদন ও সমীক্ষা আছে। যে কেউ বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আশপাশে গেলেই দেখতে পাবেন পরিবেশ বিপর্যয়ের নানা উদাহরণ। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চারপাশের কৃষিজমি কয়লা দূষণে রীতিমত কালো রঙ ধারণ করেছে, মাটির নিচের পানির স্তর নেমে গেছে, ছাইয়ের পুকুরে গাদা করে রাখা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছাই পরিবেশ দূষণ ঘটাচ্ছে। ২০১৪ সালে রাজশাহী ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি থেকে গবেষণা হয় বড়পুকুরিয়া কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে। গবেষণা থেকে দেখা যায়- (১) কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ঘন্টায় ৯ ঘনমিটার হারে দূষিত পানি নিকটস্থ তিলাই নদীতে ডিসচার্জ করা হচ্ছে কোন ধরণের পরিশোধন ছাড়াই; (২) ছাইয়ের পুকুরে থাকা তরল বর্জ্যে অতিরিক্ত বোরন, আর্সেনিক, পারদ পাওয়া গেছে যা চুইয়ে মাটিতে মিশছে যার কারণে ভূগর্ভস্থ পানি দূষিত হচ্ছে এবং ক্রমশ ব্যবহারের অনুপযোগি হচ্ছে; (৩) বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে সালফার ও নাইট্রোজেনের অক্সাইড ও ধুলোকণার ইমিশনের পরিমাণ সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি; (৪) আশপাশের বহু মানুষ বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে অ্যাজমা, এলার্জি, চর্মরোগ সহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন। গবেষকদল নিকটস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রের চিকিৎসকের সাথে কথা বললে তারাও বলেছেন ২০০৬ সালে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হওয়ার পর থেকে এইসকল অসুখ বেড়েছে। (৫) ফ্লাই অ্যাশের কারণে আশপাশের মাটির ক্ষারত্ব বেড়ে গেছে। (৬) ৪৭.৩৬ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে ফসলের উৎপাদন হ্রাস, বাতাসে ও গাছের পাতায় ছাইয়ের উপস্থিতির কথা জানিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত, বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঙ্গে প্রস্তাবিত রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তুলনা করাই সঠিক নয়। কারণ বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্র ছোট আকারের এবং বড়পুকুরিয়ার পাশে সুন্দরবনের মতো স্পর্শকাতর বনাঞ্চল নেই। বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা মাত্র ২৫০ মেগাওয়াট যার মধ্যে আবার কার্যত ১২৫ মেগাওয়াটের একটি ইউনিটই কেবল চালু থাকে। অথচ রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্ষমতা ১৩২০ মেগাওয়াট যা বড়পুকুরিয়ার কার্যকর (১২৫ মেগাওয়াট) বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার ১০ গুণেরও বেশি। ফলে বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ফলে যে ক্ষতি হয়েছে এবং হচ্ছে, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ফলে তার দশগুণেরও অনেক বেশি ক্ষতি হবে।
প্রধানমন্ত্রীর দাবি: বড় পুকুরিয়ায় জমি উর্বর হচ্ছে, ফসলের ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে। (বেগুন ক্ষেতে ছাই ছিটিয়ে জমি উর্বর করার উদাহরণ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী)
সঠিক তথ্য ও আমাদের বক্তব্য: প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত কাঠ পুড়িয়ে তৈরী জৈব ছাই এবং খনিজ কয়লা পুড়িয়ে তৈরী ছাইয়ের পার্থক্য সম্পর্কে অবগত নন। তাঁর উপদেষ্টারাও এবিষয়ে তাঁকে অবহিত করেননি। কয়লা পুড়িয়ে তৈরী ছাই বিষাক্ত বলে এই ছাইয়ের মাধ্যমে জমি উর্বর করার চিন্তা বিপদজনক। বড়পুকুরিয়া কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে ফসলের ফলন বাড়ছে কথাটি সঠিক নয়। সেখানকার বিদ্যুৎকেন্দ্রের দূষণের কারণে আশপাশের কয়েক কিমি এলাকার নারিকেলসহ বিভিন্ন ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পানির পরিস্থতি সবচাইতে খারাপ। এর সাক্ষী সরকারি নথিপত্রই। বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে ভূগর্ভস্থ পানি নীচে নেমে যাওয়ায় পানি সংকট ও ফলে স্থানীয় জনগণের অসন্তোষ বৃদ্ধি পাচ্ছে এরকম একটি তথ্যবিবরণী সরকারি সংস্থা থেকেই তৈরি করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর দাবি: পৃথিবীর বহু দেশে শহরের মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে যেগুলো থেকে কোন ক্ষতি হচ্ছে না (কয়েকটি দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রের ছবি প্রদর্শন)
