?> কয়লা উত্তোলন পদ্ধতি নিয়ে কিছু কথা « NCBD – National Committee of Bangladesh

Sunday, October 26th, 2014

কয়লা উত্তোলন পদ্ধতি নিয়ে কিছু কথা

প্রাকৃতিক গ্যাসের পর কয়লাই হলো বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিকল্প জ্বালানি ভাণ্ডার, তাতে সন্দেহ নেই। জ্বালানি শক্তির অপর নাম বিশ্বশক্তি। বিশ্বে সমৃদ্ধ জাতি হতে হলে জ্বালানি নিরাপত্তার বিকল্প নেই। মধ্যপ্রাচ্যে চরম অশান্তির মূল কারণ খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস, যার নিয়ন্ত্রণ নিয়েই মূলত ইরাক, ইরান-ইরাক ও আফগান যুদ্ধ। লিবিয়া ও মিসরে সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তন, মধ্য এশিয়ার কাস্পিয়ান অঞ্চলে চলমান অস্থিরতা এসব কিছুর পেছনে আসলে জ্বালানির নিরাপদ সরবরাহের বিষয়টি সরাসরি জড়িত। বিশ্বে মোট ব্যবহূত জ্বালানির ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ মেটানো হয় কয়লার মাধ্যমে এবং বিশ্বে মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ৪১ দশমিক ৫০ শতাংশ উৎপাদন হয় কয়লা থেকে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ জ্বালানি সংকট নিরসনে কয়লার ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৫৯-২০১৪ পর্যন্ত দেশে শনাক্তকৃত কয়লাবেসিনের সংখ্যা ১৩টি, যার সবই উত্তরবঙ্গের বৃহত্তর দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া জেলার ভূগর্ভে অবস্থিত। দিনাজপুর জেলার বড়পুকুরিয়া, ফুলবাড়ী ও দীঘিপাড়া, রংপুর জেলার খালাসপীর এবং জয়পুরহাটের জামালগঞ্জ মিলে মোট পাঁচটি কয়লাবেসিনে এ পর্যন্ত নির্নীত কয়লার পরিমাণ প্রায় ৩ হাজার ৩০০ মিলিয়ন টন, যার তাপ উৎপাদনক্ষমতা ৯১ টিসিএফ গ্যাস ব্যবহারের সমান। অর্থাৎ বাংলাদেশে বর্তমানে মজুদ প্রাকৃতিক গ্যাসের (১৫ টিসিএফ) প্রায় ছয় গুণ চাহিদা কয়লা থেকে মেটানো সম্ভব হবে। এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত পাঁচটি কয়লাবেসিনের একটা গড় হিসাব এটি। এছাড়া শনাক্তকৃত আরো আটটি কয়লাবেসিন যেমন— দিনাজপুর জেলার নবাবগঞ্জ, বুড়িরডোবা, শিমনগর ও ডাঙ্গাপাড়া বেসিন, রংপুর জেলার ওসমানপুর ও বদরগঞ্জ বেসিন, নাটোরের সিংড়া বেসিন এবং বগুড়ার কুচমা বেসিন তো রয়েছেই। সব মিলে এটা পরিষ্কার যে, আমরা যদি কয়লার ক্ষেত্রে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারি, তাহলে দেশের জ্বালানি সংকটের উত্তরণ ঘটিয়ে স্বাবলম্বী হওয়া সম্ভব। কিন্তু কয়লা উত্তোলন ও ব্যবহারের জন্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর করছে সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর।

