?> বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি কতটা যৌক্তিক? « NCBD – National Committee of Bangladesh

Friday, September 21st, 2012

বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি কতটা যৌক্তিক?

গত ২০ সেপ্টেম্বর ২০১২ বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) এক বিজ্ঞপ্তি’র মাধ্যমে বিদ্যুতের দাম পাইকারি পর্যায়ে গড়ে ১৭ শতাংশ এবং খুচরা/গ্রাহক পর্যায়ে গড়ে ১৫ শতাংশ  বৃদ্ধি করা হয়েছে যা ঘোষণার আগে থেকে অর্থাৎ ১ সেপ্টম্বর থেকে কার্যকর হবে। এর ফলে গ্রাহক পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৭৫ পয়সা ও পাইকারি পর্যায়ে ৬৮ পয়সা করে বেড়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় দাম পড়বে যথাক্রমে ৫ টাকা ৭৫ পয়সা এবং ৪ টাকা ৭০ পয়সা। এ নিয়ে এই সরকারের আমলে ৬ষ্ঠ বারের মতো বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো যার মাধ্যমে সরকার ক্ষমতায় আসার সময়ের তুলনায় বর্তমানে বিদ্যুতের দাম প্রায় দ্বিগুন হয়েছে। এর আগে গত ৬ জুন পিডিবি বিইআরসি’র কাছে পাইকারি বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির একটি প্রস্তাব পাঠায়। প্রস্তাবে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পক্ষে যুক্তি হিসেবে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির কথা বলা হয়। বলা হয় বিদ্যুতের পাইকারি মূল্যের বিক্রয় মূল্য প্রতি ইউনিট ৪.০২ টাকার বিপরীতে ২০১২-১৩ অর্থবছরে সম্ভাব্য সরবরাহ ব্যায় ইউনিট প্রতি ৬.৮৭ টাকা হবে ফলে ঘাটতি হবে ইউনিট প্রতি ২.৮৫ টাকা। এই ঘাটতি কমানোর জন্যই বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয় পিডিবি।

উৎপাদন মূল্য এবং বিক্রয় মূল্যের মধ্যে ঘাটতি থাকলেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানো যৌক্তিক কিনা সেই বিতর্কে ঢোকার আগে দেখা দরকার উৎপাদন মূল্যের এই বৃদ্ধির কারণ কি এবং তা কতটা যৌক্তিক। পিডিবির প্রস্তাবনা থেকে দেখা যায় ২০১০-১১ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহের ব্যয় ছিল প্রতি ইউনিট ৪.২০৫ টাকা, ২০১১-১২ সালে ছিল ৫.৪৭০ টাকা এবং ২০১২-১৩ অর্থ বছরে দাড়াবে ৬.৮৭ টাকা। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের পেছনে পিডিবি’র এই খরচ বৃদ্ধির কারণ কি? পিডিবি’র মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাটবনাতেই স্পষ্ট বলা হয়েছে: “তরল জ্বালানির ব্যবহার, বেসরকারি খাত হতে বিদ্যুৎ ক্রয় এবং জ্বালানী ব্যয়ের অংশ বৃদ্ধির কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে।”

দেখা যাচ্ছে বছর বছর বিদ্যুত উৎপাদনে জ্বালানী হিসেবে গ্যাসের অংশ কমছে এবং তেলের অংশ বাড়ছে। তেল ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ গ্যাস ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচের ৬ থেকে ৮ গুণ বেশি:

এই হিসেবগুলো পিডিবি’র প্রস্তাবনা থেকেই নেয়া। তেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ গ্যাসের চেয়ে বেশি হওয়ার পরও বছর বছর তেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে এবং যুক্তি দেয়া হচ্ছে গ্যাস সংকটের: “বিরাজমান গ্যাসের সরবরাহ ঘাটতি থাকায় এবং গ্যাস সবরাহ কমে যাওয়ায় গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনুপাত ক্রমশ কমে যাচ্ছে এবং ক্রমবর্ধমান চাহিদার বিপরীতে তরল জ্বালানিতে উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় সার্বিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে।”

