
Monday, December 22nd, 2014
কে এই ফরেস্ট কুকসন?
ড. ফরেস্ট ই. কুকসন। বনানীর ২৫ নং রোডে অবস্থিত রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার নামক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক তিনি। ১৯৬১ সালে জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি নেন। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষকতাও করেন।
বাংলাদেশে ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাস করছেন এই মার্কিনি। পারিবারিক নানা ঝামেলার কারণেই নিজ দেশ ছেড়ে এত দূরে এসে তাকে থাকতে হচ্ছে। ‘ওয়াশিংটন পোস্টে’র ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১০ তারিখের একটি খবর থেকে এ তথ্য জানা যায়। স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদের খবরও দিয়েছে পত্রিকাটি। (সূত্র: ১) অ্যামেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশ (অ্যামচেম)-এর সভাপতি ছিলেন ১৯৯২ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত। বর্তমানে বাংলাদেশের বেসরকারি নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা করেন তিনি। বাংলাদেশের মতো করে তিনি থাইল্যান্ডেও দৌড়ঝাঁপ করে থাকেন। সেখানকার বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের নাম দেখা যায় তার প্রোফাইলে।
বাংলাদেশে কুকসনের এজেন্ডা
কুকসন বাংলাদেশের বিভিন্ন ইংরেজি দৈনিকে লেখালেখি করেন। অর্থনীতিবিদ হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশ নিয়ে মার্কিনিদের নানা নেতিবাচক তৎপরতার সঙ্গে আগাগোড়া জড়িত কুকসন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন যখন ২০০০ সালে বাংলাদেশ সফরে আসেন, গোপনে হলেও বাংলাদেশ থেকে গ্যাস রপ্তানির এজেন্ডাটি ছিল তখন তার প্রধান ইস্যু। এ নিয়ে ২০ মার্চ, ২০০০ তারিখে ‘নিউইয়র্ক টাইমসে’ প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়, ‘এখানে অনেকেই আতঙ্কিত যে, প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন ঢাকায় কেবল একটি সফরই করছেন না, বরং এখান থেকে বেশ কিছু নিয়েও যাচ্ছেন! এটা ধারণা করা হচ্ছে যে, বাংলাদেশ গ্যাসের সাগরে ভাসছে। “আমরা এটাকে প্রাচ্যের পারস্য উপসাগর বলে অভিহিত করছি” এমন বক্তব্য মার্কিন অর্থনীতিক ও কনসালটেন্ট ফরেস্ট কুকসনের, যিনি বাংলাদেশে গ্যাস উত্তোলন খাতকে লাভজনক করা নিয়ে গবেষণা করছেন।’(সূত্র: ২)
০৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৮ তারিখে ‘নিউ ইয়র্ক টাইম’সে প্রকাশিত ‘মনসুন হ্যাংগস অন, সোয়াম্পিং বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রতিবেদক ফরেস্ট ই. কুকসনকে দেখাচ্ছেন একটি প্রাইভেট কনসাল্টিং ফার্মের বাংলাদেশে উন্নয়ন বিষয়ক কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে। প্রতিবেদকের আরও ভাষ্য, প্রকৃতপক্ষে এটি একটি মার্কিন কনসাল্টিং ফার্ম এবং কুকসন ঢাকায় বসেই এর জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। এই ধরনের মার্কিন কনসাল্টিং ফার্মগুলো প্রতি বছর নিজ দেশের বিভিন্ন কর্পোরেশন এবং ইউএসএইডের জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণার কাজগুলো করে থাকে। এই সংস্থাগুলোর নিজেদের ভাষায় কথা বলার জন্য নিজেদের একজন দক্ষ লোক দরকার হয়। এবং কুকসন এ কাজে বেশ দক্ষ।(সূত্র: ৩)
কিছুদিন আগে প্রকাশিত ইউএসএইডের একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, এই সংস্থা নিয়মিতভাবে কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সুশীল সমাজ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে চলে, যাদের কাজই হলো বিভিন্ন পত্রিকায় নিবন্ধ লেখার মাধ্যমে বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে ইউএসএইডের স্বার্থ রক্ষা করা। কুকসনকে ইউএসএইড সমর্থিত প্রায় অধিকাংশ প্রকল্প নিয়েই কথা বলতে দেখা যায়। এ দ্বারা স্পষ্ট হয় যে, পত্রিকায় লেখালেখি করে কুকসন ইউএসএইডের পক্ষে জনমত টানার দায়িত্ব পালন করছেন।
পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলোর খবর খুঁজে আমরা কুকসনের পরিষ্কার এজেন্ডাটাও বের করেছি। ২৭ জানুয়ারি, ১৯৯৬ তারিখে ‘নিউইয়র্ক টাইমসে’ প্রকাশিত একটি খবরে বলা হয়, ‘তিনি বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক (বাংলাদেশ ব্যাংক) সংস্কারের কাজে যুক্ত আছেন, যা কিনা দেশটির মুক্তবাজার অর্থনীতির দিকে বিরাট যাত্রার একটা অংশ।’(সূত্র: ৪)
এ থেকে বোঝা যায়, কুকসন বাংলাদেশকে পশ্চিমা অর্থনীতির জন্য উপযোগী ও তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও প্রকল্পের সুবিধাজনক একটি কেন্দ্রে পরিণত করতে কাজ করছেন। এরকম আরও অনেক তথ্য পাওয়া যায় কুকসন সম্পর্কে, যাতে হাতেনাতে প্রমাণ হয় তিনি এদেশে বসে মার্কিন স্বার্থ সংরক্ষণে ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। যে কেউ বলবেন, এটা কোনো অপরাধ নয়। একজন নিজ দেশের স্বার্থ রক্ষার জন্য কাজ করতেই পারেন। তবে এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সচেতন থাকতে হবে যে, কুকসন সাহেব মার্কিনেরই লোক। তার গতিবিধি ও সক্ষমতা কোনোভাবেই বাংলাদেশের পক্ষে যায় না। যদিও তিনি অনেক দিন ধরে বাংলাদেশে বাস করেন এবং এদেশের ক্ষমতাশালীদের অনেকেরই খুব ঘনিষ্ঠ তিনি।
কুকসনের লম্বা হাত
কুকসন বাংলাদেশে টিকে থাকার জন্য ক্ষমতাবান সব মহলেই বন্ধু তৈরি করে নিয়েছেন। এক্ষেত্রে তার আমেরিকা কানেকশন ও বাংলাদেশে বসবাসরত আমেরিকানদের স্বার্থ সংরক্ষণে ভূমিকা রাখাটা বেশ কাজে দিয়েছে।
বর্তমান সরকারের গত মেয়াদের শেষের দিকে স্বরাষ্ট্র্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতা মহীউদ্দীন খান আলমগীর এদেশে তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন। বন্ধুর জন্য অনেক করেছেন তিনি। বন্ধু মখা আলমগীরের বিরুদ্ধে সম্পদের হিসাব লুকোনোর অভিযোগ উঠলে আদালতে গিয়ে বন্ধুর পক্ষে সাফাই সাক্ষ্যও দিয়েছেন। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সনদ দিয়েছেন বন্ধুর পক্ষে দাঁড়িয়ে।
মহীউদ্দীন খান আলমগীর ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে লেখা তার ‘নোটস ফ্রম এ প্রিজন’ শীর্ষক আত্মকথায় লিখেছেন, ‘মি. কুকসন বাংলাদেশে কাজ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংক, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের কনসালট্যান্ট হিসেবে। তিনি আমেরিকান বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি তার সাক্ষ্যে বলেন, ১৯৮৯ সাল থেকে তিনি ড. আলমগীরকে চেনেন। তার বিবেচনায় ড. আলমগীর দারিদ্র্যবিমোচনে নিবেদিত ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ একজন সৎ, দেশপ্রেমিক ব্যক্তি।… কুকসন বলেন, ড. আলমগীরের জ্ঞাত ও বৈধ ভাড়া, বেতন এবং সহায়ক ও আকস্মিক আয়ের ভিত্তিতে সঞ্চয়/বিনিয়োগযোগ্য অর্থের যে হিসাব ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারার অধীনে দেয়া জবানবন্দিতে উল্লেখ করা হয়েছে এবং কম্পিউটার প্রিন্ট আউট হিসেবে জবানবন্দির সঙ্গে সংযুক্ত করে কোর্টে উপস্থাপন করা হয়েছে, তা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ‘গুড অ্যাকাউন্টিং প্র্যাকটিসের’ সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এবং সঠিক।’ বন্ধু মহীউদ্দীন খান আলমগীরও এর প্রতিদান দিয়েছেন। সেই প্রসঙ্গ একটু পরেই আসছে।
শুধু মহীউদ্দীন খান আলমগীরই নয়, কুকসনের বন্ধু তালিকায় এরকম গুরুত্বপূর্ণ আরও অনেকেই আছেন। আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের আরেক নেতা সালমান এফ রহমানও কুকসনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। প্রভাবশালীদের সঙ্গে তিনি সব সময়েই খাতির রক্ষা করে চলেন। এই প্রভাবশালীদের মধ্যে শিল্পপতি, বিদেশি বিনিয়োগকারী, বহুপাক্ষিক সংস্থাসহ জাতিসংঘের নানা সংস্থাও রয়েছে।
তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ বাংলাদেশে আমেরিকান চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি ছিলেন। বিনিয়োগকারী না হয়েও তিনি কী করে আমেরিকান চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি হলেন, বিষয়টা বোধগম্যতার বাইরে। হয়ত, বিনিয়োগকারীদের চেয়ে ট্রেড ইস্যুগুলো অর্থনীতিবিদ হিসেবে তিনি বেশ ভালোই বোঝেন এবং আমেরিকান বিনিয়োগকারীদের এখানে এমন একজনকেই দরকার যার সঙ্গে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি মিলে, এ কারণেই তিনি চেম্বারে ঢুকতে পেরেছিলেন।
কুকসন নিয়মিতভাবেই উচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারণী সংলাপগুলোতে থাকেন। দাতাদের পরামর্শক হিসেবে তার নাম থাকায় এনজিওগুলো প্রায়ই এ ধরনের কর্মসূচিতে তাকে নিয়ে যায়। এর মাধ্যমে তার যোগাযোগ ও প্রভাব বলয় বাড়তে থাকে। (সূত্র: ৫)
২৮ মার্চ, ২০০৫ তারিখে ‘ডেইলি স্টারে’ প্রকাশিত একটি খবর অনুসরণ করলে এদেশে কুকসনের সামাজিক পরিধি সম্পর্কে ধারণা মেলে। সাবেক আমেরিকান চেম্বারের নেতা হওয়ার কল্যাণে দেশের শীর্ষস্থানীয় আমলা, গবেষক, সাংবাদিক, রাজনীতিক ও শিক্ষকদের সঙ্গে তার সখ্য গড়ে ওঠে, যা কুকসনের প্রভাব বলয়ে শক্তি সঞ্চারিত করে। (সূত্র: ৬)
শুধু যে বেসরকারি লোকদের সঙ্গে কুকসনের ওঠাবসা, তা নয়। তিনি নিয়মিত মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে সংযোগ রাখেন। রাজনৈতিক নানা আলোচনায় হাজির হন। ২১ মে ২০১৩ তারিখে রাইজিংবিডি ডটকমের এক খবরে বলা হয়, ‘সকালে দেড় ঘণ্টাব্যাপী গুলশানের আমেরিকান ক্লাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরের সঙ্গে বৈঠক করেন মজীনা। এ সময় আরও ছিলেন ইউএসএইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ইশরাত জাহান ও আমেরিকান চেম্বার অব কমার্সের (অ্যামচেম) সাবেক সভাপতি ফরেস্ট কুকসন।’
এমনকি গেল নির্বাচনের আগে দেশে যখন প্রায় অচলাবস্থা চলমান, তখন গভীর রাতে গোপনে জামায়াতের ধনকুবের নেতাদের সঙ্গেও আলোচনায় বসেছেন কুকসন। আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক থাকাটা তাকে সেক্ষেত্রে বাধা দেয়নি। ৮ মে, ২০১৩ তারিখের এক খবরে ‘বাংলা এক্সপ্রেস’ জানায়, ‘রাত পৌনে আটটায় জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক ও মীর কাশেম আলীর ছেলে ব্যারিস্টার আরমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ঢাকায় মার্কিন চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি ফরেস্ট কুকসন। রাজধানীর অভিজাত এলাকার একটি ক্লাবে এ সাক্ষাৎ অনুষ্ঠান হয়। এখানে সোয়া ঘণ্টা তারা বাংলাদেশের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন বলে সূত্র দাবি করেছে।’
মার্কিন স্বার্থের পাহারাদার কুকসনের বাংলাদেশে এত প্রভাবশালী বন্ধু ও বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার গভীর মনোযোগ কিছু প্রশ্ন হাজির করে। আর তা হচ্ছে, এত ক্ষমতা দিয়ে কুকসন কী করছেন? কীভাবে তার এসব বন্ধুরা তাকে সেবা দিচ্ছে!
কুকসনের গোমর!
দীর্ঘদিন থেকে কুকসন দেশের বিভিন্ন ইংরেজি দৈনিক, যেমন ‘ডেইলি স্টার’, ‘ইন্ডিপেনডেন্ট’, ‘ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস’, ‘নিউ এইজে’ বিশেষজ্ঞ মতামত হিসেবে নানা ধরনের প্রবন্ধ লিখছেন। তিনি দেখাতে চেয়েছেন যে, তার সমস্ত মতামত ও বিশ্লেষণ বাংলাদেশের ওপর একান্তই প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা।
কুকসনের লেখালেখির মূল আলোচ্য বিষয় হচ্ছে উন্নয়ন এবং জ্বালানি। ৫ সেপ্টেম্বর ২০০৭ তারিখে তিনি কয়লানীতিতে কী থাকা উচিত, আর কী থাকা উচিত না এ নিয়ে একটি নিবন্ধ লেখেন। আর এতে তার পরিচয় হিসেবে লেখা হয় ‘অ্যা ফ্রিল্যান্সার কন্ট্রিবিউটর টু দ্য ডেইলি স্টার’!