ভূতাত্ত্বিক অবস্থানভেদে ভূগর্ভস্থ কয়লা সাধারণত দুটি পদ্ধতি প্রয়োগ করে উত্তোলন করা হয়। একটির নাম উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি (Open-pit mining method) এবং অন্যটি ভূগর্ভস্থ খনন পদ্ধতি (Underground mining method)। সাধারণত কয়লাস্তরের অবস্থান যদি মাটির ১২০-১৫০ মিটার গভীরতার মধ্যে হয় এবং কয়লাস্তরটির উপরে যদি কোনো পানিবাহীস্তর, জনবসতি, উর্বর আবাদি জমি না থাকে; তাহলে উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি প্রয়োগ করে অর্থাৎ কয়লাস্তরের ওপর থেকে সব মাটি ও পাথরের স্তর সরিয়ে কয়লা উত্তোলন করা হয়। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ অস্ট্রেলিয়া। আর কয়লাস্তরের অবস্থান যদি মাটির ১২০-১৫০ মিটার গভীরতায় হয় এবং কয়লাস্তরগুলো যদি আঞ্চলিক পানিবাহীস্তরের নিচে অবস্থান করে সেক্ষেত্রে ভূগর্ভস্থ খনন পদ্ধতি প্রয়োগ করে কয়লা আহরণ করা হয়। বাংলাদেশে আবিষ্কৃত পাঁচটি কয়লাক্ষেত্রের কয়লাস্তরগুলো বিশাল আঞ্চলিক পানিবাহীস্তরের নিচে অবস্থিত, যার সরাসরি উপরেই রয়েছে ঘনবসতিপূর্ণ গ্রাম, হাটবাজারসহ উর্বর আবাদি জমি। বিশ্বের কোনো দেশেই ঘনবসতিপূর্ণ ও উর্বর আবাদি জায়গায় উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের নজির নেই। এমনকি অস্ট্রেলিয়ার মতো অতি কম ঘনবসতিপূর্ণ দেশেও আবাদি জায়গায় উন্মুক্ত পদ্ধতিতে মাইনিং করার বিরুদ্ধে সে দেশের মানুষ খুবই সোচ্চার। অস্ট্রেলিয়ার সুরাট বেসিন, গ্যালিলি বেসিন, ওয়াশপুল কোল প্রজেক্ট, রেডহিল কোল প্রজেক্ট, বার্টন প্রজেক্ট, এল্লেনসফিল্ড প্রজেক্ট এবং ওয়াল্লানবাহ প্রজেক্ট এগুলো সবই পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত, যেগুলো জনবসতি এলাকা থেকে শত শত কিলোমিটার দূরে।

বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনা করে জানা যায়, অস্ট্রেলিয়ায় উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে মাইনিং করতে কয়লাস্তরের গভীরতা ভূগর্ভে সর্বোচ্চ ১২০-১৫০ মিটার পর্যন্ত বিবেচনা করা হয়। তবে তা অবশ্যই জনবসতিবিহীন, অনুর্বর ও অনাবাদি এলাকায় হতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, ওয়াশপুল কোল প্রজেক্টে কয়লাস্তর প্রায় ৬০ মিটার গভীরতায় অবস্থিত। রেডহিল কোল প্রজেক্টে ১০০ মিটার গভীরতা পর্যন্ত উন্মুক্ত পদ্ধতিতে এবং এর পর নিচের দিকে অর্থাৎ ১৫০-৩০০ মিটার পর্যন্ত গভীরতায় ভূগর্ভস্থ মাইনিং পদ্ধতিতে কয়লা আহরণ করা হচ্ছে। বার্টন প্রজেক্ট, এল্লেনসফিল্ড প্রজেক্ট এবং ওয়াল্লানবাহ প্রজেক্টে খনির গভীরতা যথাক্রমে ১০০, ১২০ ও ৯০ মিটার। এমনকি কাপ্পাবেল্লা খনিতে ১৫০ মিটার গভীরতা পর্যন্ত উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি এবং এর পর নিচের দিকে ভূগর্ভস্থ মাইনিং করা হয়েছে। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের রাজস্থান প্রদেশের চান্দমারী কপার খনির সর্বোচ্চ গভীরতা ১৪৮ মিটার। ভারতের বিহার রাজ্যের লাজকুরা কয়লা খনি, যেখানে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খনি উন্নয়ন করা হয়েছে, সেখানে কয়লাস্তরের উপরিভাগে শিলাস্তরের পুরুত্ব মাত্র ২২ মিটার। বিহার রাজ্য তথা সমগ্র ভারতের অন্যতম বৃহৎ কয়লা খনি হলো ঝারিয়া কয়লা খনি, যা দৈর্ঘ্যে প্রায় ৪০ ও প্রস্থে প্রায় ১২ কিলোমিটার। ৫০টি কয়লাস্তর নিয়ে গঠিত বেসিনটিতে মোট মজুদের পরিমাণ ১৭ হাজার ৭৭ মিলিয়ন টন। এখানে ৭০ মিটার গভীরতা পর্যন্ত উন্মুক্ত পদ্ধতিতে এবং এর পর থেকে নিচের দিকে ভূগর্ভস্থ মাইনিং করা হয়েছে। এসব হলো বাস্তব উদাহরণ। অনেকেই জার্মানির কয়লা খনিগুলোর উদাহরণ দিয়ে থাকেন। যদি তাদের প্রশ্ন করা হয়, জার্মানির কয়লা খনিগুলোর ভূতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট ও পানিবাহীস্তরের অবস্থান ব্যাখ্যা করুন। কিছু লোককে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করে কোনো সদুত্তর পাইনি। আসলে জার্মানির অধিকাংশ উন্মুক্ত কয়লা খনিতে কয়লাস্তরের অবস্থান বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক অবস্থানের ঠিক বিপরীত। অর্থাৎ বাংলাদেশের কয়লাবেসিনগুলোয় কয়লাস্তরের অবস্থান যেখানে আঞ্চলিক পানিবাহীস্তরের সরাসরি নিচে, জার্মানিতে কয়লাস্তরের অবস্থান সেখানকার আঞ্চলিক পানিবাহীস্তরের সরাসরি উপরে।

উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করতে যে দুটি বৃহৎ নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করবে তার একটি হলো, কয়লাস্তরের গভীরতা (যেমন ফুলবাড়ীতে ১৫০-৩০০ মিটার, বড়পুকুরিয়ায় ১৩৫-৪২০ মিটার গভীরতায় অবস্থিত) এবং অন্যটি হলো কয়লাস্তরের উপরিভাগের বিশাল পানিবাহীস্তর, যা ১০০-১২৫ মিটার পুরু। এছাড়া অতি উর্বর আবাদি জমি, ঘনবসতিপূর্ণ জনবহুল এলাকায় পরিবেশগত বিপর্যয় প্রভৃতি বিষয়তো রয়েছেই। এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। সেটি হলো— অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক ব্রোকেন হিল প্রোপ্রাইটরি (বিএইচপি) নামক কোম্পানির টার্গেট ছিল, ফুলবাড়ী কয়লাবেসিনে যদি ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ১০০ মিটার গভীরতার মধ্যে কয়লার সন্ধান মিললে এখন থেকে উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা হবে, অন্যথায় নয়। পাপুয়া নিউগিনির একটি প্রজেক্টের ভয়াবহ পরিবেশগত বিপর্যয় ও তত্সংশ্লিষ্ট অর্থদণ্ড থেকে অর্জিত শিক্ষার আলোকে ওই কোম্পানি ফুলবাড়ীতে ১০০ মিটার গভীরতায় কয়লার অনুসন্ধান পাওয়ার টার্গেট করেছিল। কিন্তু ড্রিলিং শেষে ভূগর্ভের ১৫০-৩০০ মিটার গভীরতার মধ্যে কয়লার অবস্থান নিশ্চিত হওয়ার পর সেটা দুরাশায় পরিণত হয় এবং কোম্পানি ফুলবাড়ীতে তাদের মিশন শেষ করে। পরবর্তীতে ফুলবাড়ী বেসিনের লিজ নেয় মাইনিং বিষয়ে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ এশিয়া এনার্জি নামের একটি বিদেশী কোম্পানি। এশিয়া এনার্জির ন্যূনতম কোনো মাইনিং অভিজ্ঞতা নেই এ কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করতে গিয়ে তত্কালীন সরকার চরম বিপাকে পড়েছিল।

