?> সুন্দরবনকে ভালোবাসুন, একে রক্ষায় এগিয়ে আসুন « NCBD – National Committee of Bangladesh

Monday, March 16th, 2015

সুন্দরবনকে ভালোবাসুন, একে রক্ষায় এগিয়ে আসুন

পাখির গান, তার পালকের রঙের বাহার, পায়ের নাচন; ফুলের গন্ধ, ভোরের আলোয় চিত্রল হরিণের ত্রস্ত-চকিত রূপ, সোনায় মোড়া ডোরাকাটা বাঘের রাজকীয় ভঙ্গির সঙ্গে সুন্দরবনের অরণ্য কার না হূদয় স্পর্শ করে। অপরিসীম দয়া আর বদান্যতার আধার হয়ে সুন্দরবন প্রতিদানের প্রত্যাশা না করে নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার মাঝে আনন্দ খুঁজে ফিরছে। নিজের জীবনধারণের জন্য সৃষ্ট উপাদানগুলোও সে বিলিয়ে দিয়ে চলেছে অন্যের প্রয়োজনে। এমন সুন্দরবনকে মানুষ তার সর্বধ্বংসী ক্ষমতায় নির্মূল করে দেয়ার উপক্রম করছে। এ ক্ষমতার পরিপূরক হিসেবে সর্বরক্ষার নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে মানবিক মানুষ আজ পারমাণবিক মানুষের স্তরে উত্তীর্ণ হয়ে অখিল ক্ষুধায় নিজেকে খাবার প্রাক্কালে একবার পেছনে ফিরে তাকানোর তাগিদ অনুভব করছে। ইট-পাথরের দালান থেকে সবুজের কোলে পালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনে নিজেদের নৈতিক শক্তি, সভ্য আইন এবং সমবায়ী শক্তি দিয়ে সুন্দরবন রক্ষা জরুরি।

বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থানকে প্রকৃতির যে কয়েকটা অবদান অনন্য করেছে, তার মধ্যে আমাদের সুন্দরবন প্রধান। পৃথিবীর সর্ববৃহত্ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের নয়নাভিরাম নৈঃসর্গিক দৃশ্যাবলি সবসময় পর্যটকদের বিমোহিত করে, তা ২৪ ঘণ্টায় কমপক্ষে ছয়বার বদলায়। এখন থেকে ২০০ বছর আগে সুন্দরবনের আয়তন ছিল ১৬ হাজার ৭০০ বর্গকিলোমিটার, আজ যা অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। প্রায় ৪০০টা খাল আর ছোট-বড় নদীবেষ্টিত দুইশর মতো দ্বীপের সমন্বয়ে এ বন বাংলাদেশ অংশে প্রায় ৪ হাজার ১১০ এবং ভারতীয় অংশে ২ হাজার ৭৪০ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত। সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নির্বিচারে বন উজাড়ের কারণে দিন দিন কমলেও এখনো শুধু আমাদের জন্য নয়, বিশ্ব প্রকৃতির জন্যও সমান গুরুত্বপূর্ণ।

সুন্দরবনে ২৪৫ প্রজাতির বৃক্ষ, ৫০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩২০ প্রজাতির স্থায়ী ও অতিথি পাখি, ৪০০ প্রজাতির মাছসহ রয়েল বেঙ্গল টাইগার, লোনা পানির কুমির, পাঙ্গেয় ও ইরাবতী প্রজাতির ডলফিন, তিন প্রজাতির কচ্ছপের আবাস ছিল। এসব দিয়ে সাজানো সুন্দরবনে পশুর নদীর তীরে করমজল পর্যটন কেন্দ্র, চাঁদপাই রেঞ্জের কটকা রেস্ট হাউজ, কচিখালী-নীলকমল অভয়ারণ্য, মত্স্য আহরণ ও প্রক্রিয়াকরণে দুবলারচর, হিরণ পয়েন্টে রেস্ট হাউজ ও বসতি ঘর, মান্দারবাড়িয়া দুর্গম অভয়ারণ্য, শিবসা নদীর তীরে ৪০০ বছরের পুরনো মন্দির, ঐতিহাসিক শেখের বাড়ি ইত্যাদি দেশ-বিদেশের পর্যটকদের আকর্ষণ করে প্রবলভাবে। পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত ৫০ প্রজাতির ম্যানগ্রোভ বৃক্ষের মধ্যে ৩৫ প্রজাতিই সুন্দরবনে অবস্থিত।