মার্কিন স্বার্থের এত বড় পাহারাদার ‘ডেইলি স্টারে’ কন্ট্রিবিউটিং করেন, নিজেকে তিনি মুক্ত গবেষক পরিচয় দিচ্ছেন, বিষয়টা বেশ চটকদার। কিন্তু আমরা খুঁজে বের করেছি তার আসল গোমর। তথ্য-প্রমাণ স্পষ্ট করে বলছে যে, কুকসন মূলত এদেশে ব্যবসা করতে আসা কয়েকটি বিদেশি কোম্পানির এজেন্ট, বাংলায় যাদের বলা হয় দালাল। তা সত্ত্বেও তিনি যে গবেষক পরিচয়ে লিখছেন আর এদিকে বিদেশি কোম্পানির টাকা খাচ্ছেন, এটা নিঃসন্দেহে সমাজবিজ্ঞানের গবেষণা নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
জ্বালানি ও উন্নয়ন খাত নিয়ে তার এত লেখালেখির সূত্র ধরেই বলা যায়, এ সংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানেরই বেতনভূক কনসালটেন্ট হবেন তিনি। নিজে না স্বীকার করলেও কোম্পানি তো আর টাকা দিয়ে চুপ করে থাকবে না। ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত খনি করার চেষ্টারত বিদেশি কোম্পানি এশিয়া এনার্জির (বর্তমান নাম জিসিএম) তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ফরেস্ট কুকসনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ২০০৬ সাল থেকে।
এশিয়া এনার্জি তাদের ২০০৬ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, ‘এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের নির্দেশনা ও চাহিদা মোতাবেক ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্পের ওপর একটি ‘অর্থনৈতিক লাভ-ক্ষতির প্রতিবেদন’ তৈরির জন্য অর্থনীতিবিদ ফরেস্ট কুকসনকে যুক্ত করেছি। জানা গেছে, কুকসনকে নিয়োগ দেয়া হয় এশিয়া এনার্জির একজন ব্যবস্থাপক হিসেবে। যিনি সব ধরনের ঝুঁকি মোকাবেলা করে কোম্পানির স্বার্থ সরংরক্ষণে সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখতে পারবেন।’(সূত্র: ৭)
অর্থাৎ কুকসন এশিয়া এনার্জির নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েও কয়লা নীতি নিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে কী মাথায় রাখতে হবে আর কী ফেলতে হবে তা নিয়ে নির্দেশনা দেন! যদিও কোথাও উল্লেখ করেন না যে, তিনি খনি উন্নয়ন কোম্পানির হয়ে কাজ করছেন। এই তথ্যের পর আর এটা বিষয় বুঝতে কাউকে বিজ্ঞানী হতে হবে না যে, তার লেখা অসংখ্য মতামত-প্রবন্ধ আসলে তিনি যে-কোম্পানির টাকা খাচ্ছেন তাদের পক্ষে জনমত তৈরির চেষ্টা ছাড়া কিছুই না। যদিও এর ফলে অর্থ লগ্নিকারী ওসব প্রতিষ্ঠানের চেয়ে কুকসনের ব্যক্তিগত লাভই বেশি। ইংরেজি পত্রিকা যেহেতু বাংলাদেশের গণমানুষের পড়ার সুযোগ কম, তাই জনগণ এতে তেমন একটা প্রভাবিত হয় না। কিন্তু এর ফলে অভিজাত মহলে কুকসনের কদর বেড়েছে এবং বৈদেশিক নানা সংস্থার মধ্যে তার অর্থ উপার্জনের সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে কুকসনের এসব বিশেষজ্ঞ(!) লেখা বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা বোঝার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াচ্ছে, ভুল বার্তা পাঠাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশে উন্মুক্ত খনির বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীরা অনেক ক্ষেত্রেই ভুল বোঝাবুঝির শিকার হচ্ছেন।
এরকম কনসালটেন্সি, লেখালেখি বাবদ তিনি যে বিপুল অর্থ আয় করেন এটা সহজেই অনুমেয়। ঠিক কী পরিমাণ অর্থ তিনি আয় করেন, তার কতখানি প্রদর্শন করেন, কত আয় করেন, উপার্জিত অর্থ কোথায় রাখেন? এ নিয়ে আমাদের অনুসন্ধান চলছে। আগামীতে এগুলো নিয়ে খবর প্রকাশ করা হবে। তার কাজের পরিধিই আমাদের এই পথে টেনে নিচ্ছে।
কুকসনের তৎপরতা
কুকসন সর্বত্র নিজেকে মুক্ত গবেষক দাবি করলেও সম্প্রতি, গত ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ তারিখে ইংরেজি দৈনিক নিউ এইজ-এ প্রকাশিত একটি নিবন্ধের শেষে তার পরিচয়ে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘ফরেস্ট কুকসন একজন অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা। তিনি এশিয়া এনার্জির জন্য ফুলবাড়ী প্রকল্প নিয়ে সবিস্তারে একটি লাভ-ক্ষতির হিসাব দাঁড় করিয়েছেন। এর মধ্যে ফুলবাড়ী অঞ্চলের মোট জনসংখ্যা ও খনি সংশ্লিষ্ট জনগণের আর্থ-সামাজিক অনুসন্ধান, বিশেষ করে কৃষি বিষয়ক সমস্যা ও সুবিধাদির ওপর মনোযোগ দেয়া হয়েছে।’