উল্লিখিত তথ্যউপাত্তের ভিত্তিতে এটা সুস্পষ্ট, ফুলবাড়ী বেসিন ও বড়পুকুরিয়ার উত্তরাংশে এশিয়া এনার্জির প্রেসক্রিপশনে Institute of Water Modeling (IWM) কর্তৃক তৈরি করা রিপোর্টের আলোকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে মাইনিং করলে ভয়াবহ পরিবেশগত বিপর্যয় অনিবার্য। কারণ মাইনিং বিষয় নিয়ে বৈজ্ঞানিক মডেলিং করার পূর্ব-অভিজ্ঞতা আইডব্লিউএমের নেই। ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে আইডব্লিউএম প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে জিওলোজিক্যাল, হাইড্রোজিওলোজিক্যাল ও জিওটেকনিক্যাল ডাটাবেজের ভিত্তিতে কয়লা খনির ডিজাইন করা, উন্মুক্ত খনির ডিজাইনের ভিত্তিতে কয়লা খনি করার সময় প্রতি সেকেন্ড বা মিনিট অথবা ঘণ্টায় কী পরিমাণ পানি খনির ভেতর দিকে প্রবাহিত হবে, তার পরিমাণ নিরূপণ করা, ডিওয়াটারিং রেট নিরূপণ করা, খনিটি ৩০-৪০ বছর ধরে চলমান অবস্থায় খনির চারদিকের ভূগর্ভস্থ পানিস্তর কত মিটার পর্যন্ত নিচে নেমে যাবে এবং কত কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত তার সরাসরি প্রভাব পড়বে, এসব বিষয় নিয়ে বৈজ্ঞানিক মডেলিং করার পূর্ব-অভিজ্ঞতা আইডব্লিউএমের নেই। প্রতিষ্ঠানটির কয়লা খনি-সংক্রান্ত উল্লিখিত বিষয়গুলো নিয়ে কোনো বৈজ্ঞানিক মডেলিং করা এবং এ-সংক্রান্ত কোনো গবেষণামূলক বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ ISI তালিকাভুক্ত আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হওয়ার কোনো রেকর্ড Google Scholar নামক বিশ্ববিখ্যাত ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়নি। প্রায় গবেষণাজ্ঞানশূন্য ও অনভিজ্ঞ একটি প্রতিষ্ঠানকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে মাইনিং করার মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়ে মডেলিং করার সিদ্ধান্ত খুবই বিস্ময়কর ঘটনা। আবার সেই সিদ্ধান্তের আলোকে তিন মাসের মধ্যে বড়পুকুরিয়ার উত্তরাংশ থেকে উন্মুক্ত খনি পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের জন্য ১০ জুলাই জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর ঘোষণার বিষয়টা একদিকে যেমন তুঘলকি কাণ্ড, অন্যদিকে তেমনি এশিয়া এনার্জির এজেন্টদের পাতানো ফাঁদে পা দেয়ার মতো ঘটনা। এশিয়া এনার্জির প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী তৈরি এবং মাইনিং বিষয়ে একেবারে অনভিজ্ঞ আইডব্লিউএমের বিতর্কিত রিপোর্ট দেশী-বিদেশী বিজ্ঞানী মহলে ও সচেতন জনতার কাছে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না। এতে ২০০৬ সালের ২৬ আগস্টে দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে ঘটে যাওয়া হূদয়বিদারক ট্র্যাজেডির মতো আরেকটি ট্র্যাজেডি বড়পুকুরিয়া এলাকায় সৃষ্টি হলে তা হবে আরো বেদনাদায়ক। বড়পুকুরিয়ার উত্তরাংশে উন্মুক্ত খনির প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে গণবিক্ষোভ যদি ২০০৬ সালের ফুলবাড়ীর মতো চরম আকার ধারণ করে, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে ঘটনা এতদূর গড়াতে পারে যেকোন, কয়লা উত্তোলন অত্যাধুনিক পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহারও অনিশ্চিত করে তুলতে পারে এবং দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা হুমকির মুখে ঠেলে দিতে পারে।

