?> কয়লা চুরি হয়েছে গভীর রাত পর্যন্ত « NCBD – National Committee of Bangladesh

Wednesday, July 25th, 2018

কয়লা চুরি হয়েছে গভীর রাত পর্যন্ত

বিকাল ৫টার মধ্যে খনি এলাকার কার্যক্রম শেষ করার কথা। এরপর শ্রমিক-বহিরাগতদের প্রবেশ পুরোপুরি নিষিদ্ধ। অথচ কয়লা খনির ইয়ার্ডে বিকাল ৫টার পরও ট্রাক প্রবেশ ছিল নিয়মিত ঘটনা। প্রতিদিন ১০০-১৫০ ট্রাক এখান থেকে কয়লা নিয়ে যেত। প্রতিটি ট্রাকে কয়লা থাকত ১০-১২ টন। কখনো কখনো ১৫ টনও। যদিও দাপ্তরিকভাবে কয়লার হিসাব রাখা হতো প্রতি ট্রাকে পাঁচ-ছয় টনের। অবশিষ্ট কয়লা বিক্রির নামে চুরি হয়ে গেছে। কয়লার এ অবৈধ কারবার চলেছে ভোর থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত।

বড়পুকুরিয়ার কয়লা পরিবহনে নিয়মিত ট্রাক ভাড়া দেন মো. মতিহার। তিনি বলছিলেন, বরাদ্দের চেয়ে বেশি কয়লা চুরি করে বিক্রি করা হয়েছে। ভোর থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত চলেছে এ কারবার। কয়লার কি পাখা আছে যে, উড়াল দিয়ে চলে যাবে? বিভিন্ন ঠিকাদারের নামে বরাদ্দকৃত কয়লার চেয়ে বেশি পরিমাণে বিক্রি করেছেন কর্মকর্তারা।

বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় কয়লা রাখার পর অতিরিক্ত কয়লা বাইরে বিক্রির অনুমতি ছিল বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানির। সে সুযোগই কাজে লাগিয়েছেন কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা। বিভিন্ন টেন্ডারের বিপরীতে যে পরিমাণ কয়লা বরাদ্দ দেয়া ছিল, তার কয়েক গুণ তারা বিক্রি করেছেন। সরেজমিন বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং এলাকা ঘুরে ও শ্রমিক-কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এর সত্যতা পাওয়া গেছে।

বৈধ দরপত্রের আড়ালেই পাচার: বর্ষা মৌসুমে ইটভাটায় কয়লার চাহিদা কমে যায়। তখন খনি থেকে উৎপাদিত কয়লা ইয়ার্ডে জমিয়ে রাখে কর্তৃপক্ষ। পরে চাহিদা বাড়লে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কয়লা রেখে বাকিটা দরপত্রের মাধ্যমে বিক্রি করে বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি। প্রতিটি দরপত্রের বিপরীতে ১০০ টন করে কয়লা দেয়া হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তা ও শ্রমিক জানান, বাস্তবে একেকজন ঠিকাদারের কাছে হাজার হাজার টন কয়লা বিক্রি করা হয়। বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দামেও বিক্রি করা হয় কখনো কখনো। বিক্রির অর্থ সরকারি কোষাগারে না গিয়ে জমা পড়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পকেটে।

মনিরুল ইসলাম নামে একজন লোড-আনলোড শ্রমিক বলেন, প্রতিদিন কাগজে-কলমে যে পরিমাণ কয়লা বিক্রি হতো, বাস্তবে তার পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশি। প্রতিটি ট্রাক তার সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতায় কয়লা বোঝাই করে বের হতো। ফলে দরপত্রের মাধ্যমে কোনো ঠিকাদার যতটুকু কয়লা পেয়েছেন, নিয়ে গেছেন তার দ্বিগুণ। বাড়তি কয়লার দাম বিলিবণ্টন হয়েছে এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের মধ্যে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, খনিতে উৎপাদন বন্ধের পরও বেসরকারি খাতে কয়লা বিক্রি করেছে খনি কর্তৃপক্ষ। গত ঈদুল ফিতরের আগে ১৭ জুন পর্যন্ত নিয়মিত কয়লা বিক্রি হয়েছে। ঈদের পর গত মাসের শেষ পর্যন্ত এ বিক্রি চলেছে। তবে ঈদের পর ট্রাকের সংখ্যা কিছুটা কম ছিল। দৈনিক পাঁচ-সাতটি ট্রাক কয়লা নিয়ে যেত।

কয়লার ইয়ার্ডে নিয়মিত ট্রাকের আসা-যাওয়া দেখেছেন শাহা গ্রামের বাসিন্দা ও খনি শ্রমিক ওবায়েদুল ইসলাম। কয়লা নিতে আসা ট্রাক লোড-আনলোডও করেছেন তিনি। এ খনি শ্রমিক জানান, খনিতে উৎপাদন বন্ধের পরও ইয়ার্ড থেকে কয়লা বিক্রি হয়েছে। এমনকি গত ঈদের পরও যে কয়লা বিক্রি হয়েছে, তা তিনি শ্রমিক হিসেবে লোড করেছেন।