সঠিক তথ্য ও আমাদের বক্তব্য:মনে রাখা দরকার যে, বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিজ্ঞাপনী ছবি দেখে দূষণ হচ্ছে কি হচ্ছে না তা বোঝা যায় না। সব গাছ পালা বিদ্যুৎকেন্দ্রের দূষণে সমান ভাবে ক্ষতিগ্রস্তও হয় না।
প্রধানমন্ত্রী “ক্ষতি হয় না” বোঝাতে বিভিন্ন দেশের কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কথা বলেছেন সেগুলো সম্পর্কে খোজ খবর করলে এর ভিন্ন চিত্র পাওয়া যায়। যেমন: ইউসেস্কো ওয়াল্ড হেরিটেজ সাইট ”হা লং বে” র পাশ্ববর্তী ভিয়েতনামের Quang Ninh কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বন্যা ও জলোচ্ছাসের সময় বিপুল পরিমাণ কয়লা দিয়েন দিয়েন ভং নদীতে ভেসে গেছে, ব্যাপক নদী দূষণ ঘটেছে। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র সহ আরো কিছু কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য ”হা লং বে” ও মারাত্মক দূষণের শিকার হয়েছে।শহরে বিদ্যুৎ কেন্দ্র থাকলে আশপাশে কি ধরণের সমস্যা হতে পারে তার নজির Quang Ninh প্রদেশে যথেষ্টই রয়েছে।
ছবিতে যেমনই দেখা যাক, তাইওয়ানের Taichung কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে দুনিয়ার অন্যতম দূষণকারী কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র বলা হয়। এই কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে তাইওয়ানের মধ্য ও দক্ষিণ অঞ্চলে বায়ু দূষণ এত বেড়েছে যে এক পর্যায়ে আন্দোলনের মুখে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির উৎপাদন কমিয়ে ফেলতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ।
প্রধানমন্ত্রী ওয়েষ্ট ভার্জিনিয়ার কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের উদাহরণ দিয়েছেন। এই কেন্দ্র পরিচালনা করে আমেরিকান ইলেক্ট্রিক পাওয়ার কোম্পানি। ২০১৪ সালে ক্লিন ওয়াটার এক্ট লংঘন করে পানিতে মাত্রাতিরিক্ত সেলেনিয়াম, মারকারি ও অন্যান্য ভারী ধাতু নির্গমনের দায়ে এই কোম্পানিকে আদালতে অভিযুক্ত করা হয়। রায় অনুযায়ী এই কোম্পানি জরিমানা দিতে রাজী হয় এবং একটি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ ও দুটিতে দূষণ কমানোর অঙ্গিকার করে।
প্রধানমন্ত্রীর দাবি: ”আন্দোলনকারীরা বড়পুকুরিয়ায় যান নাই, রামপাল যান নাই।”
সঠিক তথ্য ও আমাদের বক্তব্য: এটি শতভাগ ভুল। বড়পুকুরিয়াতে তো বটেই রামপালেও বহুবার আমাদের যেতে হয়েছে। রামপাল এলাকায় অস্বচ্ছতা, অনিয়ম, জবরদস্তি দিয়ে এলাকার মানুষদের যখন উচ্ছেদ করবার চেষ্টা হচ্ছিলো তখন এলাকার মানুষ কৃষিজমি ও বসতভিটা রক্ষা কমিটির মাধ্যমে তা প্রতিরোধ করতে চেষ্টা করেন। তাঁদের আহবানেই আমরা প্রথম রামপালে যাই ২০১০ সালে। এরপর আমাদের যাওয়া বারবার বাধা দেয়া হয়েছে। সন্ত্রাসী হামলা, ১৪৪ ধারা জারী, পুলিশী হামলার বহু ঘটনা ঘটেছে। তারপরও আমাদের যাওয়া থামেনি। ২০১৩ সালে এলাকার মানুষদের সমর্থন নিয়েই ঢাকা থেকে যাওয়া লংমার্চ বিশাল আকার নিয়ে সুন্দরবনের আঙিনায় গিয়ে শেষ হয়। এর পর আরও অনেক কর্মসূচি হয়েছে। এখনও নেয়া হচ্ছে।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
বস্তুত প্রধানমন্ত্রী রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করবেন জানবার পর থেকে কেউ কেউ আশা করেছিলেন যে, হয়তো প্রধানমন্ত্রী স্বাধীন বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য এবং দেশজোড়া জনমত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন এবং রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করে সুন্দরবনকে নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার পথ গ্রহণ করবেন। কিন্তু উল্টো আমরা দেখলাম এতোদিন ধরে কোম্পানি, তাদের কনসালট্যান্ট, স্তাবকবৃন্দ যেসব অনেক ভুল ও অতিরঞ্জিত তথ্য প্রচার করছে, প্রধানমন্ত্রী সেগুলোই পুন:ব্যক্ত করেছেন। এমনকি আমরা গত ২৮ জুলাই “প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি’-তে যেসব প্রচারণা খন্ডন করেছি, প্রধানমন্ত্রী আবারও সেগুলোই উচ্চারণ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু দিক আমরা আবারও পরিষ্কার করলাম।