এটা এখন দিনের আলোর মতো স্পষ্ট যে, এই জরিপকার্যটি হচ্ছে, মখা আলমগীর কর্তৃক এশিয়া এনার্জির পক্ষে প্রজ্ঞাপন জারিকৃত সেই জরিপকার্যটি। কুকসন ব্যক্তিগত সম্পর্ক খাটিয়ে সরকারকে দিয়ে এশিয়া এনার্জির পক্ষে ওই কাজটি উদ্ধার করেছিলেন। ২০০৬ সাল থেকে কুকসন এশিয়া এনার্জির হয়ে লবিং করে আসছেন। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মহীউদ্দিন খান আলমগীর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর তাকে বন্ধুত্বের প্রতিদান দেন। ফুলবাড়ীতে এশিয়া এনার্জির জরিপকার্য পরিচালনার জন্য তিনি পুলিশ পাঠান। মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করেন। কুকসন এভাবে তার লম্বা হাতকে কাজে লাগান। কিন্তু স্থানীয় জনগণের তীব্র প্রতিরোধের মুখে সেখানে তখন এশিয়া এনার্জি কাজ করতে পারেনি।
এশিয়া এনার্জির পক্ষে করে দেয়া কুকসনের বায়াসড জরিপের প্রশ্নপত্রের একটি নমুনা।
উল্লেখ্য, এশিয়া এনার্জি কর্পোরেশন খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলনের নিমিত্তে বাংলাদেশে একটি শাখা অফিস খোলার জন্য ১০ ডিসেম্বর ১৯৯৭ তারিখে বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি লাভ করে। তারা অসম এক চুক্তির মাধ্যমে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা আহরণের প্রকল্প নিয়ে অগ্রসর হতে চাইলে সারা দেশে এর বিরুদ্ধে জনমত তৈরি হয়। পরবর্তীতে ফুলবাড়ীর জনগণ ২৬ আগস্ট, ২০০৬ তারিখে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এশিয়া এনার্জিকে এলাকা থেকে বিতাড়িত করে।
কিন্তু কী আছে ওই জরিপে? কেনই বা এই জরিপ? এ নিয়ে অনুসন্ধানে নেমে ওই জরিপের প্রশ্নতালিকা বিশ্লেষণ করে আমরা হতবাক হয়েছি। এটা চ্যালেঞ্জ করে বলা যায়, কুকসন যেসব গবেষণা, জরিপ, অনুসন্ধান চালাচ্ছেন তা মোটেও বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক কোনো গবেষণা নয়, বরং যে কোম্পানি তাকে টাকা দিচ্ছে, তাদের পক্ষে তিনি দলিল বানাচ্ছেন, এটা এর বাইরে কিছুই না।
জিসিএম তাদের ২০১৪ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে লিখেছে, ‘স্থানীয় জনসাধারণের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন ঘটাতে, খনি উন্নয়ন ও প্রকল্প সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি তাদের বোঝাতে, খনি উন্নয়ন হলে স্থানীয় অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ কী লাভ হবে সে সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে বছরজুড়ে জিসিএম কাজ করে গেছে। এর সঙ্গে আরও যোগ হয়েছে জরিপ কার্যক্রম। খনি উন্নয়ন সম্পর্কে প্রকল্প এলাকার ভেতরে ও বাইরের জনগণের মনোভাব বুঝতে প্রায় ২০০০ নারী-পুরুষের ওপর একজন স্বাধীন কনসালটেন্টের মাধ্যমে চুক্তিবদ্ধভাবে জরিপ চালানো হয়েছে। আমরা সেই গবেষণালব্ধ মতামত বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন প্রস্তুত করছি। জরিপটি এই সিদ্ধান্ত টানে যে, একটি বিশাল গোষ্ঠী প্রকল্পের উন্নতি কামনা করলেও তারা চিন্তিত যে, কি উপায়ে পুনর্বাসন এবং ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হবে।’ (পৃষ্ঠা ৩)
অর্থাৎ জরিপ দিয়ে প্রমাণ করা হচ্ছে যে, ‘বিশাল গোষ্ঠী’ ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত খনি প্রকল্পের পক্ষে আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কেন এবং কার কাছে তাদের প্রমাণ করতে হচ্ছে! জ্বালানি সংশ্লিষ্টরা জানেন যে, মানবাধিকার, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিয়ে জিসিএমের বিরুদ্ধে পুরনো অভিযোগ রয়েছে। দুটো আন্তর্জাতিক এনজিও এ ধরনের অভিযোগ তুলেছিল তাদের বিরুদ্ধে। তারা ওই অভিযোগ থেকে বের হতে এই জরিপ করেছে এবং নিজেদের সপক্ষে প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে। যুক্তরাজ্য সরকারের এ বিষয়ক বিশেষ ফোরাম ন্যাশনাল কন্টাক্ট পয়েন্ট (এনসিপি) এর তদন্ত করেছে। শুনানিতে তারা শেষ পর্যন্ত এশিয়া এনার্জির জরিপকার্য দেখে সন্তুষ্ট হয়েছে। কিন্তু সেই জরিপে কী আছে, তারাও বলেনি। এশিয়া এনার্জির দেয়া যুক্তিরই পুনরাবৃত্তি করেছে। প্রতিবেদনে তারা লিখেছে, ‘জিসিএমের সরবরাহকৃত তথ্যগুলো কোম্পানি ব্যবসায়িকভাবে বেশ স্পর্শকাতর বলে মনে করে। এগুলো তখনই সরবারহ করা হবে যদি প্রকাশ না করার নিশ্চয়তা মেলে । ২০১২ সালের জরিপ এবং কোম্পানির পরিকল্পনা সংক্রান্ত জরিপ ও প্রতিবেদনকে এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। (সূত্র: ৮)