২. উৎপাদন খরচ এবং বিক্রয় মূল্যের ঘাটতি কমানোর জন্য বিদ্যুতের বিক্রয় মূল্য বাড়ানোর দিকে সরকারের যত আগ্রহ তার সামান্যও যদি কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে থাকতো তাহলে গ্যাস সংকটের কথা বলে তেল ভিত্তিক বিদ্যুতের দিকে ঝুকতো না সরকার, গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর যথাযথ উদ্যোগ নিতো, গ্যাস ভিত্তিক বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করতো, পুরোনো বিদ্যুৎ কেন্দ্র মেরামত করে ও কম্বাইন্ড সাইকেলে রুপান্তরিত করে গ্যাসের অপচয় কমানোর উদ্যোগ নিতো। কিন্তু এর কোনটাই সরকার করছেনা। আর উৎপাদন খরচ কমোনোর বদলে বেশি খরচের বিদ্যুৎ উৎপাদনের দায় বারবার দাম বৃদ্ধির মাধ্যমে জনগণের ঘাড়ে চাপাচ্ছে।

“সরকারের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত উন্নয়নে পথ নকশা: দ্বিতীয় হালচিত্র” থেকে দেখা যায় দেশে গ্যাসের মজুদ ২০.৬ টিসিএফ থেকে বেড়ে ২৬.৮৪ টিসিএফ এ উন্নীত হওয়া স্বত্ত্বেও সেই মজুদ থেকে গ্যাস উত্তোলণের লক্ষমাত্রা বাড়ানোর বদলে উল্টো কমানো হয়েছে! পথ নকশায় ২০১৫ সাল নাগাদ গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষমাত্রা কমানো প্রসঙ্গে বলা হয়েছে: “গত বছরের হালচিত্রে জ্বালানি খাতে মোট ২৩২৩ এমএমসিএফডি(মিলিয়ন কিউবিক ফিট পার ডে) অতিরিক্ত গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও বর্তমান পুস্তিকায় তা হ্রাস করে ১৫৬০ ধার্য করা হয়েছে। জ্বালানি খাতের অতিরিক্ত গ্যাস উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা হ্রাস করার কারণ হলো বিদ্যুৎ খাতে যেভাবে পরিকল্পনা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব, সেভাবে জ্বালানি খাতে উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়। জ্বালানি খাতে ঝুকি বেশি।“

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সের প্রতি ৩টি কূপ খননে ২টি তে সাফল্য লাভের দৃষ্টান্ত থাকলেও আমরা দেখছি এভাবে ঝুকি এবং পুজি ও প্রযুক্তির অভাবের কথা বলে দেশের গ্যাস সংকটকে জিইয়ে রাখা হচ্ছে, গ্যাস সম্পদ বহুজাতিক কোম্পানির হাতে তুলে দিয়ে তাদের কাছ থেকে উচ্চমূল্যে গ্যাস কিনে জনগণের বিপুল অর্থ লুন্ঠন করা হচ্ছে, এমনকি পিএসসি নির্ধারিত উচ্চমূল্যেরও দ্বিগুণ মূল্যে বহুজাতিক কোম্পানির কাছ থেকে গ্যাস কিনতে বাধ্য করে পিডিবি’কে দেউলিয়া করার ব্যাবস্থা করা হচ্ছে। গত ১১ জুন ২০১২ তে বহুজাতিক সান্তোষকে তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রির অনুমোদন দিয়ে প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাস ৪.৮৬ ডলার বা ৩৯৯ টাকায় কেনার চুক্তি করানো হয়েছে পিডিবিকে দিয়ে যার ফলে সস্তা গ্যাসও সস্তা থাকছে না পিডিবি’র জন্য!

৩. পিডিবি’র বক্তব্য অনুসারে বিদ্যুৎ সরবরাহের খরচ বাড়ার আরেক কারণ হলো আইপিপি বা বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছ থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনা। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই ঘাটতি কমানোর জন্য উচিত ছিল বেসরকারি খাতের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনা ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা। কিন্তু আমরা দেখছি সরকার উল্টো বেসরকারি খাতের কাছ থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনার পরিমাণ বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। সরকারের পথ নকশা থেকে দেখা যায়, ২০১৬ সালের মধ্যে ১৩১৫৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে যার মধ্যে ৫৯১৯ মেগাওয়াট মাত্র সরকারি খাতে আর বেসরকারি খাতে যুক্ত হবে ৭২৩৫ মেগাওয়াট।

আবার সরকারি খাতে অর্থের অভাবের কথা বলে বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ সেক্টর তুলে দেয়া হলেও বেসরকারি খাতের অর্থও সরকারকে যোগার করে দিতে হচ্ছে, সার্বভৌম গ্যারান্টি দিতে হচ্ছে!যদি বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের চুক্তির ১ বছর পরেও অর্থের অভাবে কাজ শুরুই না হয়, ১ বছর সময় নষ্ট করার পর যদি সরকারকেই এখন সেই অর্থের ব্যাবস্থা করে দিতে হয় তাহলে সামিট, ওরিয়ন ইত্যাদি গ্রুপের হাতে বিদ্যুৎ খাত তুলে দেয়ার যুক্তি কি? অর্থটা পিডিবিকে যোগার করে দিলেই তো হয়!