প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক কয়লাসম্পদকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রেখে দেয়ার অর্থ দেশপ্রেমিক বিজ্ঞমহল এ অর্থে ধরে নিয়েছে যে, কয়লাকে অবশ্যই ব্যবহার করা হবে, তবে তা উন্মুক্ত খনন পদ্ধতির মতো পরিবেশ বিপর্যয় সৃষ্টিকারী পদ্ধতিতে নয়, বরং তা হবে নিকট ভবিষ্যতে আগত নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে। এ মর্মে আমি কিছু নতুন প্রযুক্তির কথা অবহিত করতে চাই। বর্তমানে চলমান বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির উত্তোলনক্ষমতা মোট মজুদের ৯ থেকে বৃদ্ধি করে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত করা সম্ভব যে প্রযুক্তি ব্যবহার করে তার নাম Longwall Top Coal Caving (LTCC). উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি ব্যবহার না করেও যে কোনো খনি থেকে মোট মজুদের প্রায় ৮০ শতাংশ কয়লা LTCC পদ্ধতিতে উত্তোলন করা যায়। এ পদ্ধতিতে কয়লা কাটার পর যে অংশ থেকে কয়লা আহরণ করা হয়, ভূগর্ভের সে ফাঁকা জায়গাটিকে বালি দ্বারা ভরাট করে পরিবেশগত সমস্যা রোধ করা যায়। যেমন খনির উপরিস্থ কৃষি জমির কোনো অবনমন হবে না, পানিস্তরের কোনো সমস্যা হবে না, জনগণকে খনি এলাকা থেকে অন্যত্র চলে যেতে হবে না ইত্যাদি। সুতরাং পরিবেশবান্ধব এ পদ্ধতিতে কয়লার মোট মজুদের সিংহভাগ উত্তোলনের পাশাপাশি দেশের খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়টিও সুনিশ্চিত করবে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে তিস্তা ও যমুনায় যে বালির চর আছে, তা দিয়ে দেশের ৫০টির বেশি খনিতে কয়লা কাটার পর ভূগর্ভের ফাঁকা স্থান বালি দ্বারা ভরাট করেও শেষ করা যাবে না। প্রশ্ন আসতে পারে, এ পদ্ধতি আর্থিকভাবে কতটুকু সাশ্রয়ী। উত্তরে বলা যায়, আর্থিকভাবে সাশ্রয়ী বলেই তুরস্ক, পোল্যান্ড, চীন ও অস্ট্রেলিয়ায় LTCC পদ্ধতি এখন ব্যাপকভিত্তিতে ব্যবহার হচ্ছে। বিভিন্ন দেশের বৈজ্ঞানিক গবেষণার আলোকে এ লেখক একদল গবেষককে সঙ্গে নিয়ে যমুনা নদীর বিভিন্ন এলাকা থেকে বালি সংগ্রহ করে বিভিন্ন টেস্ট ও মডেলিং গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ পেয়েছে যে, কয়লা আহরণের পর যমুনার বালি দিয়ে খুব ভালোভাবে ভূগর্ভের ফাঁকা স্থান ভরাট করা যাবে এবং তাতে আর্থিক সাশ্রয়ের পাশাপাশি বহু কর্মসংস্থানও হবে।