বঙ্গোপসাগরের ভৌগোলিক অবস্থান, মৌসুমি আবহাওয়ার অভিঘাত বাংলাদেশের উপকূলকে বারবার ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। সুন্দরবন প্রকৃতির রুদ্ররোষ মাথা পেতে নিয়ে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরিশাল, বরগুনা, পটুয়াখালীকে রক্ষা করে চলেছে। দেশের কৃষকের বাড়ি যেভাবে কালবৈশাখীর ঝড় থেকে রক্ষা পায় ঈশান কোণের গাছপালা থাকার কারণে, ঠিক তেমনিভাবে সুন্দরবন বাংলাদেশকে রক্ষা করে প্রকৃতির রুদ্ররোষ সামুদ্রিক ঝড় থেকে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৩ কোটি মানুষকে সুন্দরবন পাহারা দিয়ে রাখলেও আমরা তা ভুলে গিয়ে ধ্বংসের চিন্তায় আজ মগ্ন। পরিবেশবিদদের আশঙ্কা একুশ শতকের মধ্যেই জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবসৃষ্ট নানা কারণে সুন্দরবনের ৭৫ শতাংশ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। আমরা তা ত্বরান্বিত করার সব কার্যক্রমে নিবেদিত।

বর্তমানে সুন্দরবনের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে এ বন থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে রামপালে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের কয়লা বিদ্যুত্ উত্পাদন কেন্দ্র নির্মাণ। বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণ ও ব্যবহারের জন্য যন্ত্রপাতি, যানবাহন, জেনারেটর ইত্যাদি কারণে সার্বিক সুন্দরবনে যে বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, শব্দদূষণ হবে, তাতে ম্যানগ্রোভ বন, কৃষিক্ষেত্রে ও জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। এলাকার মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। বিদ্যুেকন্দ্র থেকে নির্গত সালফার, নাইট্রোজেন, কার্বন ইত্যাদি যৌগ কিংবা পারদ, সিসা, ক্যাডমিয়াম, ব্যারিয়াম ইত্যাদি ভারী ধাতুর দূষণে এবং কুলিং টাওয়ারে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণে আশপাশেও ব্যাপক আকারে নিউমোনিয়া, ক্যান্সারসহ নানা রোগ ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। বিদ্যুেকন্দ্রের প্রস্তাবিত এলাকা কৃষিজমি হওয়ায় আটটি ইউনিয়নের প্রায় ৪০টি গ্রামের সাত-আট হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জালের মতো ছড়িয়ে থাকা নদী ও খালে নৌযান চলাচল, তেল নিঃসরণ ইত্যাদি কারণে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, ডলফিন, সারস, বক, ম্যানগ্রোভ বন ইত্যাদির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। বিদ্যুত্ উত্পাদন শুরু হলে তেল ও কয়লা পোড়ানোর ফলে ক্ষতিকর কার্বন ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড নির্গত হবে এবং ফ্লাই অ্যাশ ও বটম অ্যাশের বিভিন্ন ভারী ধাতু সুন্দরবনের যে ক্ষতি করবে তা পূরণ হওয়ার নয়। বিদ্যুেকন্দ্র থেকে বের হওয়া পানির তাপমাত্রা, গতি ও বিভিন্ন দ্রবীভূত উপাদানে পানির যে দূষণ ঘটবে, তাতে লবণাক্ততা, পলিপ্রবাহ, জোয়ার-ভাটা, জলজ প্রাণীসহ উদ্ভিদ জগতের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। নির্মাণকাজে যন্ত্রপাতি ও যানবাহনের শব্দে যে শব্দদূষণ হবে, তা পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে; যাতে উদ্ভিদ ও প্রাণিজগতের জীবনচক্রের পরম্পরা নষ্ট হবে। মাত্র ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের জন্য আমরা দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৩ কোটি মানুষকে বিপদে ঠেলে দেব কেন?

সুন্দরবনের মোট আয়তনের মধ্যে নদী, খাল ও খাঁড়ি রয়েছে প্রায় ১ হাজার ৭০০ বর্গকিলোমিটার, যেগুলোর প্রশস্ততা কয়েক মিটার থেকে শুরু করে কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত। জালের মতো পরস্পর যুক্ত নৌপথের কারণে সুন্দরবনের প্রায় সব জায়গায়ই সহজে নৌকায় যাওয়া যায়। আইনি নিষেধ অমান্য করে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌযানগুলো চলাচল করছে। সম্প্রতি শ্যালা নদীতে তেলবাহী ট্যাংকার ‘ওটি সাউদার্ন স্টার-৭’ ডুবির ঘটনায় শ্যালা ও পশুর নদীর পানিতে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ লিটার ফার্নেস অয়েল ছড়িয়ে পড়ে। ছড়িয়ে পড়া তেলের আস্তরণে দূষিত হয়ে পড়ে পানি। এতে কাঁকড়া, চিংড়ি, ডলফিনের মতো ধীরে চলাচলকারী জলজ প্রাণী মহাসংকটে পড়েছে। পরিবেশবাদীদের আশঙ্কা উদ্ভিদও সংকটের বাইরে থাকবে না। তেলদূষণ মোকাবেলায় উন্নত মানের যন্ত্রপাতি ও উপকরণের মহাসংকট প্রতীয়মান হয়।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও নদীভাঙনের পাশাপাশি অবৈধ বসতি স্থাপন, অনিয়ন্ত্রিত গাছ কাটা ও সম্পদ আহরণ ইত্যাদির ফলে গত চার দশকে সুন্দরবনের আয়তন ১৪০ বর্গকিলোমিটার কমেছে। বনের সৌন্দর্যের প্রতীক সুন্দরী গাছ প্রায় ২৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ কমেছে। সময়ের বিবর্তনে পাখি, বাঘ থেকে শুরু করে গাছপালা সবকিছুই কমছে। এখন বিদ্যুেকন্দ্র, সাইলো, জাহাজ নির্মাণ শিল্প স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে। তার পরও সুন্দরবন প্রচুর প্রতিরোধমূলক ও উত্পাদনমূলক ভূমিকা পালন করে চলেছে। এখনো বাংলাদেশের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ৫১ শতাংশ জুড়ে সুন্দরবন। বন থেকে আসা মোট আয়ের মধ্যে সুন্দরবনের অবদান ৪১ শতাংশ এবং কাঠ ও জ্বালানি উত্পাদনে এর অবদান ৪৫ শতাংশ, পাশাপাশি অনেক শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহকারী বন।