জিসিএম তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে যে, তারা স্থানীয় জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের জন্য ২০১২ থেকে বর্ধিত পরিসরে নানা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে সভা, কর্মশালা, জনগণের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে আলোচনা এবং জরিপ। যদিও জরিপটি বিবাদী পক্ষগুলোকে পাঠানো হয়নি, কিন্তু এনসিপিকে এটা পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে। তার ভিত্তিতেই এনসিপি মন্তব্য করেছে যে, জরিপে উঠে আসা তথ্যে স্থানীয় জনগণের সঠিক মনোভাবই প্রতিফলিত হয়েছে। যদিও এনসিপি এতে উঠে আসা সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কোনো মূল্যায়ন করেনি। (সূত্র: ৯)
জরিপ প্রতিবেদনটি জনগুরুত্বপূর্ণ ও ফুলবাড়ী বিষয়ক বিবাদী পক্ষগুলোর এটা পাওয়াটা অধিকার। তা সত্ত্বেও এটা এখনো গোপন। এটা প্রকাশের দাবি করে বার্তা পাঠানো হলেও এশিয়া এনার্জি থেকে এখনও কোনো উত্তর মেলেনি। তবে দিনাজপুরের বিরামপুর থানার খানপুর ইউনিয়নের একটি ঘটনা আমরা জানতে পেরেছি। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরের দিকে ওই এলাকায় ২-৩ জনের একটি দল জরিপ চালাতে যায়। জাতীয় পরিচয়পত্রকেন্দ্রিক জরিপ চালানোর কথা বলে তারা। গ্রামবাসীকে তারা জানায়, সরকার নতুন জাতীয় পরিচয়পত্র দিবে। তাই সবার পরিচয়পত্র নম্বর লাগবে। এরপর কয়েকজন স্থানীয় ইউপি মেম্বরকে ডেকে নিয়ে আসেন। তিনি বলেন, এরকম কিছু হলে আমি আগেই জানতাম।
এরকম ঘটনার কথা স্থানীয় আরও কয়েকটি সূত্র থেকে জানা গেছে। কুকসন সাহেবের জরিপ কাজেও জাতীয় পরিচয়পত্র খোঁজা হয়েছে। এছাড়া কিছুদিন আগে ফুলবাড়ী প্রকল্পের পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ৫০ হাজার লোকের স্বাক্ষর পাঠানো হয়েছিল। বিষয়টিকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করতে জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বরও তাতে দেয়া হয়। কুকসনের প্রতিষ্ঠান এই কাজটিও সম্পন্ন করেছে বলে ধারণা করছেন অনেকেই। তবে এসব ব্যক্তি সবাই খনি এলাকার অন্তত ১০ কিলোমিটার বাইরের লোক। হয়তো খনি এলাকায় কুকসনের সঙ্গীরা প্রবেশের সাহস পাননি। তবে এভাবেই সত্য-মিথ্যা দিয়ে তিনি নিজের স্বার্থোদ্ধার করছেন।
গ্যারি লাইয়ের ফটোকপি!
ফুলবাড়ী কয়লাখনি নিয়ে কুকসনের লেখালেখি পড়লে যে কেউ বুঝতে পারবেন, এখানে কোনো গবেষণা নেই। এগুলো এশিয়া এনার্জির প্রেস রিলিজ। আর বক্তব্য তুলনা করলে দেখা যাবে কুকসন আলাদা কেউ নন, অন্নদাতা গ্যারি লাইয়ের প্রতিমূর্তি কেবল। ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত খনির বিরুদ্ধে আন্দোলনরতদের বিরুদ্ধে দুজনে ঠিক একই ভাষায় কটূক্তি, গালমন্দ করেন। ৮ ডিসেম্বর, ২০১৪ তারিখে ডেইলি সান-এ প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে গ্যারি লাই আন্দোলনকারীদের একটি ‘গ্যাং’ হিসেবে অভিহিত করেন। শুধু বামপন্থিরাই এই আন্দোলন করছে বলে অভিযোগ করেন। এর আগে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে দৈনিক ইন্ডিপেনডেন্টে প্রকাশিত তিন পর্বের এক লেখায় কুকসনও একই কাজ করেন। তিনি লেখেন, ফুলবাড়ীতে কেজিবি স্টাইলে বিদেশি কোম্পানির ওপর হামলা হয়েছিল। তিনি আরও মন্তব্য করেন যে, এই আন্দোলন বাংলাদেশে দারিদ্র্য বাড়াচ্ছে।
ওই তিন পর্বের সিরিজ কুকসন ও গ্যারি লাইকে বুঝতে বেশ সাহায্য করে। লেখাটির প্রথম পর্ব ছাপা হয় ৩০ ডিসেম্বর ২০১২ তারিখে। কুকসন তাতে লেখেন, ‘সরকারের অনেক সমালোচনা করা যায়, কিন্তু রেন্টাল প্রকল্পটাই ছিল একমাত্র সঠিক পথ, যে পথ ধরে এগুনো যায়। এছাড়া বর্ধিত বিদ্যুৎ কোথা থেকে আসতো?’( সূত্র: ১০) অথচ এখন আর এটা কার না জানা যে, কিভাবে রেন্টাল আমাদের সর্বনাশ করেছে!