সামিট গ্রুপের সাথে ৩৪১ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি হয় ২০১১ সালের মে মাসে। কথা ছিল ২০১৩ সালের মে মাসের মধ্যে উৎপাদনে আসবে যেখান থেকে ১ টাকা ৯০ পয়সা দরে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। কিন্তু এক বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও সামিট অর্থ জোগার করতে পারে নি। নির্দিষ্ট সময়ে অর্থ সংস্থান করতে না পারার খেসারত হিসেবে নিয়মানুযায়ী সামিট গ্রুপের জমা দেয়া ১২ মিলিয়ন ডলার পারফর্মেন্স গ্যারান্টি বাতিল করে পিডিবিকে কাজ দিয়ে দেয়া উচিত ছিল এতদিনে। তা তো হয়ই নি ,উল্টো এখন মামার বাড়ির আবদার করছে সামিট- সরকারকেই নাকি গ্যারেন্টি দিয়ে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক সহ বিভিন্ন বিদেশী বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে অর্থের ব্যাবস্থা করে দিতে হবে!

আবার ওরিয়ন গ্রুপের সাথে ৩টি কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র(আইপিপি) নির্মানের চুক্তি করেছে পিডিবি । ওরিয়ন গ্রুপ নিজে কাজটি করবে না, চাইনিজ কোম্পানি Long King এর সাথে জয়েন্ট ভেঞ্চারের মাধ্যমে বিল্ড-ওন-অপারেট ভিত্তিতে কাজটি করবে। ফলে বিদ্যুৎ খাত এভাবে বেসরকারি খাতে দেয়ার নামে বিদেশী পুজির হাতেই তুলে দেয়া হচ্ছে। কথা হলো, ওরিয়ন কিংবা চাইনিজ লং কিং কোম্পানি যদি ৩৬ মাসে ২টি এবং ৪৫ মাসে ১টি কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন করতে পারে তাহলে পিডিবি নিজে কেন কাজটা করতে পারবে না? ওরিয়ন গ্রুপ যদি ৪/৫টাকার মধ্যে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করার চুক্তি করতে পারে তাহলে রামপালে সুন্দরবন ধ্বংস করে ভারতীয় এনটিপিসি’র ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৮/৯ টাকা দরে বিদ্যুৎ কেনার আয়োজন কেন? কেন পরিবেশ ও অর্থনৈতিক বিবেচনা মাথায় রেখে পিডিবি নিজেই বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কাজ করবে না?

সরকারি খাতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য পিডিবি’কে দেয়ার মতো অর্থ থাকে না কিন্তু কুইকরেন্টালের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকার ভর্তুকী দেয়া কিংবা বিদেশী কোম্পানির কাছ থেকে দশগুণ বেশি দামে গ্যাস কেনার অর্থের তো অভাব হয় না।

৪. গত অর্থবছরে বিদ্যুতের উৎপাদন মূল্য ছিল প্রতি ইউনিট গড়ে ৫.৪৭ টাকা। পিডিবি’র মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব অনুসারে, তেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র গুলো এ বছর ৮০% প্ল্যান্ট ফ্যাক্টরে অর্থাৎ দিনের ৮০ ভাগ সময় জুড়ে চালানো হবে বলে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেয়ে হবে ৬.৮৭ টাকা। যে তেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র গুলো শুধু মাত্র পিকিং আওয়ারেই পূর্ণ ক্ষমতায় চালানো যায়নি সেগুলোর দিনের ৮০% সময় জুড়ে পূর্ণ ক্ষমতায় চালানোর সম্ভাবনা শূণ্য। স্রেফ কারিগরি বিবেচনাতেই তেল ভিত্তিক এসব পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট দিনের ৮০ ভাগ সময় জুড়ে চলার উপযুক্ত নয়। অথচ এগুলো ৮০ ভাগ সময় জুড়ে চলার কারণ দেখিয়েই বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে।

তেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ক্ষেত্রে উৎপাদন ক্ষমতার চেয়ে কম বিদ্যুৎ উৎপাদন হওয়ার ঘটনাই আমরা দেখেছি। এ বছরের গোটা এপ্রিল মাসের তেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর জেনারেশান রিপোর্ট যদি দেখি, তাহলে দেখা যায় ফার্নেস ওয়েল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ইন্সটল্ড ক্যাপাসিটি ১১৪৪ মেগাওয়াট হলেও এ মাসে দিনের সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল গড়ে ১২৭ মেগাওয়াট যা উৎপাদন ক্ষমতার মাত্র ১১% এবং সন্ধ্যা বেলা সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল গড়ে ৬৩২ মেগাওয়াট যা উৎপাদন ক্ষমতার মাত্র ৫৫%। একই ভাবে ডিজেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ইন্সটল্ড ক্যাপাসিটি ৬৫৭ মেগাওয়াট হলেও এ মাসে দিনের সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল গড়ে ১৪৭ মেগাওয়াট যা উৎপাদন ক্ষমতার মাত্র ২২% এবং সন্ধ্যা বেলা সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল গড়ে ২০০ মেগাওয়াট যা উৎপাদন ক্ষমতার মাত্র ৩০%। এর ফলে একদিকে জনগণ বিনা কারণে বিদ্যুৎ না পেয়েই ইউনিট প্রতি বাড়তি মূল্য পরিশোধ করছে এবং বাড়তি মূল্য দিয়েও লোড শেডিং এর যন্ত্রণা ভোগ করছে/করবে অন্যদিকে কুইক রেন্টাল প্ল্যান্টগুলোকে বসিয়ে রাখার জন্য সরকারকে জনগণের অর্থে কুইক রেন্টালের মালিকদের কাছে জরিমানা বাবদ রেন্টাল ভাড়া ঠিকই গুনতে হচ্ছে। দিনের পিক আওয়ারেই যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো ৩০%-৫৫% এর বেশি উৎপাদন করতে পারেনি, সেগুলোকে সারা বছর ধরে দিনের ৮০% সময়ে পূর্ণ ক্ষমতায় চালানোর কথা বলে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো স্রেফ প্রতারণা।

৫. পিডিবি’র মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাবনা এবং উপরোক্ত আলোচনা থেকে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির মূল কারণ গুলো সংক্ষেপে:

ক) গ্যাসের বদলে ক্রমশ তরল জ্বালানি ব্যাবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন

খ) গ্যাসের মজুদ বাড়লেও সেই অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সস্তায় গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধি না করা।

গ) বহুজাতিক কোম্পানির কাছ থেকে ক্রমশ বেশি দামে গ্যাস ক্রয়

ঘ) সরকারি খাতকে দুর্বল করে রেখে ক্রমশ বেসরকারি খাত থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ ক্রয়

অথচ এগুলোর কোনটাই অপরিহার্য ছিল না। সরকার ক্ষমতায় আসার সময় ১৩শ/১৪শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম উৎপাদিত হতো নষ্ট ও পুরাতন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে, এখনও এই পরিমাণ ক্ষমতার বিদ্যুৎকম উৎপাদিত হচ্ছে যেহেতু কোন সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া হয়নি নষ্ট ও পুরাতন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো মেরামত করার। গতকালের(২০ সেপ্টম্বর ২০১২) জেনারেশন রিপোর্ট থেকেও দেখা যাচ্ছে ১৫১১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম উৎপাদিত হচ্ছে এই কারণে। তাছাড়া পুরাতন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর তাপীয় কর্মদক্ষতা বা ইফিসিয়ান্সি বাড়ানো এবং সিম্পল সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্টগুলোকে কম্বাইন্ড সাইকেলে রুপান্তরিত করার মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত কম পরিমাণ গ্যাস ব্যাবহার করে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেত ফলে গ্যাস সংকট তেমন থাকতো না। তারপরও গ্যাস সর্বরাহ আরো বাড়ানোর সুযোগ ছিল।