বাংলাদেশের প্রায় ৬ লাখ মানুষ প্রতি বছর সুন্দরবনে প্রবেশ করে বিভিন্ন ধরনের বনজ সম্পদ আহরণ করে। এ বনজ সম্পদের মধ্যে মূল্যবান কাঠ, গোলপাতা, মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া, ঝিনুক, মধু, জ্বালানি ইত্যাদি সংগ্রহ করে তারা জীবিকা নির্বাহ করে। প্রতি বছর এক কোটি পর্যটক সুন্দরবনে আসে। ১৮৭৮ সালে সুন্দরবনকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এর এক বছর পর বন বিভাগকে সুন্দরবনের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া হয়। ১৩৫ বছর সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করা হলেও তা রক্ষায় কোনো নীতিমালা হয়নি। সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যসহ জীববৈচিত্র্যপূর্ণ জলাভূমি রক্ষায় ১৯৭২ সালে রামসার চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী বাংলাদেশ সরকার যথাযথ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।

সুন্দরবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে রয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ সারা দেশের পরিবেশ ও প্রতিবেশ। তাই সুন্দরবন রক্ষার তাগিদ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের বেশি। সেই দায় থেকে সুন্দরবন ও এর জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ১৮ দফা প্রস্তাবনা দেশ ও জাতির সামনে রেখে তা বাস্তবায়নের আন্দোলনে নিবেদিত। দাবির মধ্যে রয়েছে— সুন্দরবন ও বনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের লক্ষ্যে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে হবে; জাতীয় প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত রয়েল বেঙ্গল টাইগার রক্ষার জন্য অনতিবিলম্বে বাঘ-হরিণসহ সুন্দরবনের সব ধরনের প্রাণী হত্যা বন্ধসহ যাবতীয় বেআইনি কার্যকলাপ বন্ধ, সুন্দরবনের পার্শ্ববর্তী এলাকায় উন্নয়ন প্রকল্পে যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের আগে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ এবং স্থানীয় জনগণের মতামত নিতে হবে। এছাড়া জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ-নবায়ন ও উন্নয়নের লক্ষ্যে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, তেল-গ্যাস আবিষ্কারের জন্য অনুসন্ধানী উদ্যোগ বন্ধ, আইনানুগ সম্পদ আহরণকারীদের যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত, বন ও বন্যপ্রাণী আইনকে আরো যুগোপযোগী এবং প্রয়োজনে পৃথক বন আইন, বনের ভেতর ও পাশ দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোর সংস্কার, বিশেষ করে গোরাই নদী শাসনের ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো, সুন্দরবন এলাকায় চিংড়ি পোনা ধরার কারণে মাছসহ সব সম্পদের যে ক্ষতি হচ্ছে, তা রোধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।

ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আমরা সুন্দরবনের মতো প্রাকৃতিক সুরক্ষা প্রাচীর পেয়েছি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ যেখানে সমুদ্রে সৃষ্ট দুর্যোগ থেকে রক্ষার জন্য উপকূলীয় বন সৃষ্টির চেষ্টা করে চলেছে, সেখানে আমরা সুন্দরবনকে ধ্বংস করার কাজে লিপ্ত হয়েছি। সুন্দরবনের সুরক্ষা প্রাচীরের কারণে আইলা, সিডর, নার্গিস থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জানমাল রক্ষা পেয়েছে, তা খুব তাড়াতাড়িই ভুলে গেছি। তাই আসুন, সুন্দরবনের সুন্দর অবদান স্মরণ করে একে রক্ষায় নিবেদিত হই।

 

লেখক: সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইডিইবি)

* লেখাটি ১৪ মার্চ ২০১৫ দৈনিক বণিক বার্তায় প্রকাশিত হয়।

http://www.bonikbarta.com/2015-03-14/news/details/31227.html