কুকসন তার লেখাটির শেষাংশে জ্বালানি সমস্যার জন্য আন্দোলনকারীদের দায়ী করে লেখেন, এরাই ‘জ্বালানি খাতের বর্তমান সঙ্কটের কারণ’। সুশীল সমাজ এ নিয়ে কিছু বলছে না দেখে তিনি লেখাটিতে উষ্মাও প্রকাশ করেছেন। লেখার দ্বিতীয় পর্ব ও তৃতীয় পর্ব আরও বেশি উগ্র! কোনো গবেষকের ভাষা এমন হতে পারে না।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের অনেক দিন হয়ে গেলেও মার্কিন মানসপটে এখনও খলনায়ক রাশিয়া। আর সব আমেরিকানের মতো কুকসনের মাথায়ও রাশিয়া ভীতি প্রবল। ৩১ ডিসেম্বর ২০১২ তারিখে একই পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধটির দ্বিতীয় পর্বে কুকসন লেখেন, ‘এই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীরা ও তাদের অনুসারীগণ কেজিবি হ্যান্ডবুক থেকে শেখা এজিটপ্রপ টেকনিক বেশ দক্ষতার সঙ্গেই কাজে লাগিয়েছে। বিস্ময়করভাবে আমরা নিউক্লিয়ার প্রযুক্তি কিংবা গ্যাস ফিল্ড স্থাপনে গ্যাজপ্রমের প্রচেষ্টা নিয়ে কিছুই শুনলাম না!…
ফুলবাড়ীর সাম্প্রতিক আন্দোলনে (নভেম্বর ২০১২) জামায়াত-বিএনপিও নিজেদের ভাসিয়েছে এই রাশিয়ান ছাড়া অন্য সব বিদেশিদের প্রতি বিষাক্ত মনোভাব ছড়ানো এবং মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ভাবমূর্তি নষ্ট করার উন্মত্ত জোয়ারে।…
সরকার চুপচাপ দেখে গেল। এ ছিল অত্যন্ত ব্রিলিয়ান্ট পারফরমেন্স। কেজিবির ভূতেরা এখন হয়ত খুশিতে আত্মহারা। ভাববার বিষয় এদের খরচ জোগায় কে? টকশোর আলোচকরা এদের উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন। অভিজাতেরা কৃষকের মেয়েকে ঠেলে দিচ্ছেন পুরোনো দাসত্বের পথে। নারীবাদী সৈনিকেরা কোথায় এখন?’ (সূত্র: ১১)
কুকসনের এই ভাষা নিয়ে তেমন কোনো কথা হয়নি। ফলে লেখাটির তৃতীয় পর্বে গিয়ে তিনি আরও বেশি অপলাপ শুরু করেন। ১ জানুয়ারি, ২০১৩ তারিখে তিনি লেখেন, ‘এলাকার ভূ-প্রকৃতি কী বলে? প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুব বেশি কিছু বলতে হয় না। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার কোন বিকল্প নেই। এ বিষয়ে দ্বিমতেরও সুযোগ নেই।…
উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তুলতে না দেয়ার সম্পূর্ণ অধিকার বাংলাদেশের আছে। কিন্তু এ নিয়ে কোন আইনগত পরিবর্তন আনলে যদি এশিয়া এনার্জির প্রকল্প বাতিল হয়ে গেলে তার ক্ষতিপূরণ দিতেই হবে।…
অঙ্কটা হলো ১০০ থেকে ১২০ মিলিয়ন…
খনি প্রকল্পের রেট অফ রিটার্নের হার ধরতে হবে ৩৫ বছরের জন্য ১৫% করে। ৭% ডিসকাউন্ট ফ্যাক্টর হিসাব করে এর বর্তমান মূল্য দাঁড়ায় ২০০-২২০ মিলিয়ন ডলার। বিনিয়োগকারীরা এই এক্সপেকটেড রেট অফ রিটার্নকে বাস্তবসম্মত বলেই মত দেবেন।’
এভাবেই খুব খোলামেলাভাবে নিজেকে গবেষক পরিচয় দিয়ে গ্যারি লাইয়ের প্রেস রিলিজগুলো তিনি পত্রিকায় ছেপেছেন। আদতে কুকসন কার স্বার্থ কীভাবে রক্ষা করেন, তার লেখাগুলোই এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ। ১৪ জুলাই, ২০০৭ তারিখে ডেইলি ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেসে প্রকাশিত ‘অন দ্য ড্রাফট কোল পলিসি’ শীর্ষক নিবন্ধে কুকসন লেখেন, ‘যদি বাংলাদেশ তার কয়লাখনিগুলো উন্নয়ন করতে চায়, তাহলে রয়্যালটির হার বৃদ্ধির কোনো সুযোগ নেই।… রয়্যালটি পরিবর্তন, শুল্ক আরোপ ও অন্য যেকোনো অর্থনৈতিক তৎপরতাই খনি উন্নয়নের কার্যক্রমকে ধীর করে দিবে। এটা একটা বিপজ্জনক পথ।… রয়্যালটির হার ১৬ শতাংশ, ২০ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি করার ধারণাটা অর্থনৈতিক মূর্খতা!’