সরকার ফাস্ট ট্র্যাক প্রোগ্রামের মাধ্যমে বিদেশী কোম্পানিকে দিয়ে ১০ কুপ খননের যে পরিকল্পনার মাধ্যমে আড়াই বছর সময় নষ্ট করেছে। ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট বাড়তি গ্যাস উৎপাদনের এই উদ্যোগটি ২০০৯ সালের অক্টোবরে শুরু হয়ে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা দেখলাম টেন্ডারে নির্বাচিত কোম্পানির মামলা মোকদ্দমা এবং নির্বাচিত কোম্পানির কাজ করতে অস্বীকৃতি ইত্যাদি নাটকের মাধ্যমে আড়াই বছরেরও বেশি সময় নষ্ট করার পর বিনাটেন্ডারে তিনগুণ বেশি খরচ করে রাশিয়ার কোম্পানি গ্যাজপ্রমকে কাজ দেয়া হলো। অথচ শুরুতেই বাপেক্সকে কুপ খননের দ্বায়িত্ব প্রদান করে সময় মতো অর্থ সরবরাহ করা হলে এতদিনে জাতীয় গ্রিডে বাড়তি গ্যাস সরবরাহ করা যেত যার মাধ্যমে চাইলে নতুন বড় গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু করা যেত।

রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো মেরামত, সংস্কার, দক্ষতা বৃদ্ধি, গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধি, নতুন বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন ইত্যাদি স্বল্প খরচের উদ্যোগ গুলো না নিয়ে কুইক রেন্টাল সহ বেসরকারি খাত থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনার দিকে ঝোকার ফলেই আজকে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বেড়ে বাড়তি ভর্তুকীর চাপ তৈরী করেছে যার দায় এখন বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর মাধ্যমে জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার তৎপরতা চলছে।

৬. এবার দেখা যাক, উৎপাদন মূল্য এবং বিক্রয় মূল্যের মধ্যে ঘাটতি থাকলেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানো অত্যাবশকীয় কি-না, জনগণের জন্য কল্যাণকর কি-না।

প্রথমত, ঘাটতি কমানোর জন্য উৎপাদন মূল্য যেন কম থাকে সেই উদ্যোগ নিতে হবে। উৎপাদন খরচ বাড়ানোর সমস্ত ম্যাকানিজম চালু রেখে বিক্রয় মূল্য বাড়ালে ঘাটতি কমে না, বরং দিনে দিনে ঘাটতি বাড়তে থাকে, ফলে বার বার দাম বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ে যা এই সরকারের আমলে ইতিমধ্যে ৫ বার দাম বাড়নোর পরও হাজার হাজার কোটি টাকা ঘাটতি’র ঘটনা থেকেই পরিস্কার বোঝা যায়।

দ্বিতীয়ত, তারপরও কোন কারণে যদি ঘাটতি রয়েই যায়, তাহলে ভর্তুকী প্রদান করতে হবে। বিদ্যুতের দাম বাড়লে যেহেতু গোটা অর্থনীতিতে মাল্টিপ্লায়িং ইফেক্টের কারণে বিদ্যুৎ ব্যাবহার করে উৎপাদিত সকল পণ্যের দাম বাড়ে এবং মূল্যস্ফীতির কারণে জনগণের দুর্ভোগ বাড়ে, তাই জনগণের দেয়া কর-ভ্যাটের অর্থের একটা অংশ জনদুর্ভোগ ঠেকানোর জন্য বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকী বাবদ বরাদ্দ করাই উচিত।

এ ক্ষেত্রে জনগণের টাকা জনগণের কাজেই লাগে যদি ভর্তুকীর অর্থ পাবলিক সেক্টরে যায়। কিন্তু বিদ্যুৎ খাত বেসরকারি করণ করা হলে, বেসরকারি খাত থেকে ক্রমশ বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনার অর্থ হলো পাবলিকের অর্থ প্রাইভেট সেক্টরে প্রদান, প্রাইভেট বিদ্যুৎ সেক্টরের বাড়তি মুনাফার নিশ্চয়তা বিধান- সেই বাড়তি অর্থ ভর্তুকী থেকেই আসুক কিংবা দাম বাড়িয়েই সংগ্রীহিত হোক- উভয় ক্ষেত্রেই তা কিন্তু পাবলিকেরই অর্থ। কাজেই বিদ্যুৎ খাতে জনগণের অর্থ জনগণেরই কাজে লাগানোর শর্ত হলো উৎপাদন খরচ কমানো এবং বেসরকারি খাতের হাত থেকে মুক্ত করে বিদ্যুৎ খাতে পাবলিক সেক্টরের কর্তৃত্ব নিশ্চিত করা।