প্রধানমন্ত্রী আন্দোলন নিয়ে বিষোদগার করেছেন। বহুবছরে গড়ে উঠা আন্দোলনে হঠাৎ করে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে সমর্থন জানানোকে প্রধানমন্ত্রী একটি স্বাধীন জনপ্রিয় আন্দোলনে কালি মাখানোর সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। আমরা পরিষ্কার করে বলতে চাই, শুধু বিএনপি নয় গত দশবছরে দেশের দুই বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েরই সমর্থন পাবার অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে। তবে এই ঘটনা ঘটেছে তখনই যখন দল সরকারের বাইরে থাকে এবং যখন আমাদের আন্দোলনে ব্যাপক জাগরণ তৈরি হয়। ১০ বছর আগে যখন বিএনপি জামায়াতের সরকার ফুলবাড়ীতে গুলি চালানোর পর মানুষ যখন গণঅভ্যুত্থানে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিলেন তখনই আওয়ামী লীগ আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছিলো। সেসময় বর্তমান সরকারের মতোই তৎকালীন সরকার‘থলের বেড়াল’ তত্ত্ব হাজির করেছিলো, আন্দোলন নিয়ে নানা কুৎসা রটনা শুরু করেছিলো। সরকারে থাকলে একই দলগুলোর ভূমিকা হয় সম্পূর্ণ বিপরীত, গুলি লাঠি টিয়ার গ্যাস হামলা নির্যাতন কুৎসা কোনোকিছুই বাদ যায় না। বর্তমান সরকারের ভূমিকাও তার প্রমাণ। প্রধানমন্ত্রী আন্দোলনের প্রতি কটাক্ষ করে প্রশ্ন তুলেছেন, ”এতোসব আন্দোলনের খরচ কে যোগান দেয়?” মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি যখন আমাদের ফুলবাড়ী আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন তখন আমরা যেভাবে খরচ যোগাতাম এখনও আমরা সেভাবেই খরচ যোগাই। তবুও আপনার অবগতির জন্য জানাচ্ছি, এই আন্দোলন জনগণের গায়ে গতরে, অসংখ্য মানুষেরশ্রমে ঘামে গড়ে তোলা আন্দোলন।লংমার্চের কথা বলেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, যারা দিনরাত পরিশ্রম করে খেয়ে না খেয়ে এসব কর্মসূচিতে অংশ নেয় তাদেরকেও চাঁদা দিয়ে অংশ নিতে হয়। ক্ষমতায় থাকা বড় দলগুলোর মতো আমাদের আন্দোলন টাকার ওপর ভর করে না, কারও পৃষ্ঠপোষকতার তোয়াক্কা করে না। আপনাদের কাছে এগুলো অবিশ্বাস্য মনে হবে, কিন্তু আপনাদের যেসব কাজ করতে লক্ষ কোটি টাকা খরচ করতে হয় সেগুলো আমরা আমাদের কর্মীরা গায়ে গতরে খেটে সম্পন্ন করি। এইদেশ যেসব আন্দোলন দিয়ে মুক্তির স্বাদ পেয়েছে তার সবগুলোর ধরনই একই। আপনি হয়তো ভুলে গেছেন যে, ভাষা আন্দোলনে মানুষকে পয়সা দিয়ে আনতে হয়নি, ৬০ দশকের আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ মানুষ জীবন বাজি রেখে গেছে। পয়সা দিয়ে দালাল আসে যেমন রামপালের প্রকল্পের পক্ষে প্রচারকরা আছে। এটা খুবই দু:খজনক যে, আপনার বক্তব্যে আমরা তাঁদের প্রচারণারই প্রতিধ্বনি পেয়েছি।
সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনে তরুণেরাই প্রধান শক্তি। প্রশ্নহীন আনুগত্যে অবনত লোভী সন্ত্রাসী আর জঙ্গীবাদের যুগে এই তরুণেরাই বাংলাদেশের শক্তি।স্বপ্ন, সৃজনশীলতা আর উদ্যম নিয়ে, আজকের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে, তারা সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনে শামিল হয়েছে, আন্দোলন বিকাশে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে নিয়োজিত হয়েছে। তাঁদের প্রেরণা, প্রাণের টান বোঝার ক্ষমতা থাকলে সুন্দরবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার উদ্যোগ দেখা যেতো না।
আমরা আবারও বলি, সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন বৈজ্ঞানিক তথ্য বিশ্লেষণের ওপর ভর করে এবং সামাজিক দায়বোধ থেকে স্বাধীন ও স্বতস্ফূর্ত আন্দোলন হিসেবে গত কয়েক বছরে বিকশিত হয়েছে। এই আন্দোলন এভাবেই এগিয়ে যাবে। আমরা এখনও আশা করি, এই আন্দোলনকে কলঙ্কিত না করে প্রধানমন্ত্রী দেশের প্রতি দায়বোধ থেকে জনগণের স্বার্থ বুঝতে চেষ্টা করবেন এবং মানুষ ও প্রকৃতি বিধ্বংসী প্রকল্প বাতিল করবেন।