১৫ জুন, ২০০৮ তারিখে দৈনিক ইন্ডিপেনডেন্টে একটি মতামত-প্রবন্ধ লেখেন কুকসন। এটা লেখা হয় ঠিক তখনই, যখন এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ফুলবাড়ী কয়লা খনি উন্নয়ন প্রকল্প থেকে সরে যাচ্ছিল। তখন এশিয়া এনার্জির হয়ে কুকসন এডিবিকে বোঝাতে মিথ্যাচার করতেও পিছপা হননি। তিনি লেখেন, ‘এখানে উন্মুক্ত খননের বাইরে কোনো বিকল্প নেই। প্রযুক্তিগত যেসব সমস্যা হবে, তা এশিয়া এনার্জি কর্তৃক নিয়োগকৃত বিশ্ব মানের খনি প্রকৌশলীদের দিয়ে মোকাবেলা করা সম্ভব।’
আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর, জ্বালানি সঙ্কট নিয়ে কুকসন বেশ বড় একটি পলিসি প্রেসক্রিপশন তৈরি করেন। যা ২৬ এপ্রিল, ২০০৯ তারিখে দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকায় একটি আর্টিকেল হিসেবে ছাপা হয়। সালমান এফ রহমান এবং কুকসন দুজনে মিলে এটি তৈরি করেন। তাতে তারা লেখেন, ‘ফুলবাড়ী এবং বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি থেকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনে উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নিতে হবে… এখন প্রয়োজন উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনে মাল্টি-বিলিয়ন ডলার প্রোগ্রাম হাতে নেয়া।’
‘২৬ আগস্ট, এবং ফুলবাড়ী কয়লাখনি’ শীর্ষক এক মতামতে কুকসন লেখেন, ‘এশিয়া এনার্জির ওপরে আক্রমণ এবং এ ধরনের যুক্তিহীন কাজের পেছনে আছে নির্বোধ, বাতিল সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি এবং কিছু লোকের বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগের প্রতি বিতৃষ্ণা’। তিনি মতামত দেন, ‘এ ধরনের মূল্যবান কৃষি জমিকে ধ্বংস হতে দেয়া যাবে না বলে এক ধরনের মতামত আছে, এ বক্তব্য একেবারেই তাৎপর্যহীন। যদি একটা প্রযুক্তি ব্যবহার করে এক বিলিয়ন ডলার আয় করা যায় এবং বিকল্প ব্যবস্থায় আয় হয় বিশ মিলিয়ন, তাহলে কোনটা হাতে নেয়া উচিৎ?’ (সূত্র: ১২)
কিসের ভিত্তিতে কুকসন এ ধরনের মন্তব্য করলেন? এই বক্তব্যের একাডেমিক ভিত্তি কতটুক, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। খনি কোম্পানির হয়ে ‘মুক্ত গবেষক’ সাজা এবং দেশ বিদেশে বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থ নিয়ে মিথ্যাচার করাসহ এসমস্ত অভিযোগ নিয়ে কথা বলতে আমরা যোগাযোগ করি কুকসনের বনানীস্থ অফিসের সঙ্গে। কুকসনের সাক্ষাৎকার নিতে চাই জানানো হলে সেখান থেকে বেলায়েত নামক একজন জানান যে, তিনি দেশের বাইরে আছেন।
তথ্যসূত্র
১। http://www.washingtonpost.com/wp-dzn/content/article/2010/02/24/AR201002…
২। http://www.nytimes.com/2000/03/20/world/shards-of-misery-not-far-from-cl…
৩। http://www.nytimes.com/1998/09/07/world/monsoon-hangs-on-swamping-bangla…
৪। http://www.nytimes.com/1996/01/27/world/economic-surge-in-bangladeshunde…
৫। http://www.igs-bracu.ac.bd/event/roundtable-discussion
৬। http://archive.thedailystar.net/2005/03/28/d50328060672.htm
৭। http://www.gcmplc.com/ir/gcm/pdf/GCM_Interim_2006.pdf, p 7
৮। UK-NCP final report, paragraph-22b, p 8
৯। UK-NCP final report, paragraph-22b, p 17
১০। http://www.independentarchive.info/index.php?option=com_content&view=art…
১১। http://www.independentarchive.info/index.php?option=com_content&view=art…
১২। http://news.bbc.co.uk/2/hi/business/5080386.stm