নতুন আরেকটি পদ্ধতির নাম আন্ডারগ্রাউন্ড কোল গ্যাসিফিকেসন (Underground Coal Gasification, UCG)। ইউসিজি পদ্ধতিতে ভূপৃষ্ঠ থেকে একটি বোরহোল করে তার মধ্য দিয়ে অক্সিজেন ও পানি বা স্টিম পরিচালনা করে কয়লাস্তরকে ভূগর্ভে জ্বালানোর পর ভূ-অভ্যন্তরে যেসব গ্যাস উত্পন্ন হয়, তা ভূপৃষ্ঠ থেকে অপর একটি বোরহোলের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়। এ পদ্ধতিতে কয়লাস্তরকে সম্পূর্ণরূপে পোড়ানো হয় এবং প্রাপ্ত গ্যাস হলো মূলত হাইড্রোজেন-মিথেন মিশ্রণ এবং সামান্য পরিমাণে কার্বন মনো-অক্সাইড ও কার্বন ডাই-অক্সাইড। কোনো মাইনিং না করেই শুধু ইউসিজি প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করেও ভূগর্ভস্থ সম্পূর্ণ কয়লার ব্যবহার নিশ্চিত করা যেতে পারে। বিশ্বের প্রধান প্রধান কয়লা উৎপাদনকারী দেশগুলো বর্তমানে এ প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এ প্রযুক্তির প্রধান সুবিধা হলো— (১) প্রচলিত মাইনিংয়ের তুলনায় বিনিয়োগকৃত মূলধন ও উত্তোলন খরচ খুবই কম এবং অতিদ্রুত ইউসিজি প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করা সম্ভব, (২) উৎপাদিত গ্যাস দ্বারা বিদ্যুৎ উৎপাদন, হাইড্রোজেন উৎপাদন, ডিজেল ও মিথানলের মতো তরল জ্বালানি উৎপাদন করা যায়, (৩) এ প্রক্রিয়ায় কঠিন বর্জ্য পদার্থ ভূগর্ভেই আটকা পড়ে থাকে বলে এটা পরিবেশবান্ধব, (৪) উৎপাদিত গ্যাস থেকে রাসায়নিক জাতীয় পদার্থ যেমন, অ্যামোনিয়া ও অন্যান্য সার উৎপাদন করা যায়, (৫) ভূপৃষ্ঠের পানিদূষণের তেমন কোনো ভয় থাকে না ইত্যাদি। ইউসিজি প্রযুক্তি ব্যবহার করে পাইলট প্রজেক্টে সাফল্য অর্জনকারী দেশগুলো হলো— সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, ব্রিটেন ও দক্ষিণ আফ্রিকা। এ প্রযুক্তি সর্বপ্রথম ব্যবহার করে বাণিজ্যিকভাবে সফলতা অর্জন করে পাওয়ার সেক্টরে বিপ্লব ঘটায় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। এরপর ইউরোপে এ প্রযুক্তি প্রথম ব্যবহার করা হয় উত্তর স্পেন, ব্রিটেন ও বেলজিয়ামে। ২৩ আগস্ট ইউসিজি অ্যাসোসিয়েশনের নিজস্ব ওয়েবসাইট (http://www.ucgassociation.org) থেকে জানা গেছে, অস্ট্রেলিয়া, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ইউসিজি ব্যবহার শুরু হয়েছে এবং ভারত, কানাডা ও যুক্তরাজ্য শুরু করার পথে রয়েছে। এছাড়া বর্তমানে যেসব দেশে পাইলট প্রজেক্ট চলছে সেগুলো হলো— দক্ষিণ আমেরিকার ভেনিজুয়েলা, ব্রাজিল ও পেরু। এশিয়ার জাপান, মঙ্গোলিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, চীন, রাশিয়া, কাজাকিস্তান, পাকিস্তান, ভারত, তুরস্ক; আফ্রিকার অ্যাঙ্গোলা ও বতসোয়ানা, অস্ট্রেলিয়া, পাপুয়া নিউগিনি এবং ইউরোপের অনেক দেশ।