তবে চলতি বছরের মার্চের পর বাইরে কোনো কয়লা বিক্রি হয়নি বলে দাবি বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানির সদ্য অপসারিত ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হাবিবুর রহমানের। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আমাদের মজুদ যখন চার লাখ টন হলো, তখন বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) জন্য মজুদ রেখে আমরা উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে গ্রাহকদের প্রত্যেককে ১০০ টন করে নির্দিষ্ট পরিমাণ কয়লা দিয়েছি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, গত ছয় বছরে বিপিডিবি যে পরিমাণ কয়লা ব্যবহার করেছে, গত ছয় মাসে নিয়েছে তার দ্বিগুণ। এছাড়া কয়লা উৎপাদনে যে সিস্টেম লস, সেটি কখনই আমরা হিসাব করিনি। বিপিডিবির বেশি ব্যবহার ও সিস্টেম লসের কারণেই এ সংকট তৈরি হয়েছে।

চুরি হয়েছে সবসময়: বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানির কয়লা চুরি নতুন ঘটনা নয়। দীর্ঘদিন ধরেই সীমিত পরিসরে বিক্রির আড়ালে বিপুল পরিমাণ কয়লা চুরি গেছে। তবে অন্যান্য সময় কয়লা খনি থেকে উৎপাদন অব্যাহত থাকায় চুরির বিষয়টি কখনই সেভাবে বোঝা যায়নি। এবার আগের কূপের উৎপাদন বন্ধ হওয়ায় ও শ্রমিক আন্দোলনের কারণে নতুন কূপ খননে বিলম্ব হওয়ায় থলের বিড়াল বেরিয়ে আসে। সামনে আসে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা কয়লা চুরির ভয়াবহ তথ্য।

বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় কয়লা রাখার পর তা বাজারে বিক্রি করতে পারে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি। উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে বিক্রির শর্ত রয়েছে। এ দরপত্রও স্বচ্ছ নয়। দরপত্রকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে বরাদ্দের চেয়ে বেশি কয়লা পাচার করেছেন খনি কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা।

বছরের পর বছর এটি দেখে আসছেন স্থানীয় বাসিন্দা ও তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের শ্রমিক আবু সাঈদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, দরপত্রের মাধ্যমে বিক্রির নামে কয়লা চুরি হয়েছে সবসময়। কিন্তু তখন নিয়মিত উৎপাদন থাকায় আগে চুরির বিষয়টি ধরা পড়েনি। এবার চুরি হয়েছে বেশি, উৎপাদনও বন্ধ। এ কারণে চুরির বিষয়টি এবার বড় করে সামনে এসেছে।

ব্যবসায়ীদের গুদামে কয়লা: গতকাল সরেজমিন বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির ইয়ার্ড ঘুরে দেখা যায়, কয়েক টন কয়লার মাত্র দু-তিনটি স্তূপ। বসিয়ে রাখা হয়েছে অন্যান্য যন্ত্রপাতিও। তবে কয়েকজন শ্রমিক মাটি খননযন্ত্রের (এক্সক্যাভেটর) মাধ্যমে ভূমির সঙ্গে লেগে থাকা কয়লা সংগ্রহ করছেন। ১৭ একর জায়গাজুড়ে পুরো ইয়ার্ডটি শূন্য পড়ে আছে। অথচ দুই মাস আগেও খনির পাশ দিয়ে যাওয়া চৌহাটি রাস্তা থেকে উঁচু দেয়ালের ওপাশে কয়লার বিশাল স্তূপ দেখা যেত।

সে কথাই বলছিলেন চৌহাটি গ্রামের বাসিন্দা দুলু মিয়া। তার ভাষায়, রোজার মধ্যেও রাস্তায় দাঁড়ালে কয়লার স্তূপ দেখা যেত। কয়েক দিনের মধ্যে এখন পুরো খনি খালি।

খনি এলাকা শূন্য হলেও কয়লার মজুদ দেখা যায় আশপাশের ব্যবসায়ীদের গুদামে। ইয়ার্ডের কয়েক গুণ কয়লা রয়েছে এসব গুদামে। নানা নামে কয়লা নিয়ে মজুদ করে রেখেছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে শ্যামলী আবাসিক হোটেল ও হ্যাচারির নামে বিপুল পরিমাণ কয়লা নিয়ে মজুদ করেন একজন। পাশেই রয়েছে সুমাইয়া ট্রেডার্স নামে অন্য এক ব্যবসায়ীর দুটি বিশালাকৃতির গুদাম। এর বাইরে বাউন্ডারিঘেরা কয়লার ছোট ছোট স্তূপ তো রয়েছেই।

উল্লেখ্য, বিপিডিবির সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী জ্বালানি হিসেবে বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুতের জন্য তিন মাসের কয়লা মজুদ রাখার দায়িত্ব খনি কর্তৃপক্ষের। এর ব্যত্যয় ঘটলে তার দায় খনি কর্তৃপক্ষের। ২৯ মে থেকে খনিতে কয়লা উত্তোলন বন্ধ হয়ে যায়। নতুন কূপ খনন ও উত্তোলন শুরু হতে সাধারণত তিন মাস সময় লাগে। সে হিসাবে জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত কয়লা মজুদ রাখার কথা ছিল। কিন্তু ইয়ার্ড থেকে প্রায় দেড় লাখ টন কয়লা উধাও হওয়ার পর দেড় মাসের মধ্যেই মজুদ সংকট দেখা দেয়। কয়লার অভাবে বন্ধ করে দিতে হয়েছে দেশের কয়লাভিত্তিক একমাত্র বিদ্যুৎকেন্দ্রটি।