কিছু ব্যক্তি উপরে উল্লিখিত দুটি সফল প্রযুক্তিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে গোপন করছে অথবা প্রায়ই এসব সফল প্রযুক্তির বিপক্ষে ধূম্রজাল সৃষ্টি করে সরকারকে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধাগ্রস্ত করছে। এখানে উল্লেখ করা অত্যাবশ্যক যে, কানাডার মন্ট্রিলভিত্তিক বিশ্বখ্যাত ইউসিজি কোম্পানি Ergo Exergy’র মতে, অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক ইউসিজি প্রজেক্ট করার আগে কয়লাবেসিনগুলোর যে চারটি প্রধান ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন, সেগুলো হলো— (১) কয়লাস্তরের পুরুত্ব হতে হবে সর্বনিম্ন শূন্য দশমিক ৫ থেকে ৩০ মিটার বা তার অধিক, (২) কয়লাস্তরের ঢাল শূন্য থেকে ৭০ ডিগ্রির মধ্যে হতে হবে, (৩) কয়লাস্তরের গভীরতা হতে হবে সর্বনিম্ন ৩০ থেকে ৮০০ মিটার বা তার অধিক এবং (৪) তাপজননক্ষমতা হতে হবে প্রতি কিলোগ্রাম কয়লায় ৮-৩০ মেগাজুল। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত পাঁচটি কয়লাবেসিনের সবগুলোই যেমন— বড়পুকুরিয়া, ফুলবাড়ী, খালাসপীর, দীঘিপাড়া ও জামালগঞ্জ ইউসিজি প্রজেক্ট করার জন্য Ergo Exergy-র মতে, অত্যাবশ্যক চারটি ভূতাত্ত্বিক শর্তই শতভাগ পূরণ করেছে। এখানে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য অবহিত করতে চাই। ভারতের অভিজিত গ্রুপ সে দেশে তাদের ইউসিজি প্রজেক্ট সফল করার পর বাংলাদেশের জামালগঞ্জ বেসিন থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ইউসিজি করতে ২০১০ সাল থেকে আগ্রহ প্রকাশ করে আসছে। সাড়ে তিন বছরে (৪২ মাসে) পর্যায়ক্রমে তিনটি ধাপে প্রকল্প উন্নয়নকাজ সমাপ্ত করার পর জয়পুরহাটের জামালঞ্জ কয়লাক্ষেত্র থেকে ৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি সেখানে ৩০ বছর মেয়াদি একটি ইউরিয়া সার কারখানা স্থাপন করতে ২০১০ সালের মে মাসে অভিজিত গ্রুপ পেট্রোসেন্টারে যে প্রস্তাবনা পেশ করেছিল, তা পেট্রোবাংলার তত্কালীন চেয়ারম্যান ভালোভাবেই অবগত ছিলেন।

বাংলাদেশে বর্তমানে পাঁচটি কয়লাবেসিনে আবিষ্কৃত ভূগর্ভস্থ ৩ হাজার ৩০০ মিলিয়ন টন কয়লাসম্পদের শতকরা ৮০-১০০ ভাগ কয়লা ব্যবহার করার অত্যাধুনিক দুটি প্রযুক্তি যথাক্রমে LTCC ও UCG এখন হাতের মুঠোয়, যা বিশ্বের বহু দেশে ব্যাপকভিত্তিতে ব্যবহার হচ্ছে। অর্জিত বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও দেশের প্রতি দায়িত্ববোধের তাগিদে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কয়লাসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার কীভাবে করা হচ্ছে, তা বাস্তবতার ভিত্তিতে পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করা হলো। আশা করি, এর ভিত্তিতে জ্বালানি খাতকে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সঠিক গন্তব্যে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে সরকার দ্রুত সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে।

ড. মো. রফিকুল ইসলাম: শিক্ষক, পেট্রোলিয়াম অ্যান্ড মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

*লেখাটি ২৩ অক্টোবর ২০১৪ তারিখের বণিক বার্তায় প্রকাশিত হয়।

লিংক : http://www.bonikbarta.com/2014-10-24/news/details/17493.html